সরকারি চাকুরিজীবী বাবা ও মায়ের একমাত্র মেয়ে নুযহাত ফায়যা আবীদার জন্ম ও বড় হওয়া চট্রগ্রামে। ফায়যা দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পেশায় একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবী ও চট্রগ্রামের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মির্জা আহমেদ ইস্পাহানি উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক হলেও উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন নিজেকে। ফায়যার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প নিয়ে টেকজুমের এবারের আয়োজন।
টেকজুমঃ উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু কিভাবে?
ফায়যা: ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের একটি স্বনামধন্য ইংরেজি মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসি। স্বাধীনভাবে কাজ করে মেধার ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পাচ্ছিলাম না, মানসিক তৃপ্তি ছিল না তাই। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে টিউশনের জমানো ‘দুই হাজার টাকা’ দিয়ে শুরু করি নিজের স্বাধীন পথচলা। দুই হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ‘ Faija’s Trendy Collection’ এর যাত্রা শুরু করি।
টেকজুমঃ ক্যারিয়ারে ই-কমার্স কেন বেছে নিলেন?
ফায়যা: ছোটবেলা থেকেই আমি একটু স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করি। নতুন নতুন কাজ করতে আমার সবসময় ভালো লাগে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভাবলে ই-কমার্স এখনো খুব বেশি জনপ্রিয় হয়নি আর সাধারণ মানুষ ই-কমার্স নিয়ে খুব একটা বেশি সচেতন না। আমরা এখনো ই-কমার্স বলতে বুঝি কেউ দোকান খুলে বসবে অনলাইনে আর দোকানদারের সাথে দামাদামি করে কেনাকাটা করা যাবে। আবার অনলাইন বলেই ডেলিভারি চার্জ দেওয়ার দরকার নাই কারন দোকান থেকে নিলেতো চার্জ দিতে হয় না। তবে দোকানে কিনতে গেলে যে গাড়িভাড়া বহন করতে হবে এটা কারো মনেই থাকে না। এইরকম অনেক সমস্যার সমাধান নিয়েই একজন উদ্যোক্তাদের পথচলা। আর তাই, স্বাধীন ও সৃজনশীল ক্যারিয়ারের জন্য বেছে নিলাম ই-কমার্স বিজনেস। যদিও পথটা সহজ ছিল না তবুও শুরু যখন হয়েছে গন্তব্যে ঠিক পৌঁছে যাবো ইনশাআল্লাহ।
টেকজুমঃ ‘ Faija’s Trendy Collection’-কে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখেন?
ফায়যা: ‘ Faija’s Trendy Collection’ আমার কাছে আমার নিজের সন্তানতুল্য, আমার স্বপ্নের জায়গা। আর এই স্বপ্নটা আমি সবসময় বাস্তবে দেখেছি। হয়তো আমার স্বপ্নের কথা গুলো শুনলে অনেকেই হাসবেন, ঠিক যেমন বছর খানেক আগেও মানুষ হাসাহাসি করেছে। কিন্তু আজ কিছু একটা করতে পেরেছি বলেই কিন্তু আপনারা ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। মাত্র দুই হাজার টাকা দিয়ে শুরু হয়েছিল ব্যবসা, এইটাকে হাজার কোটি টাকার বিজনেসে পরিণত করতে চাই আবার একি সাথে কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই এটাই আমার লক্ষ্য। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের কাঠের ও মেটালের গয়না দিয়ে একচেটিয়া কাজ করে চাহিদা ও বাজার দুটোই নষ্ট করে দিচ্ছে। যেহেতু আমি হাতে তৈরি কাঠের ও মেটালের গয়না নিয়ে কাজ করছি তাই আমি এই জায়গাটাতেই কাজ করতে চাই, যেন কাঠের গয়না নিয়ে কাজ করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সবাই কিছু রোজগার করতে পারে, পেটের দায়ে যেন অন্যের দ্বারস্থ হতে না হয়।
টেকজুমঃ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন?
ফায়যা: নারী উদ্যোক্তা হিসেবে যত চ্যালেঞ্জ তা তো দু চার লাইনে প্রকাশ করা সম্ভব না। তবে আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী আমার পরিবার আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্ট। অনেক মেয়ের বিয়ের পর কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ে সেদিক দিয়ে ও আমি সৌভাগ্যবতী কারন আমার স্বামী সানি আমার এই পথচলার সঙ্গী ও পথপ্রদর্শক হয়ে আমাকে সহযোগিতা করছেন। তবে অন্য আর দশজন নারীর মত আমাকেও সামাজিক বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছে, মেয়ে তাই অনেক ভাবেই আমাকে বাধা দেয়া হয়েছে আবার ঠকানোর চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি। আবার অনেকেই টিপ্পনি কাটতো এতো শিক্ষিত, অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের মেয়ে তাও কেন ব্যবসা করতে হবে। তবে এইটা আমার জন্য পজিটিভ চ্যালেন্জ্ঞ ছিল। তারা বাধা না দিলে হয়তো এতটা পথ আসতে পারতাম না। একটা ধন্যবাদ দিতে চাই তাদের সকলকে। আমি কৃতজ্ঞ সে সকল মানুষের প্রতি যারা আমাকে একদিন না বলেছিলেন,মেয়ে বলে অবহেলা করেছিলেন।
তাদের জন্যই আমার আজকের আমি হয়ে ওঠা।
টেকজুমঃ উইমেন এন্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) কিভাবে আপনার উদ্যোগে ভূমিকা রেখেছে?
ফায়যা: আমি যখন উইর সাথে যুক্ত হই, তখন ছিলাম ডানা ভাঙ্গা আহত ছোট্ট পাখির মত। তারপর আস্তে আস্তে সেবা যত্নে উই আমাকে বড় করলো এবং আমি এখন পরিপক্ক হয়ে উড়তে পারি, ই-কমার্সের বিশাল আকাশে। রাজিব স্যার আমার জীবনে এমন একজন মানুষ যিনি শিখিয়েছেন কিভাবে আছাড় খেয়ে উঠে দাড়াতে হয়, কিভাবে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, কিভাবে স্বপ্ন দেখে সেই পথে এগিয়ে যেতে হয়, কি ভাবে টিকে থাকার লড়াই করতে হয় এবং কিভাবে বাঁচতে হয়। আমরা যারা কেবল শিখছি তাদের আসলেই অনেক কিছু অজানা থাকে যার জন্য আমাদের ঠকানো সহজ হয় কিন্তু এখন উই আমাদের পাশে আছে বিনা টাকায়, আমাদের এতো কিছু শিখিয়ে দিয়েছে যে আমরা এখন প্রচণ্ড রকমের আত্মবিশ্বাসী। এই করোনার মধ্যে যখন সব বন্ধ তখন ‘উই’ ছিল বলে আমার বিক্রি হয়েছে, শুধু তাই নয় এই করোনা পরিস্থিতিতেও দেশের বাইরে কলকাতা ও সিঙ্গাপুর থেকে বেশ কিছু গয়নার অর্ডার পেয়ে সেগুলো ডেলিভারি করতে হয়েছে। করোনার ঠিক মাঝামাঝি সময়ে কঠিন ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি কিন্তু কেনাকাটার জন্য ‘উই’ থেকে কাস্টমার আসা শুরু করায় আবার সব কষ্ট উপেক্ষা করে খাতা কলম নিয়ে বসে গেলাম অর্ডার নিতে, বিদেশের মাটিতে হাতে তৈরি দেশীয় গয়না পৌঁছে গেছে এসব ‘উই’ না থাকলে কখনোই সম্ভব হতো না। এখন আপনি ভাবেন, উই আমার জীবনে, আমার উদ্যোগে কত বড় ভূমিকা রেখেছে।
টেকজুমঃ ধন্যবাদ, ফায়যা টেকজুমকে সময় দেওয়ার জন্য।
ফায়যা: অসংখ্য ধন্যবাদ টেকজুমকে।