ভারতের চীনা স্মার্টফোন ব্র্যান্ডগুলোর আধিপত্য ক্রমে বাড়ছে। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশটিতে চীনা ব্র্যান্ডগুলোর দখল বেড়ে ৭৪ শতাংশে পৌঁছেছে, যা এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ৭২ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ভারতে চীনা ব্র্যান্ডগুলোর দখল রেকর্ড ৮১ শতাংশে পৌঁছতে দেখা গিয়েছিল। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। খবর ইটি টেলিকম।
কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের বিশ্লেষকদের দাবি, চীনা স্মার্টফোন ব্র্যান্ড শাওমি, অপো, ভিভো, রিয়েলমি এবং ওয়ানপ্লাস চলতি উৎসব মৌসুমে ভারতের ক্রমবর্ধমান স্মার্টফোন নিজেদের সম্মিলিত দখল ৭৫ শতাংশে পৌঁছতে সক্ষম হবে। ভারতের বাজারে আধিপত্যে ফিরতে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড স্যামসাং এবং অ্যাপল কার্যক্রম জোরদার করেছে। একই সঙ্গে দেশটির স্থানীয় ব্র্যান্ড মাইক্রোম্যাক্স এবং লাভা নতুন করে প্রতিযোগিতায় ফিরতে কাজ শুরু করেছে। সামগ্রিকভাবে ভারতীয় ক্রেতাদের জন্য ডিভাইস পছন্দের অপশন বেড়েছে, যা তাদের ফিচার ফোন ছেড়ে স্মার্টফোন ব্যবহারে অনুপ্রাণিত করছে।
এ বিষয়ে কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের বিশ্লেষক শিল্পি জৈন বলেন, ডিভাইস পছন্দের অপশন বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক ও স্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর আগ্রাসী মূল্যনীতির কারণে ভারতে স্মার্টফোন বিক্রি ক্রমে বাড়ছে। বৈশ্বিক ব্র্যান্ড স্যামসাং ও অ্যাপলও এখন চীনা ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা বাড়াতে কার্যক্রম জোরদার করেছে। চলতি বছর তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে ভারতে চীনা স্মার্টফোন ব্র্যান্ডগুলোর বাজার দখল ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
শিল্পি জৈন বলেন, ভারতের স্থানীয় স্মার্টফোন ব্র্যান্ড মাইক্রোম্যাক্স তুলনামূলক সাশ্রয়ী এবং এট্রি লেভেলের ডিভাইস উন্মোচনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতায় ফেরার ঘোষণা দিয়েছে, যা বাজারটিতে স্থানীয় ডিভাইস ব্র্যান্ডগুলোর দখল বাড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতের সাশ্রয়ী স্মার্টফোন বাজারে পাঁচ বছর আগেও নেতৃত্বে ছিল মাইক্রোম্যাক্স। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাজারটিতে ডিভাইস ব্র্যান্ডটির আধিপত্য তলানিতে ঠেকেছে। ডিভাইস বাজারে গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠানটির তেমন জোরালো কোনো উপস্থিতিও দেখা যায়নি। ভারতে চীনভিত্তিক ডিভাইস ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ছিটকে পড়েছিল মাইক্রোম্যাক্স। এবার ব্র্যান্ডটি ভারতীয়দের চীনবিরোধী মনোভাব এবং নরেন্দ্র মোদি সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে ডিভাইস বাজারে প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ স্মার্টফোন বাজার ভারত। দেশটিতে প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডগুলোর চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে সাশ্রয়ী চীনা ডিভাইস ব্র্যান্ডগুলো। গত জুনে ভারত-চীনের সীমান্ত উত্তেজনার জেরে ভারতে বিভিন্ন মহল থেকে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক উঠেছে। সোস্যাল মিডিয়ায় চীনা অ্যাপ আনইনস্টলেরও দাবি জানিয়েছিলেন অনেকে। কার্যত টিকটক, ইউসি ব্রাউজার, শেয়ারইট, বিগো লাইভ ও হেলোর মতো ৫৯টি চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে সে পথেই হাঁটে ভারতের সরকার। চীনা এসব অ্যাপকে দেশটির সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, প্রতিরক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি উল্লেখ করা হয়েছিল। ভারতীয়দের এমন মনোভাবকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চাইছে মাইক্রোম্যাক্স।
ভারতীয়দের চীনা পণ্য বর্জনের ডাকের মধ্যেই শাওমি, ভিভো, অপো ও রিয়েলমির মতো অতি প্রচলিত ফোন ব্র্যান্ডগুলোর আধিপত্য কমাতে ফিরছে মাইক্রোম্যাক্স। ১৫ হাজার রুপির কম দামে মাইক্রোম্যাক্স যে ডিভাইসগুলো আনতে চলেছে, তা ভারতে চীনা ডিভাইস ব্র্যান্ডগুলোর ব্যবসায় বড় ধস নামাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে এক ভিডিও টুইটে মাইক্রোম্যাক্সের প্রতিষ্ঠাতা রাহুল শর্মা ডিভাইস বাজারে প্রত্যাবর্তনের তথ্য দেন। ওই ভিডিওতে নতুন স্মার্টফোন সিরিজ সম্পর্কে তথ্য শেয়ার করেননি তিনি। রাহুল শর্মা জানান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলেন, তখন থেকেই আমরা এটি নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই মাইক্রোম্যাক্স নতুন সিরিজের ফোন নিয়ে বাজারে ফিরছে। ওই ভিডিওতে নতুন একটি স্মার্টফোনের বক্স দেখিয়েছিলেন তিনি।
গত ১৫ জুন লাদাখ সীমান্তে সংঘর্ষে ভারতের ২০ সেনা নিহত হওয়ার পর ভারত-চীনের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। চীন ও ভারত উভয় দেশ সীমান্তে সৈন্য জড়ো করে। ওই সময় ভারত সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, চীনা অ্যাপ ও ডিভাইস দেশ ও দেশের নাগরিকদের জন্য বিপজ্জনক। যে কারণে স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটসহ সব ধরনের গ্যাজেটে অ্যাপগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতীদের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষাদান এবং দেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্যই অ্যাপগুলো নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ভারত যেসব অ্যাপ বন্ধ করেছে, এর মধ্যে দেশটিতে জনপ্রিয় অ্যাপ উইচ্যাটও রয়েছে। চীনা অ্যাপ বন্ধ করার ঘটনায় ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে কয়েক ডজন অ্যাপ নিষিদ্ধের ঘটনা চীনের ডিজিটাল সিল্ক রুটের উচ্চাভিলাষের পক্ষে একটি বড় ধাক্কা হতে পারে। এতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যায়ন কমবে। ভারতের এসব অ্যাপ বন্ধ করার উদ্যোগ এখন অন্য দেশও অনুসরণ করতে পারে। কারণ অ্যাপগুলোর বিরুদ্ধে আগে থেকেই ব্যবহারকারীর তথ্য স্থানান্তরের অভিযোগ ছিল।