যদি কোনো স্থানে দৈনিক গড় তাপমাত্রা থেকে ৫ ডিগ্রি বেড়ে যায় এবং তা পরপর ৫ দিন চলমান থাকে তাহলে তাকে হিটওয়েভ বা তাপপ্রবাহ বলা হয়ে থাকে।
একটা গবেষণাশ দেখা গিয়েছে, গত ১ লাখ ২৫ বছরের মধ্যে গত দশকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে গিয়েছে অতিমাত্রায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এই প্রভাব বাংলাদেশেও পরেছে। ২০২৩ সালকে বাংলাদেশের উষ্ণতম বছর ঘোষণা করা হয়েছিল তাপপ্রবাহের কারণে। তবে ধারণা করা হচ্ছে ২০২৪ সাল সেই রেকর্ড ভেঙে উষ্ণতম বছর হওয়ার পথে।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুযায়ী প্রতিবছর এপ্রিল – মে মাসে আবহাওয়া সবথেকে উত্তপ্ত থাকে। কেননা এ সময়ে সূর্য বাংলাদেশের কাছাকাছি থাকে এবং সূর্য কিরণ বেশি পেয়ে থাকে। তবে এ বছর সকল মাত্রা ছাড়িয়েছে। বৈশাখের আগমনের আগে থেকেই দেশের তাপমাত্রা বাড়তে থাকলেও বৈশাখের শুরু থেকেই দাবদাহ তীব্র আকার ধারণ করেছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, এপ্রিল জুড়েই থাকবে এই তাপপ্রবাহ। মে মাসেও এর প্রভাব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত কয়েক দশকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে কয়েকগুণ। বিশেষ করে গত ১ যুগ আগেও এতো খারাপ অবস্থা ছিল না। সারা বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে বাংলাদেশেও। মরুর দেশে বন্যা, বৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর শীতপ্রধান দেশে এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে খরা, দাবদাহ সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ গুলো যেন আমাদের পৃথিবীর ভালো না থাকার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক, উন্নত থেকে উন্নততর প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে বিশ্ব দিনদিন ঝুঁকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের উন্নত দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও নগরায়ন, শহরায়ন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সবুজায়নের কথা যেন ভুলেই গিয়েছে। ফলস্বরূপ আমরা হিটওয়েভ বা তাপপ্রবাহের শিকার। যা মানুষের প্রাণ কেঁড়ে নিচ্ছে।
এক যুগ আগের কথাও যদি বলি তাহলে শীত শুরু হতো সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের দিকে ( গ্রামাঞ্চলে) শহরে শীতের প্রকোপ নভেম্বরেই শুরু হতো। ফেব্রুয়ারী শেষে মার্চেও শীতের রাজত্ব চলত যেন। অথচ সেই শীত এখন ডিসেম্বর জানুয়ারীতেই যেন সীমাবদ্ধ। আর এই সময়ে শীতের প্রকোপ টা থাকে মাত্রাতিরিক্ত। আবার, শীত যেমন দেরীতে এসে আগেভাগে বিদায় নেয় তেমনি গরম এসে হাজির হয় গ্রীষ্মের আগেই। আর বর্ষা সে তো সারাবছরই যেন বিরাজমান। শীত, শরৎ আর হেমন্ত, বসন্ত সবাই বৃষ্টির ছোঁয়া পায়।
ষড়ঋতু বাংলাদেশের ঋতু পরিবর্তনের যেন ষড়যন্ত্র মেতেছে প্রকৃতি। আসলে কি তাই? প্রকৃতির এই বেহাল দশা কি প্রকৃতি নিজেই করেছে? একদমই নয়। মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগগুলো ধীরে প্রকৃতির এই দশা করেছে।
পৃথিবী কে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচাতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ নিয়ে আসতে হবে শূন্যের কোঠায় আর অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে হবে। আর এ যেন অসম্ভবই আমাদের জন্য। একদিন, দুই দিন কিংবা দুই চার বছরে বিশ্বের এই বেহাল দশা তৈরি হয় নি। ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময়ের অবহেলা আর মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন কার্যকলাপ প্রকৃতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গিয়েছে খুব যত্নের সাথে যেন।
দেশী এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শুধু ঢাকাতেই বছরে অসহনীয় গরম দিনের সংখ্যা গত ছয় দশকে অন্তত তিনগুণ বেড়েছে।
একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, ২০৫০ সালের মধ্যে তাপপ্রবাহ বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩.৫ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার মারাত্মক প্রভাব ফেলবে এবং তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শহরে বসবাসকারী মানুষ। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। গত ৭ বছরে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ৩.৫১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তাই এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতেও দীর্ঘ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন আবশ্যক। কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ হ্রাস করতে কলকারখানা বন্ধ করতে হবে, আর তা সম্ভব নয়। কেননা এতে বিশ্ব অর্থনীতি স্থবির হয়ে পরবে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ হ্রাস এবং অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে একমাত্র সমাধান হলো সবুজায়নে মনোযোগ দেওয়া। গাছ ই একমাত্র পরিবেশ কে রক্ষা করতে পারে তা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই।
যে অঞ্চলে গাছ নেই বা গাছ কম সে অঞ্চলের তুলনায় যে অঞ্চলে গাছ রয়েছে সে অঞ্চলের তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি কম থাকে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে সবুজায়ন কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
তাই সবুজায়ন ও পরিবেশ বান্ধব কার্যক্রমের সমন্বয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর চেষ্টা করতে হবে আমাদের। পরিবেশ বান্ধব কল কারখানা স্থাপন এবং পরিবেশ বান্ধব পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি ই ধীরে ধীরে উষ্ণতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।
পাট গাছ- যা প্রকৃতিতে তুলনামূলক ভাবে বেশি অক্সিজেন প্রদান করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড বেশি শোষণ করে।
আমরা জানি পাট কে এবং পাট থেকে তৈরি সকল পণ্য কে পরিবেশ বান্ধব বলা হয়ে থাকে। কেননা পাট ও পাট জাত পণ্য পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না। এজন্য পাট কে পরিবেশ বান্ধব বলে। পাট পচনশীল, দীর্ঘ সময় ভেজা অবস্থায় থাকলে কিংবা মাটিতে ফেলে রাখলে পঁচে যায় এবং মাটিতে মিশে যায় ফলে পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না। এমনকি পাট থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করার পর যে বর্জ্য থাকে তাও বর্তমানে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। পাট থেকে তৈরি অধিকাংশ পণ্য রিসাইকল করা সম্ভব যা পরিবেশ বান্ধব। পাটের বীজ বপনের অল্প কয়েকদিন পর থেকেই আমরা সুফল পেতে শুরু করি। আর এই পরিবেশবান্ধব পাটের সুফল তে থাকে পাটের বর্জ্য পাওয়া পর্যন্ত। পাট থেকে তৈরি পণ্য পরিবেশ বান্ধব হওয়ায় এর ব্যবহার বৃদ্ধি করা গেলে তা প্রকৃতির জন্য ভালো ফলাফল প্রদান করবে।
মনে করুন, আপনি একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার করছেন। ব্যবহার শেষে স্বাভাবিক ভাবে ই এটা ফেলে দিবেন। কিন্তু এই ফেলে দেওয়া পলিব্যাগ টি মাটিতে শত বছরেও মিশে যাবে না। পানিতে ফেলে দিলেও তা জলজ প্রানীর জন্য ক্ষতিকারক হয়। অর্থাৎ পরিবেশ দূষণ হবেই। অন্যদিকে, পাট থেকে তৈরি কোন ব্যাগ ব্যবহার শেষে মাটিতে ফেলে রাখলেও তা ৬ মাসের মধ্যে মিশে যাবে। পানিতে ফেললে পঁচে পানির সাথে মিশে যাবে এবং তা কোন ভাবে ই জলজ প্রাণী, উদ্ভিদের কোন রকম ক্ষতি করবে না। এমনকি মাছের পেটে গেলেও তাতে ক্ষতির আশংকা নাই।
মাটি, পানি, বায়ু তথা পরিবেশের উপাদান গুলো একটা একটার সাথে জড়িত এবং একটার দূষণের সাথে আরেকটা জড়িত। ফলে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খড়া, অতিবৃষ্টি, তাপপ্রবাহ সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ গুলো খুব ঘনঘন দেখা দিচ্ছে। এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতে সচেতন হতে হবে আমাদের। পরিবেশ বান্ধব পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি, সবুজায়ন বৃদ্ধি করতে হবে। বৃক্ষরোপণের মাত্রা বাড়াতে হবে। পাট চাষের সময় শুরু হয়েছে। আর অন্যান্য গাছের তুলনায় পাট দ্রুত অক্সিজেন সরবার করতে পারে।
একটা গবেষণায় দেখে গিয়েছে, “১ হেক্টর বা সাড়ে সাত বিঘা জমিতে পাট চাষ করলে তা ১০০ দিনে প্রকৃতি থেকে ১৫ টন কার্বনডাই-অক্সাইড শোষণ করে নেয়। একই সাথে প্রকৃতি কে ১১ টন অক্সিজেন প্রদান করে থাকে।”
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭.৫ -৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়। তাহলে পাট কি পরিমাণ অক্সিজেন প্রকৃতি কে প্রদান করে আর কি পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রকৃতি থেকে শোষণ করে ⁉️তা হিসেব করতে আসলেই ক্যালকুলেটর নিয়ে বসতে হবে।
পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময় চৈত্র মাসের শেষ দিক থেকে বৈশাখের শুরুর দিক। সে হিসেবে হয়তো পাট চাষীরা পাটের বীজ বপন করে ফেলেছেন। পাট বাংলার সোনালী আঁশ, রূপার কাঠি, পরিবেশ বান্ধব এগুলোর পাশাপাশি অক্সিজেন সরবরাহ, কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণের মাধ্যমে উষ্ণতা কমাতে সাহায্য করতে পারে। দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি স্থানীয় উষ্ণতা কমাতেও সাহায্য করতে পারে পাট গাছ।
কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণতার দরুণ প্রকৃতিতে যেমন শীত, গরমে প্রভাব পরেছে একই ভাবে সঠিক সময়ে এবং সঠিক অনুপাতে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পাটের সঠিক গুণগত মান বজায় থাকছে না। গত বছর আমরা তা দেখেছি। গত বছর সঠিক সময়ে বৃষ্টি পাত না হওয়ায় পাটের আঁশ সঠিক রঙ ধারণ করতে ব্যাহত হয়েছে যা পাটের দাম কমিয়ে দেয়
আসলে বিষয়গুলো একটার সাথে একটা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ঠিক দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মতো। তাই আমাদের উচিত পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন পণ্য বর্জন করা একই সাথে পরিবেশ বান্ধব সকল পণ্যের ব্যবহার বাড়ানো। গাছ লাগাতে হবে বেশি বেশি। পাট চাষীদের আরও বেশি উৎসাহিত করতে হবে পাট চাষের জন্য। অধিক পরিমাণ জমিতে পাট চাষ করা গেলে অধিক পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ হবে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডও বেশি শোষণ হবে। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা কমবে। ইন শা আল্লাহ ।
বাংলার ঐতিহ্য পাট শুধু দেশের রপ্তানি আয় বাড়িয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশ কে তুলে ধরছে তা নয়।পাটের বহুমুখী গুণের জন্যও সমাদৃত। তবে পরিবেশ বান্ধব পাটের প্রকৃতিতে অক্সিজেন সরবরাহ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নেওয়া আমাদের জন্য আরও বেশি স্বস্তিদায়ক। তাই সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে পাট চাষে আগ্রহী করে তুলতে উৎসাহিত করতে হবে পাটচাষিদের।
Ruma Akhter
Owner & Designer of Jute Heaven.