আপনার ত্বকে কি মেছতা বা ব্রণের দাগ আছে? আপনার ত্বক কি টান টান না? আপনি চুল, ত্বক ও নখ ফর্সা করতে চান অথবা সৌন্দর্য্য বাড়াতে চান? তাহলে দ্বারস্ত হতে পারেন ব্র্যান্ড প্রমোটার বারিশ হকের। আপনার সমস্যা যাই হোক না কেন, তার কাছে কোনো না কোনো জুস বা ক্রিম থাকবে সমস্যার সমাধানে। নানা বিতর্কে জর্জরিত তার প্রতিচ্ছবি সাধারণ মানুষের কাছে যেমনই হোক না কেন, বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মীর মতো পরামর্শ দেন বারিশ হক।
নেটিজেনরা স্যাটায়ার করে বলছেন, সর্ব রোগের চিকিৎসক তিনি। পণ্যটি সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন না থাকলেও, থেমে থাকে না তার প্রচার কার্যক্রম। এমনকি দেশি-বিদেশি স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের নকল পণ্যও অবলীলায় প্রমোট করেন। গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করতে পণ্য সম্পর্কে দেন নানা ভুল তথ্যও।
এমনকি ব্যবহার করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নাম। জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করতে তার এমন কর্মকাণ্ডকে প্রতারণার শামিল বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য ও সেবার প্রমোশন বা প্রচারে ব্র্যান্ড প্রমোটার হিসেবে কাজ করেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যবহারকারী ‘ফলো’ তথা অনুসরণ করেন।
এজন্য ব্র্যান্ডের প্রচারে চড়া মূল্য নিতেও পিছপা হন না। তবে অর্থের বিনিময়ে নকল, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) অনুমোদনহীন, আমদানিকারকের স্টিকারবিহীন পণ্য প্রচারের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
২০২৩ সালে জুয়ার সাইটের প্রচার করে খবরের শিরোনাম হন। গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে ভিডিওতে ছড়ান বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য। দেন নগদ টাকার লোভ।
ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড পেজে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ক্রিমের প্রচারে বলছেন, “এটা স্কিনকে টান টান করে, উজ্জ্বল করে, মেছতার দাগ দূর করে, ব্রণের দাগ দূর করে; মোট কথা, ‘অল ইন অল’ একটা ক্রিম”।
পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী বা বিশেষজ্ঞ না হয়েও চিকিৎসকদের মতো পণ্যের পরামর্শ দিতে তাকে দেখা যায় আরেকটি ভিডিওতে।
‘সার্টে’ নামক একটি ফেসবুক পেজে প্রকাশিত ওই ভিডিওতে ত্বক উজ্জ্বলকারী এক জুসের প্রচারে বলেন, ‘এই জুস শুধু ফুল বডি উজ্জ্বল করবে, তা কিন্তু নয়।
আপনার চুল, ত্বক ও নখের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য এটি কিন্তু খুবই উপকারী। প্রেগন্যান্ট আপুরা ছাড়া বাকি সবাই এই জুসটা পান করতে পারবেন”।
বিভিন্ন সূত্রমতে, ‘সার্টে’ নামক এই পেজটা মূলত তারই। অন্যান্য ব্র্যান্ডের পণ্যের প্রচারের পাশাপাশি, এই পেজ থেকেও একই ধরনের পণ্য বিক্রি করেন। ‘সার্টে’ নামক ওই পেজে অন্য প্রমোটারদের দিয়ে মিথ্যা তথ্য সম্বলিত ভিডিও প্রকাশ হতেও দেখা যায়।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে পেজে প্রকাশিত এক রিল এর মাধ্যমে ‘গুলাটিন কোলাজেন পিংক’ নামক জুসের প্রচার করা হয়। এই জুস প্রমোট করেই আলাদাভাবে ভিডিও প্রকাশ করেন। তবে এই ভিডিওতে দেখা যায়, প্রমোটার জুসটি নিজেও পান করার দাবি করছেন। তবে ব্যাকগ্রাউন্ড কৌশলীদের সঙ্গে আলোচনাকালে প্রমোটার বলছেন, ‘জুসটা অনেক মজা হলে আমি খেতে চাই’।অর্থাৎ নিজে পান না করলেও, গ্রাহকদের আস্থা অর্জনে জুসটি পান করে বলে মূল ভিডিওতে দাবি করেন সেই প্রমোটার।
গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করতে পৃথক আরেকটি ভিডিও’তে ‘সার্টে’ পেজ থেকে কেনাকাটায় ২ লাখ টাকা অর্থ পুরস্কারেরও ঘোষণা করেন। ৬০ জনকে নগদ অর্থের পাশাপাশি ১০ জনকে স্বর্ণ, স্মার্টফোন, স্মার্ট টিভি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সার্টে কেনাকাটার প্রস্তাব দেন।
নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত এসব উপায়ের পাশাপাশি পণ্যের প্রচারে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নামও ব্যবহার করেন। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর গত ১৯ আগস্ট ‘চায়না মার্ট’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রচারে এক লাইভে ‘টেইলর উই আলো’ নামক আরেকটি পেজের দেওয়া পোশাক পরেন। সেই লাইভের ক্যাপশনে লেখেন, ‘গ্লোবাল সুপারস্টার মুহাম্মদ ইউনূস স্যার অনুপ্রাণিত ডিজাইনার ড্রেস আউটফিট’। তারপর সেখানে ব্র্যান্ডগুলোর পেজের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড পেজও ট্যাগ করেন। শুধু তাই নয়, ভিডিওতে দাবি করেন, পোশাকটির ডিজাইন অনুপ্রাণিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। তবে নেটিজেনদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে লাইভের ক্যাপশন থেকে প্রধান উপদেষ্টার নাম সরাতে বাধ্য হন। এ ছাড়াও সাধারণ দর্শকদের বিভ্রান্ত করতে অন্য ব্যক্তিদের পরিচয়ও ব্যবহার করেন।
চিকিৎসক জাহাঙ্গীর কবীর চা ও জুস পানের মাধ্যমে শরীরের ওজন হ্রাসের প্রচার করেন উল্লেখ করে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন। তবে এই ভিডিওর প্রতিবাদ করে পালটা ভিডিও দেন ডা. জাহাঙ্গীর কবীর। অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব ক্রিম, চা কিংবা জুসের মতো পণ্যের বিএসটিআই অনুমোদন নেই, অথচ এটি বাধ্যতামূলক। এসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় বলে নিজেই জানান। তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ অনুযায়ী, আমদানি করা পণ্যে আমদানিকারকের স্টিকার সংযুক্ত থাকতে হয়।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা নির্ধারিত নিয়মের বাইরে পণ্যের প্রচার, প্রসার ও বাজারজাতকরণের পাশাপাশি নামিদামি বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল পণ্যেরও প্রচার করেন।
চায়না মার্ট দোকানের বিক্রি করা এসব অবৈধ পণ্যের প্রমোশন করেন। এজন্য দর্শক ও গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করতে ছড়িয়ে থাকেন ভুয়া তথ্য। একটি ভিডিওতে ‘মাইকেল কোর্স (এমকে)’ ব্র্যান্ডের নকল একটি হ্যান্ডব্যাগের প্রচার করতে দেখা যায় তাকে। সেই ভিডিওতে দর্শকদের উদ্দেশে বলেন, এই ব্যাগটির আসল সংস্করণের মূল্য ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা।
তবে এ-সংক্রান্ত সঠিক তথ্য উপস্থাপন করে আরেকটি ভিডিও প্রকাশ করেন ইংল্যান্ডে অবস্থানরত জারিন তানহা নামক এক নারী ব্লগার। সেই ভিডিওতে জারিন তানহা ব্র্যান্ডটির ওয়েবসাইট তুলে ধরে জানান যে, ব্যাগটির আসল সংস্করণের দাম প্রায় ৩৮ হাজার টাকা। কোনোকিছুর প্রচারের আগে সেটি সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনে প্রচারে নিজের ভিডিওতে পরামর্শ দেন জারিন তানহা।
এ বিষয়ে কাশফিয়া শ্রাবন্তী নামের এক নারী ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বলেন, ‘ব্যাগটির অনেক দাম দেখিয়ে, গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করা হচ্ছে যে, এত দামি ব্যাগ কত কম টাকায় তারা দিচ্ছে।
যারা এতটা ভেতরের তথ্য ঘেঁটে দেখেন না, তারা বারিশ হককে বিশ্বাস করে নকল ব্যাগটি কিনে ফেলবেন। এটা গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করা’।
এ ধরনের প্রচার সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা উল্লেখ করে কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, বিভিন্ন চটকদার কথায় যেকোনো কিছুর প্রচার করে থাকেন এই ব্র্যান্ড প্রমোটাররা।
এ রকম প্রমোশন অনেকেই করছেন কিন্তু বিষয়টি আলাদা করে বলতে হয়। ব্র্যান্ড প্রমোটাররা যেন টাকা পেলেই যেকোনো কিছু প্রমোশন করেন। কিন্তু প্রমোট করা পণ্যের অনুমোদন আছে কি না, ল্যাব টেস্ট হয়েছে কি না এগুলোর গুণগত মান কেমন; সেসব নিয়ে ভিডিওতে কিছু থাকে না। আবার একই ব্যক্তি একবার বলছেন, জুস খেলে স্লিম হওয়া যায়। আবার তিনিই বলছেন, বিশেষ এক ধরনের পোশাক পরলে স্লিম হওয়া যাবে।
আবার তিনি দেখাচ্ছেন যে, এক ক্রিমেই পুরো শরীর সাদা ও ফর্সা হয়ে যায়। এক জুস খেলেই ত্বক, চুল, নখ সুন্দর হয়। এমন ক্রিম বা জুসেই শরীরের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন জিনিস তো পৃথিবীতে নাই।
আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে অবস্থান তারা অর্জন করেছেন, সেটিকে কাজে লাগিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বানও জানান পলাশ মাহমুদ।
এদিকে ক্রিম এবং জুসের মতো পণ্য বিএসটিআইর অনুমোদন ছাড়া বিক্রি ও সেগুলোর প্রচার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক এস এম ফেরদৌস আলম।
তা ছাড়া অনুমোদনহীন পণ্যে মানবদেহের মারাত্মক ক্ষতির ঝুঁকির কথা জানিয়ে এসএম ফেরদৌস আলম বলেন, বাধ্যতামূলক পণ্য হলে বিএসটিআইর অনুমোদন লাগবে এবং এ ধরনের পণ্য (ক্রিম, জুস ইত্যাদি) সেই বাধ্যতামূলক পণ্যের তালিকাভুক্ত। কাজেই এগুলোর অনুমোদন থাকা উচিত। অনুমোদনহীন এবং নকল পণ্যের বিরুদ্ধে বিএসটিআই নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করে। তবে অনলাইন শপের ক্ষেত্রে তাদেরকে শনাক্ত করা কঠিন।
এর আগে দুয়েকটি খোঁজ করলাম কিন্তু তাদের দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে কাউকে পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, ত্বকের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। হাইড্রো কুইন এবং মার্কারির পরিমাণ যদি কমবেশি হয়, ১ গ্রাম বা ১ গ্রামের ১০ ভাগের ১ ভাগ কমবেশি হলে সাধারণত কারো নজরেও আসে না।
কিন্তু এই মাত্রা কমবেশি হলেই ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি হয়। সচেতন মানুষজন সাধারণত এগুলো ব্যবহারও করে না।এগুলো ব্যবহার করে বেশি প্রতারিত হয় তৃণমূলের সাধারণ মানুষ এবং নিম্ন মধ্যবিত্তরা। যারা বিএসটিআই অনুমোদনহীন পণ্য প্রমোট করে তাহলে সেটি দণ্ডনীয় অপরাধ।
বিএসটিআই মহাপরিচালক আরও বলেন, পণ্য এবং পণ্যের মোড়ক দুটোরই আলাদা করে অনুমোদন নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা শুধু মোড়কের অনুমোদন নেয়, তার ভেতর পণ্য ভরে বিক্রি করে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে যেন পণ্যটাও অনুমোদিত।
এ বিষয়েও গ্রাহকদের সচেতন হতে হবে। যারা এগুলো বিক্রি করছে তাদের কাছে বিএসটিআই অনুমোদনের সার্টিফিকেট দেখতে চাবেন।