একটু একটু করে ডানা মেলে প্রসার হচ্ছে দেশি পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি। এ ইন্ড্রাস্ট্রি বড় করতে প্রতি মুহূর্তে নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। ৯০ দশকের শেষ ভাগে দেশে ই-কমার্সের সূচনা হলেও পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে ২০১২ সালের দিকে। ২০১৫ সালে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রসার ঘটতে থাকে এ ইন্ড্রাস্ট্রিজ। প্রায় পুরো ই-কমার্স জুড়ে ছিল বিদেশি পোশাক ওফ্যাশন, গেজেট আর বিদেশি পণ্যের প্রাধান্য।
উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রতিষ্ঠিত হলেও ২০১৯ এর নভেম্বরে এসে এটি অনলাইনে দেশি পণ্য নিয়ে কাজ করার ব্যপারে উদ্যোগী হয়। প্রথম দিকে গ্রুপে তেমন মেম্বার ছিল না এবং দেশি পণ্যের প্রচারণার মধ্যেই এর কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। তবে ধীরে ধীরে উদ্যোক্তারা তাদের পণ্যের পরিচিতি তুলে ধরেন এবং তা দেখে অনেকেই দেশি পন্যে বিশেষ করে তাঁতের শাড়ি কেনার দিকে আগ্রহী হন। শুরুটা যদিও ছিল জামদানি শাড়িকে ঘিরে তবে সব ধরনের তাঁতের শাড়ির উদ্যোক্তারা সুন্দর সুন্দর ছবি দিয়ে এবং পণ্যের বিবরন দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন।
এর সুফল এখন সবাই পাচ্ছেন বলে উই এর বিভিন্ন পোস্ট দেখা যাচ্ছে। গতকাল উই এর এডভাইজার রাজিব আহমেদ এর একটি পোস্টে কয়েক শতাধিক মেম্বার কমেন্ট করে জানিয়েছেন যে উই এর চেষ্টার কারনে অনলাইনে তাঁতের শাড়ি বিক্রির পরিমান বেড়ে গেছে এবং উই এর ভেতরে ও বাইরে অনেক উদ্যোক্তা এখন তাঁতে শাড়ি নিয়ে কাজ করছেন। এর ফলে তাঁতিরা এখন আগের থেকে বেশি অর্থ পাচ্ছে, তাদের বিক্রি বেড়ে গেছে এবং পণ্যের জন্য দামও বেশি পাচ্ছেন।
উদ্যোক্তারা জানান, গত ১ বছর আগেও অনেক তাঁতীদের উপার্জন অনিশ্চয়তায় জীবন কেটেছে। বর্তমানে খাদি, মনিপুরী, জামদানি, টাঙ্গাইলের শাড়ি সহ অন্য দেশীয় শাড়ী উৎপাদনে তাঁতিদের অগ্রিম টাকা দিয়ে বুক দিতে হয়। বেড়েছে তাঁতীপল্লীর ব্যস্ততা ও কদর। চাহিদা এতো বেড়েছে যে, যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে তাঁতীরা। দেশি পণ্যের ই-কমার্সের কারণে সকল দেশীয় পণ্যের চাহিদা ও সম্ভাবনা বেড়েছে কয়েকগুন।
এতো কদর বাড়ার কারণও জানিয়েছেন দেশি পণ্যের ই-কমার্স উদ্যোক্তারা। তারা বলেন, দেশি শাড়ীর ইতিহাস, উৎপাদন, ব্যবহার, যত্ন সহ খুটিনাটি বিষয়ে উই গ্রুপে লেখালেখির ফলে দেশীয় শাড়ী ব্যবহারে আগ্রহ বেড়েছে। এখন আর দেশীয় শাড়ীর গুণগতমান নিয়ে সংশয় নেই। ই-কমার্সের কল্যাণে ক্রেতারা ঘরে বসে নিজের পছন্দের শাড়ী পাচ্ছে।
কয়েকজন ই-কমার্স উদ্যোক্তার কমেন্ট পড়ে জানা যায়-
মনিকা আহমেদ স্বতাধিকারি কন্যা সুন্দরী। তিনি বলেন, দেশী পণ্যের ই-কমার্স বদলে দিছে তাঁতীদের জীবন। যখন তাঁতের শাড়ী নিয়ে কাজ শুরু করেছি তখনও আশেপাশের ৭০% মানুষজন বিদেশী পণ্যের উপর নির্ভর করতো। দেশীয় তাঁতের শাড়ীর কথা শুনলে অনেকে অবজ্ঞা করতো। বর্তমানে দেশীয় পণ্যের ই-কমার্সের কারনে শাড়ী তৈরীর চাহিদা অনেক বেড়েছে তাঁতীদের। আমাদের অর্ডার গুলো শেষ করতে হিমশিম খাচ্ছে তারা।
কাকলী এটিয়্যার’স এর উদ্যোক্তা কাকলী রাসেল তালুকদার কাজ করেন ঢাকাইয়া জামদানি নিয়ে। তাঁতীদের নিয়ে তিনি বলেন, ই-কমার্সের কল্যাণে তাঁতীরা শুধু ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে তাই নয়, তারা এখন তাঁতের শাড়ির ডিমান্ড ফুলফিল করতে নতুন নতুন তাঁত চালু করছে। তার মানে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরফলে বিদেশী শাড়ির প্রতি নির্ভরশীলতা কমবে।
সিলেট থেকে মনিপুরী শাড়ী নিয়ে কাজ করেন নাসির সাইয়েদ। তার উদ্যোগের নাম তিয়ামো। তিনি কাজ করেন মনিপুরী ও জুম শাড়ী নিয়ে। তাঁতিদের ঘুরে দাড়ানো নিয়ে তিনি বলেন, গতকালও শাড়ি আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। এমন কি যারা সব সময় দোকানের জন্য শাড়ী আনে তারাও এখন শাড়ী পায় না। শাড়ী যেনো সোনার হরিন। আগে কাধেঁ করে শহরে শাড়ী দিয়ে যেতো তাঁতীরা আর এখন আমরা গিয়েও শাড়ী পাই না।
ফেণী থেকে মৃৎশিল্প নিয়ে কাজ করেন তান্নী তনু। তার উদ্যোগের নাম মৃৎনু। তিনি বলেন, সম্প্রতি মৃৎশিল্প কারখানায় গিয়েছিলাম পণ্য আনতে। কুমাররা বলে উঠলো- এরকম চাহিদা যদি সবসময় থাকতো আমাদের আর না খেয়ে থাকতে হতো না। ওদের চোখে, মুখে সে খুশি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। কাজের পেশার বেশি থাকায় খুশি আর উৎফুল্লতার সাথে কাজ করছে তারা। কারণ এখন তাদের সংসার চলছে সুন্দর ভাবে। তাদের এই সুখের কারণ আমি হতে পারায় আনন্দ লাগছিলো!
উম্মে সালমা কাজ করেন কুমিল্লার খাদি নিয়ে। তিনি বলেন, কুুমিল্লার খাদি প্রায়ই বিলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছিল, তাঁতীদের দিন কাল খুবই দুর্বিষহ হয়েছিলো কিন্তু দেশি পণ্যের ই-কমার্সে খাদি এখন বিস্তার লাভ করেছে। দেশের বাইরেও যাচ্ছে খাদি। তাঁতীরা অনেক খুশি তাদের দিন ফেরায়। একটা সময় বসে দিন কাটাতে হতো, এখন অর্ডার ডেলিভারি করতে ব্যস্ত সময় পাড় করছে।
মৌলভীবাজার থেকে শখের বিক্রেতার উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌস রিপা কাজ করেন মনিপুরী শাড়ী নিয়ে। তাঁতীদের সম্পর্কে তিনি লিখেন, আমি নিজে মনিপুরী পল্লীতে গিয়ে শাড়ি আনি। নিজ চোখে দেখেছি তাদের ঘুরে দাড়ানো। এখন অগ্রীম পেমেন্ট করতে হয় আর আগে ফোন করে বলতো কবে শাড়ি লাগবে আপা?
জিয়া’স কালেকশনের উদ্যোক্তা শারমিন জিয়া কাজ করেন টাংগাইল থেকে। তিনি লিখেন, টাংগাইল শাড়ির তাঁতীরা করোনায় চাহিদা থাকা সত্ত্বেও উৎপাদনের জন্য চাহিদা মতো সরবরাহ করতে পারেনি। দেশি পণ্যের ই-কমার্সে টাংগাইল শাড়ির চাহিদা বেড়ে গেছে কয়েকগুন।
আরিয়া’স কালেকশনের স্বত্বাধিকারী নিগার ফাতেমা। মূলত কাজ করেন খেস শাড়ী নিয়ে। তিনি বলেন, খেস শাড়ী নিয়ে কাজ করায় এক বছরে খেশ শাড়ির প্রচার অনেক বেড়েছে। ক্রেতার চাহিদা পূরণ করতে খেশ শাড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁতিরা আগে সপ্তাহে অল্প সংখ্যক খেশ শাড়ী বানাতেন, এখন আগের তুলনায় কয়েকগুন শাড়ী তৈরি করতে হচ্ছে। তাই নতুন তাঁত চালু করা হয়েছে। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী খেশ শাড়ির পাশাপাশি খেশ ওড়না, খেশ গজ কাপড় তৈরি হচ্ছে। করোনাভাইরাসে যেখানে তাঁত শিল্প বন্ধ ছিল সেইখানে অনেক কারিগর খেশ শাড়ি তৈরিতে নিয়োগ হয়েছে। তাঁতীরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে এবং মনে সাহস জেগেছে৷ তাদের নিপুন দক্ষতার পণ্য এখন ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে।
আফসানা ভূইয়া নিপা বলেন, একটা সময় ছিলো যখন অনেক ইচ্ছে ছিল সিলেটি শাড়ি নিয়ে কাজ করবো। কিন্তু ঢাকায় থাকায় তাঁতিরা শাড়ী দিতে চাইতো না। বলতো আপা এই শাড়ির কদর আমাদের দেশের মানুষ দেয় না। এখন সময় বদলেছে। দেশি পণ্যের ই-কমার্সের কারণে চাহিদা গুলো বোঝাতে পারছি। আমাদের উপর বিশ্বাস এসেছে তাঁতীদের। কোন ভাবনা ছাড়া অগ্রীম টাকা দিতে ভয় করছে না, তাঁতীরাও আমাকে শাড়ী পাঠাতে দ্বিধা করছে না।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, আওয়ার শেরপুর।