এক বছর আগেও দেখতে পাওয়া যেতো বিদেশি পণ্যে সয়লাব বাজারের বিপণীকেন্দ্র গুলো। অনলাইন ভিত্তিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলোতেও পোশাক, গহনা সহ বিভিন্ন খাতে বিদেশি জিনিসের আধিক্য ছিলো লক্ষ করার মতো। গত কয়েক বছরের তুলনায় গত এক বছরে এই চিত্রের বেশ ভালো বদল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, বিশেষত ই-কমার্সে। অনলাইনে দেশিপণ্যের উদ্যোক্তাদের স্বক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছে এখন। রূপগঞ্জের জামদানী, টাঙাইলের খেশ, সাতক্ষীরার মাদুর,সিলেটে শীতলপাটি, রংপুরের শতরঞ্জি সহ বিভিন্ন জেলার জেলাব্র্যান্ডিং খাদ্য পণ্যের বিক্রিও বেড়েছে।বেড়েছে অনলাইনে দেশিপণ্যের ক্রেতা। কোভিড-১৯ এর প্রকোপ বাংলাদেশে শুরু হওয়ার পর বেশিরভাগ বিদেশি পণ্যের আমদানি বন্ধ হয়ে যায় যার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসও ছিলো। ফলে অনলাইন নির্ভর মানুষ সহজলভ্য এবং খাঁটি দেশিপণ্যের প্রতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মমতা অনুভব করে।
সম্প্রতি বেশ সুনামের সাথে আলোচনায় এসেছে দেশিপণ্যের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম সেরা প্ল্যাটফর্ম উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)। প্রায় দশ লক্ষ সদস্যের প্ল্যাটফর্মটি দেশিপণ্যের প্রচার, প্রসার, দেশিপণ্যের উদ্যোক্তাদের পরিচিত,ট্রেনিং সহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছে বিগত এক বছর ধরে।ফলে দেশিপণ্য আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস।
উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম এর প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা বলেন, আমাদের প্ল্যাটফর্মটি সর্বস্তরের মানুষের জন্য উম্মুক্ত তবে পণ্যের প্রসারের ক্ষেত্রে অবশ্যই দেশিপণ্যের উদ্যোক্তাদের জন্য উই।গত এক বছর ধরে আমরা চেয়েছি উই দেশিপণ্যের প্রসারে অবদান রাখুক,উদ্যোক্তাদের দক্ষ করার দিকে কাজ করুক।আমরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছি উদ্যোক্তাদের জন্য।উইতে কোর্সেরার মতো আন্তর্জাতিক মানের কোর্স এবং সনদ পাওয়ার সুযোগ প্রায় ৮০০’র মতো সদস্য পেয়েছেন একদম বিনামূল্যে।আমাদের উদ্দেশ্য এখন যেমন উই এখন ধীরে ধীরে জাতীয় পর্যায়ের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে এক সময় উই আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পরিচিত হবে দেশিপণ্যের জন্য।
ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে বিক্রি করছেন বেশিরভাগ দেশিপণ্যের উদ্যোক্তা। বগুড়ার দই,ফেনীর খন্ডলের মিষ্টি, গাইবান্ধার রসমঞ্জরী, মেহেরপুরের সাবিত্রীমিষ্টি সহ বিভিন্ন বিখ্যাত মিষ্টান্ন নিয়ে কাজ করছেন তরুণ প্রজন্মের উদ্যোক্তারা।
তরুণদের দেশিপণ্য নিয়ে উদ্যোগ গ্রহণের প্রতি আগ্রহ প্রশংসনীয়। আমাদের দেশের প্রত্যেক জেলাতেই নির্দিষ্ট জেলা ব্র্যান্ডিং পণ্য রয়েছে।এই পণ্য গুলো নিয়ে সেই জেলা এবং সেই জেলার বাইরের জেলা থেকে অনেক উদ্যোক্তা কাজ করছেন। যেমন ঢাকায় বসে কেউ চাইলেই এখন চট্টগ্রামের শুঁটকি পেতে পারেন তেমনি নাটোরের কাঁচাগোল্লা পাওয়া যেতে পারে নীলফামারীতে বসে, শুধুমাত্র ই-কমার্সের কারণে। এছাড়াও মশলা,ফল,সবজির মতো নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনীয় সব ই অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে যা তাজা এবং হাইজেনিক।করোনার মধ্যেও নিয়মিত সেবা দিয়ে চলেছে ঘরে তৈরি খাবারের পেইজ গুলো। উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ডেলিভারি সার্ভিস।ডেলিভারি সার্ভিসের অনুন্নত ব্যবস্থার কারণে অনেক উদ্যোক্তাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
আনন্দের বিষয় হলো ইতিমধ্যেই প্রবাসীরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন দেশিপণ্যের ই-কমার্স নিয়ে।তাছাড়া প্রবাস থেকে দেশিপণ্য কেনাকাটা করেন এমন প্রবাসী ক্রেতার হার বাড়ছে।বিদেশি অনেক ক্রেতাও ভীড় জমাচ্ছেন অনলাইনের দেশিপণ্যের পেইজ গুলোতে এমনটাই উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে জানা গিয়েছে।আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিক্রির হার বাড়লেও সুযোগ খুব সংকীর্ণ এ-ও জানালেন অনেক উদ্যোক্তা, কেননা দেশের বাইরে পণ্য পাঠানোর জন্য কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানী গুলোর মূল্য অনেক ক্ষেত্রে পণ্যের দামের চেয়েও বেশি হয়ে যায়।সরকারি ডাক ও যোগাযোগ অফিস গুলোতেই একই সমস্যা।
এই ব্যাপারটি আরো মসৃণ হলে দেশিপণ্য আন্তর্জাতিক ভাবেও দ্রুত প্রসার বিস্তার করবে বলে মনে করেন তারা।দেশিপণ্যের ই-কমার্স এর প্রসারের ফলে সব জেলার বিখ্যাত পণ্য নিয়ে বাকি জেলার মানুষ জানতে পারছে। শেরপুরের সুগন্ধি চাল তুলসীমালা,রাঙামাটিতে চাষ হওয়া কাজুবাদাম, সিলেটে চাষ হওয়া রাজমার মতো পণ্য সারাদেশে পরিচিত হচ্ছে পাশাপাশি পরিচিত হচ্ছে উদ্যোক্তারাও। বেতের এবং সেগুন কাঠের তৈরি পণ্য বিক্রি হচ্ছে ই-কমার্সে। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কাঁসা-পিতল আবার ফিরে পাচ্ছে আভিজাত্য, মাটির গয়নার বৈচিত্র্য মুগ্ধ করছে এ প্রজন্মের কিশোরী-তরুণীদেরও,নৈশভোজের পরিবেশনায় মাটির পাত্রের ব্যবহার আবার জনপ্রিয় হচ্ছে।
মসলিনকে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রূপে ভ্যালু অ্যাডেড হয়ে ফিরে আসতে পাশাপাশি মানুষের মন জয় করে নিচ্ছে রাজশাহী সিল্কও।
মুন্সীগঞ্জের আলু কিংবা নরসিংদীর কলা কোনোটাই এখন আর আকাশের চাঁদ নেই।চাইলেই এখন ঘরে বসে এসব পণ্য পাওয়া যেতে পারে যেকোনো জেলায়। দেশিপণ্যের উদ্যোগ গুলোর মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষ করা যায়,তা হলো নতুনত্ব বা অভিনবত্ব। আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ দিয়ে আচার হতে পারে এটা আশ্চর্যের হলেও সত্যিই অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে এটি। এছাড়া দেখা যাচ্ছে আমড়াসত্ত্ব, জলপাইসত্ত্বের মতো বিভিন্ন ফল দিয়ে সত্ত্ব বানানো যায়। পোশাকের ক্ষেত্রে দেখা মিললো জামদানী গাউন,জামদানী হিজাব,খেশ দিয়ে কুর্তি/পাঞ্জাবির।
বাটিক,গামছা,ক্লে’র পাশাপাশি সুঁই-সুতার ফোঁড় তোলা কাপড়ের গয়নাও বেশ সাড়া পাচ্ছে অনলাইন পেইজ গুলোতে।পাটের শাড়ি তৈরি হচ্ছে,স্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে হাতে আঁকা বিছানার চাদর, টাই এর মতো জিনিস। দেশিপণ্যের এই নতুনত্ব যেমন নতুন প্রজন্মকে আকৃষ্ট করবে তেমনি বাজারে দেশিপণ্যের রাজত্বে নতুন মাত্রাও যোগ করবে।
দেশিপণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি ব্যাপক হারে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এর সম্ভাবনাও তুঙ্গে। এর সহজলভ্যতা, গুণমানের নিশ্চয়তা, মূল্যের সাশ্রয় এবং ব্যবহারের সুবিধার কারণে এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এছাড়াও দেশ তথা সারাবিশ্বের পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন বিদেশীপণ্যের সংকট, মূল্যবৃদ্ধি সহ নানান সমস্যা দেখা দিচ্ছে, আগের বিভিন্ন সমস্যা তো রয়েছেই।যার ফলে বিদেশি বিনিয়োগেরর বদলে দেশিপণ্যের দিকে নজর দেবে সরকার। তাছাড়া এই অবরুদ্ধ এবং চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে অনলাইনের ওপর শিক্ষা, চিকিৎসা,খাবার সহ বিভিন্ন খাতই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, তাই অনলাইনে দেশিপণ্যের সম্ভাবনা খুব দ্রুত বাড়ছে।যেহেতু বিলুপ্ত, বিলুপ্তপ্রায় এবং কোণঠাসা দেশিপণ্যের বাজার ও চাহিদা দুটোই তৈরী হয়ে গিয়েছে তাই এখন দক্ষ ও একাগ্রতা সম্পন্ন উদ্যোক্তা দরকার শুধু। এই যোগ্যতা ও দক্ষতাসম্পন্ন উদ্যোক্তারা যদি এই সময়টাকে গুরুত্বের সাথে কাজে লাগান আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ই-কমার্সে দেশিপণ্য হতে পারে অর্থনীতির একমাত্র সচল চাকা।অনলাইনে দেশিপণ্যের সম্ভাবনা আগামীতে রাজত্বে রূপ নেবে।
ই-কমার্সের ফলে প্রতিটি গ্রাম,ইউনিয়ন, উপজেলা জেলা সুফল পাবে,উপকৃত হবে উদ্যোক্তা এবং ক্রেতা উভয়ই।দেশিপণ্যের ই-কমার্স চিত্র বদলে যাওয়া নিয়ে দেশিপণ্যের উদ্যোক্তারা আনন্দিত,খুশি দেশিপণ্যের ক্রেতারাও।এভাবে দেশিপণ্য ছড়িয়ে যাবে দেশ-দেশান্তরে যা এখন শুধুই সময়ের দাবি।