একজন উদ্যোক্তাকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখা উচিৎ, নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নয়। কিন্তু এই মুহর্তে আমাদের দেশে নারী তথা নারী উদ্যোক্তা ও নারী পেশাজীবিরা পুরষদের মতো নির্বিঘ্নে কাজ করার সুযোগ পাননা। এটা সমাজের সমস্যা হোক, দেশের সমস্যা হোক- এটা একটা সমস্যা। নারীরা এমন কিছু সমস্যা মোকাবিলা করেন যেটা একই সমাজের একজন পুরুষকে মোকাবেলা করতে হয়না।
তেমন একজন নারী উদ্যোক্তার সফলতার গল্প এটি। তিনি হলেন একজন সংগ্রামী সফল নারী উদ্যোক্তা, ছালমা রহমান সুমি । জন্ম এবং বেড়ে ওঠা মিরপুরে। নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাপড় বানানো এবং ডিজাইন করা, ভালো ব্রান্ডের কোন পোশাক দেখলেই মনে মনে চিন্তা করা যে,এখানে কি কি কাজ করা হয়েছে, এর সাথে আর কি কি কাজ যোগ করতে পারি, কোন কাপড়ে কোন সুতো ভালো মানাবে এইগুলো নিয়ে ভাবতাম । তারপর নিজের মত করে তৈরি করতাম। সফল নারী উদ্যোক্তা ছালমা রহমান সুমি জানিয়েছেন, এই সফলতার পেছনে রয়েছে শ্রম ও আনন্দ সুখের অনেক কাব্য।
উদ্যোক্তা জীবনের শুরু দিকটা জানতে চাইলে তিনি জানান, উচ্চমাধ্যমিকের পরপরই বাবার পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে, বাবা আশ্বাস দিয়েছিল পড়াশোনা শেষ করার জন্য যথেষ্ট সাপোর্ট পাবে। আমার স্বামী বেশ ভালো একজন মানুষ, প্রাইভেট জবের পাশাপাশি একটা বিজনেস আছে তার।বিয়ের পর থেকেই তাঁর ইমপোর্ট-এক্সপোর্টৈর বিজনেসের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার আগ্রহ এর শেষ ছিল না, তার বিজনেসের প্রধান পণ্যই হচ্ছে কফি মেশিন এবং বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য, প্রায় ভাবতাম তার বিজনেসে যদি কোনভাবে আমার ডিজাইন করা কাপড় রাখা যেত, পরক্ষনেই হেসে ভাবতাম এ কেবল আমার স্বপ্ন যা সত্যি হবার না। বিবিএ প্রথম সেমিস্টারেই আমার বড় ছেলের জন্ম। পরের বছর আমার ছোট ছেলের জন্ম। শ্বশুরবাড়ি এবং সন্তানদের নিয়ে পড়াশোনা শেষ করা এক রকমের চ্যালেঞ্জিং ছিল। পড়াশোনা শেষ করার পরে, চাকরির জন্য বিভিন্ন পড়াশোনার পাশাপাশি ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (IsDB) থেকে আমি গ্রাফিক্স ডিজাইনিয়ে একটা স্কলারশিপ পেয়েছিলাম। প্রায় দেড় বছর আমার দুই সন্তানকে নিয়েই তাদের(IsDB) কঠিন নিয়ম কানুন এর মধ্য দিয়ে সফলভাবে কোর্সটি সম্পন্ন করেছিলাম। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোতে এপ্লিকেশন করা, ইন্টারভিউ দেয়া শুরু করে দিলাম, সেই সুবাদে খুব শীগ্রই আমি একটি চাকরিও পেয়ে গেলাম। যেমন চাকরি মনে মনে খুঁজছিলাম ঠিক যেন তেমন একটা চাকরি পেয়েছিলাম, হ্যান্ডসাম সেলারি সহ অফিসটা আমার বাসার কাছাকাছি ছিল, কিন্তু সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সন্তানদের রেখে চাকরি করাতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছিল আমাকে। দিন দিন ছেলের স্কুলের পারফরম্যান্স খারাপ হচ্ছিল, দুই সন্তানের কেমন যেন বদমেজাজি হয়ে উঠছিল। আর এসব নিয়ে প্রায়ই মনমালিন্য হতো স্বামীর সাথে, সে চাইতো না আমি যাতে চাকরিটা নিয়মিত করি।
অনেকটা হতাশার সাথেই আমি ফেব্রুয়ারীতে চাকরি ছেড়ে দেই। তখন থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো আমার ছোটবেলার স্বপ্ন ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে। ভেবে নিলাম আমাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে সন্তানদেরও পর্যাপ্ত সময় দিতে পারি এবং আমার স্বপ্নও পূরণ করতে পারি। সাত হাজার টাকার চারটি ট্রেডিশনাল কাতান শাড়ি নিয়ে শুরু করি উদ্যোক্তা জীবন, কিন্ত তেমন কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না আমার পেজে।
নিজস্ব আগ্রহ ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন ক্রেতাবলয়, অর্জন করেছেন আস্থা। শুরুটা স্বাভাবিকভাবেই মসৃণ না হলেও অল্পকিছু দিনে তাঁর পোশাকভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘সানসীন কজি’ পেরিয়েছে অনেক বন্ধুর পথ।
উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) কিভাবে আপনার উদ্যোগে ভূমিকা রেখেছে জানতে চাইলে সুমি বলেন, চলতি বছরের জুলাই মাসে এক বান্ধবীর মাধ্যমে পেলাম উইয়ের সন্ধান।নতুন এক আশা এবং অনুপ্রেরণার জায়গা হয়ে দাঁড়াল উই।কিছুদিনের মধ্যেই নিজেই বিজনেস এর লোগো, লিফলেট, ভিজিটিং কার্ড, প্যাকেজিং সব করে ফেললাম। দুই ছেলের নামের সাথে মিল রেখে বিজনেস এর নাম রাখলাম Sanseen COZY(সানসীন কজি)। আল্লাহর অশেষ কৃপায় এবং উইয়ের অবদানে এখন আমি আমার অর্ডার এর কাজ গুলো শেষ করতেই হিমশিম খাচ্ছি। আর এর জন্য উইয়ের পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ক্রেডিট এখানে রাজিব আহমেদ স্যারের। স্যারের Digital skill for Bangladesh(ডিএসবি) গ্রুপের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত শিখছি কিভাবে পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং কে আরো শক্তিশালী করা যায়। কিভাবে কাস্টমার খাতির এর মাধ্যমে রিভিউ এবং রিপিট কাস্টমার পাওয়া যায়। এককথা উদ্যোক্তা জীবনের এটুজেট শিখছি ভালোবাসার ডিএসবি গ্রুপে এসে, আমি উইয়ের প্রতি, রাজিব আহমেদ স্যারের প্রতি চির কৃতজ্ঞ। উইয়ে আমার পরিচয় কেবলমাত্র উদ্যোগতাই না, আমি এখানে একজন রেগুলার ক্রেতা। এক সময় আমরা যারা অনলাইনে কেনাকাটায় ঠকে যাবার ভয় পেতাম, আজকে উইয়ের কল্যাণে তারাই নিয়মিত অনলাইনে পণ্য ক্রয় বিক্রয় করছি। ইনশাল্লাহ খুব শীগ্রই এমন এক সময় আসবে যখন অনলাইন কেনাকাটার কথা মাথায় আসলেই উইয়ের কথা আগে মনে পড়বে সবার।
‘সানসীন কজি’-কে নিয়ে স্বপ্ন কি জানাতে চাইলে তিনি জানান, বিশ্বের সেরা দশটি পোশাক ব্র্যান্ডের মধ্যে আমি আমার সানসীন কজিকে দেখতে চাই। Sanseen COZY তে এখন তিনজন নিয়মিত কাজ করছে। তিনের এই সংখ্যাটা আমি শ, হাজার এবং লাখে নিয়ে যাব একদিন ইনশাল্লাহ। যারা আমার মতন সন্তানদের নিয়ে বাইরে কাজ করতে পারছে না তাদের অন্যতম আয়ের এর উৎস হয়ে উঠবে আমার এই উদ্যোগ। পরিশ্রম করে যেতে চাই। ভুল করতে আমি ভয় পাই না, আমার প্রতিটি ভুল থেকেই আমি শিক্ষা নিতে চাই এবং অভিজ্ঞতার ঝুলিকে আরো বরো করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।