দেশে একটি বিশাল বেকার জনগোষ্ঠী তৈরি হওয়ার পেছনে মূল কারণগুলোর একটি হলো উদ্যোক্তার অভাব। এই অভাবটি মূলত সৃষ্টি হয়েছে উদ্যোক্তা হিসেবে সফল হতে না পারার ভীতির কারণে।
ইন্টারমিডিয়েট এর পর থেকেই নিজে কিছু করার স্বপ্ন এবং নিজের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা ছিল তার। মাত্র কিছু টাকা পুঁজি দিয়ে শুরু করেন এই নারী। তবে এটা যতটা সহজ মনে হচ্ছে, ততটাই কঠিন ছিল তার জন্য । স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় কাজ শুরু করলেও সঠিক দিক নির্দেশনা না থাকার কারনে বিফল হন। নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চাইলে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল হওয়া খুবই জরুরি। তাহলেই আপনার কাজে সুশৃঙ্খলা থাকবে। পেশাগত এবং ব্যক্তিগত উভয় জায়গায় সময় নষ্টের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত বলে মনে করেন জান্নাত টি ভ্যালি এর ত্বাধিকারী ও তরুণ উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌস নিপা ।
টেকজুমঃ উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ শুরু কিভাবে?
নিপা :মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তার বাবা এবং গৃহীনি মায়ের মেঝ সন্তান আমি। ইন্টারমিডিয়েট এর পর থেকেই নিজে কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম। আমার পরিচয়ে আমি পরিচিত হবো এটা ভাবতেই ভালো লাগতো। স্টুডেন্ট থাকা অবস্থায় কিছু পন্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম কিন্তুু সঠিক দিক নির্দেশনা না থাকার কারনে বিফল হয়েছি। ২০১৯ সালের অক্টোবরে WE group এ জয়েন করার পর অনেক নারী উদ্যোক্তাদের সংগ্রাম আর সফলতার কথাগুলো শুনতাম এবং আমার অফলাইনে ধীর গতিতে শুরু হওয়া উদ্যোগটাকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করি এবং অফিসিয়ালি ২০২০ সালে আমি আমার চা এর রাজ্য Jannat Tea Valley কে নিয়ে যাএা শুরু করি।তবে করনার জন্য লগডাউনে ৩ মাস বাসায় বসা ছিলাম তখন আমি চা পাতা নিয়ে অনেক জানার চেষ্টা করি একদম পুরো সময়টা উদ্যোগটাকে গোছানোর কাজে লাগাই। চা পাতা বিশেষ করে গ্রীন টি নিয়ে কন্টেন্ট লিখার কারনে অনেকের ভিতরেই আমার পন্যের প্রতি আগ্রহ তৈরী হয়। তখন গ্রীন টির প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায় করনার কারনে। আমি তখন পুরো ঢাকাতে গ্রীন টি ডেলিভারি দিতে চেষ্টা করেছি। এক কথায় যদি বলি তাহলে কাস্টোমারের চাহিদার উপর ভিত্তি করেই আমার উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করা এবং আমার উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা।আর গ্রীন টি আমি এত রকমের ফ্লেবার টেষ্ট করেছি যে এটা আমার প্যাশন হয়ে গিয়েছিলো।
টেকজুমঃক্যারিয়ারে ই- কমার্স কেন বেছে নিলেন?
নিপা : বর্তমান যুগটাই হলো প্রযুক্তি নির্ভর। মোবাইলটা হাতে নিলেই পৃথিবীর অন্য প্রান্তের খবর চলে আসে নিমেষেই ।আর একজন উদ্যোক্তার জন্য সবচাইতে বেশি দরকার নেটওয়ার্কিং এবং ই-কমার্স প্লাটফর্ম এ সেটা খুব সহজেই তৈরী করা যায়।ই-কমার্স এ কাজ করার সুবিধা হলো বিনা খরচে শুধু মাএ একটা প্রোফাইল কে কাজে লাগিয়ে সারা বিশ্বে পন্যের মার্কেটিং করা যায়। আমাদের দেশের চা পাতার কোয়ালিটি নিয়ে যখন আমি কন্টেন্ট লিখবো তখন সেটা দেশে- বিদেশে সব যায়গাতে ছড়িয়ে যাবে। একটা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরী হবে, বিশাল কাস্টোমার ডাটাবেইজ তৈরী হয়ে যাবে। অল্প সময়ে এত মানুষের কাছে নিজের পন্যকে তুলে ধরার এর চাইতে উত্তম মাধ্যম আর হতেই পারেনা। তাই আমিও এই অনলাইন প্লাটফর্ম টাকে কাজে লাগিয়ে আমার উদ্যোগ Jannat Tea Valley কে সবার কাছে তুলে ধরতে চেয়েছি তাই ই- কমার্স এ কাজ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠা।এছাড়াও ইনভেস্টরস দের কাছেও ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে পন্যকে সুন্দর করে তুলে ধরা যায় ই- কমার্স এর মাধ্যমে।
টেকজুমঃ কি কি পন্য বিক্রি করেন ?
নিপা : আমি মূলত চা নিয়ে কাজ করতেই ভালোবাসি। আর Orthodox চা পাতার প্রতি আমার একটা প্যাশন কাজ করে তাই Black tea Gold, Raw Green tea, Oolong green tea, Rose tea, white tea, windy green tea,Tulsi green tea, Masala tea সহ আরো অনেক ধরনের চা পাতা নিয়েই আমার উদ্যোগ। আমার সিগনেচার প্রডাক্ট হলো Gaba green tea আমি নাম দিয়েছি ব্রেইন বুষ্টিং টি । জাপানে এই gaba tea অনেক জনপ্রিয় কারন Gaba উপাদানটি আমাদের ব্রেইন এর জন্য অনেক উপকারী। আনন্দের বিষয় হচ্ছে এই চা এখন আমাদের দেশেই তৈরী হচ্ছে। এই চা পাতার আমি ব্যাপক সারা পেয়েছি।চা পাতা নিয়ে কাজ করতেই আনন্দ পাই তাই অন্য কোন পন্যে আপাতত ফোকাস করতে চাচ্ছিনা।
টেকজুমঃ Jannat Tea Valley কে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখেন?
নিপা : চা একটি Royal product তাই এই পন্যের প্রতি ভালোবাসা থেকে কাজ শুরু করি।আমি সবাইকে গ্রীন টি সম্পর্কে জানাতে চাই যেন হেলদি পানীয় পান করার আগ্রহ তৈরী হয়। আমাদের দেশেও এত রকমের চা পাতা উৎপাদন করা হয় সেটা অনেকে জানেনই না। আমি তাদের কাছে তুলে ধরতে চাই এর গুনাগুন।আমাদের শরীরের ইম্যিউনিটি সিস্টেম উন্নত করন এবং ত্বক,চুল,ব্রেইন বুষ্ট আপ করা,ডায়বেটিকস রোগি,স্থুলতা হ্রাসকরন, হাই প্রেসার কমানো সহ অনেক উপকারী ভুমিকা রয়েছে এই গ্রীন টির ভিতরে কিন্তুু সঠিক প্রচারনার অভাবে এই পন্য নিয়ে সবার ধারনা কম তাই আমি এমন ভাবে কাজ করতে চাই যেন সবাই হেলদি পানীয়টি সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এছাড়াও স্বপ্ন দেখি একদিন Jannat Tea Valley একটি গুনগত মানসম্পন্ন চা পাতার ব্রান্ড হবে।ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে আমার একটি শপ থাকবে যেখানে ২০০ টির মতো চা পাতার ফ্লেবার সংগ্রহে রাখা হবে। দেশের বাইরেও রপ্তানি করার স্বপ্ন দেখি । আমার উদ্যোগে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে সে লক্ষ্যে পরিকল্পনা করে এগোচ্ছি।
টেকজুমঃ নতুনদের জন্য কিছু বলুন:
নিপা : ব্যবসায়ের প্রতিটি অংশ বোঝার চেষ্টা করে দেখুন—সফল উদ্যোক্তারা একটা কথা খুব বলেন তা হলো যে জিনিসটি নিয়ে ব্যবসায় নামছেন পুরোপুরি সেটি সম্পর্কে জানতে হবে। এটি কীভাবে তৈরি হয়, কী কী কাজে লাগে। অন্যকে দিয়ে তৈরি করে বা অন্যের জ্ঞান নিয়ে সফলতা আসার সম্ভাবনা খুব কম। একক উদ্যোক্তার জন্য অনেক কাজ আছে, তার মানে এই নয় যখন আপনার ব্যবসা বৃদ্ধি পায়, কর্মচারী থাকে, তখন এই দায়িত্ব কতটা কঠিন ছিল তা আপনি ভুলে যাবেন। প্রত্যেকের কাজের জন্য আপনার উপলব্ধি থাকতে হবে। অহংকার এড়িয়ে চলতে হবে। আপনার ব্যবসায়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনার হাত থাকতে হবে। আপনার কর্মীদের কাজের ধরন কী তা দেখার জন্য বিভিন্ন ভূমিকাতে তাদের পাশাপাশি কাজ করতে হবে। যা আপনাকে বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা রাখতে সহায়তা করবে এবং একটি দল হিসাবে সহযোগিতা এবং বন্ধনের সুযোগ তৈরি করবে।
টেকজুমঃ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কি কি চ্যালেন্জ মোকাবেলা করেছি?
নিপা : নারীদের জন্য পুরো জীবনটাই একটা চ্যালেন্জ। আমি বর্তমানে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে সিনিয়র পজিশনে কর্মরত আছি। এখানে ও অনেক ধরনের বাধা – বিপত্তি পাড় হতে হয় আমাদের। ঠিক তেমন প্রথম যখন চা পাতা নিয়ে কাজ শুরু করি অনেকেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিলো এবং বলতো – “এই আপনি চা ব্যাচেন ” এই যে নেগেটিভ কনসেপ্ট আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে এটাই নারীদের সবচাইতে বড় বাধা।
তবে পারিবারিক ভাবে আমার সবচাইতে বড় সাপোর্টার আমার মা এবং আমার হাসবেন্ড। যারা না থাকলে আমি হয়তো কিছুই করতে পারতাম না।এমনকি আমার শশুরবাড়ীর মানুষ ও অনেক পজেটিভলি নিয়েছে বিষয়টি। তবে আমি মনে করি পারিবারিক সাপোর্ট যদি একজন নারী পায় তাহলে সামাজিক বাধা গুলো অতিক্রম করা কোন বিষয় না।আমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস আছে যে সামনে আরো বড় কোন বাধা এলেও আমি সেটা মোকাবিলা করতে পারবো। ইনশাআল্লাহ।
টেকজুমঃ উইমেন এন্ড ই- কমার্স ফোরাম ( উই) কিভাবে আপনার উদ্যোগে ভূমিকা রেখেছে?
নিপা : আমার উদ্যোক্তা হবার জার্নিটা নতুন করে ডানা মেলেছে WE Group এর মাধ্যমে।উই এর সম্মানিত উপদেষ্টা রাজিব আহমেদ স্যারের অনুপ্রেরণামূলক পোষ্ট এবং সময়োপযোগী পরামর্শ গুলো আমাকে সবসময়ই অনুপ্রানীত করতো। কিভাবে একজন নারী তার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে একটা উদ্যোগ শুরু করতে পারে, পন্যের সোর্সিং, কোয়ালিটি, প্রাইসিং, মার্কেটিং এন্ড সেলস পলিসি, কাস্টোমার সার্ভিস এবং সব চাইতে বড় হলো নিজের পন্য সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা এসবের একদম ক্লিয়ার আইডিয়া পাওয়া যায় উই গ্রুপের পোষ্টগুলোতে। যারা একদমই নতুন কোন উদ্যোগ নিয়ে শুরু করতে চায় আমি তাদেরকে বলবো মিনিমাম ১০০ দিন উই গ্রুপের পোষ্ট গুলো পড়তে। এতে করে তার জার্নিটা অনেক সুন্দর ধারনা নিয়ে শুরু
এতে করে তার জার্নিটা অনেক সুন্দর নিয়ে শুরু করতে পারবো।উই গ্রুপের মাধ্যমেই আমি পার্সোনাল ব্রান্ডিং এর বিষয়টা জানতে পারি এখন অনেকেই আমাকে Jannat Tea Valleyর নামে চেনে। একটা বিশাল নেটওয়ার্ক আমি না চাইতেই এখানে পেয়ে গিয়েছি যা আমাকে নতুন করে মনোবল যোগায় । কোন একটা পন্য নিয়ে কাজ শুরু করলেই সফল হওয়া যায়না যদি প্রোপার গাইডলাইন না থাকে। আমি গাইডলাইন পেয়েছি উই থেকে।এবং ই- কমার্স এ কাজ করতে গেলে বেসিক যেসব আইটি নলেজ থাকা দরকার সেটাও এখান থেকে শেখা আমার।
উই গ্রুপ আমাদের মতো নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অনেকগুলো সরকারি ফ্রি ট্রেইনিং এর ব্যবস্থাও করে দিয়েছে এবং প্রতিমাসে ১ টি করে আন্তর্জাতিক মানের ট্রেইনার দিয়ে মাস্টারক্লাস করিয়ে থাকে যা একজন উদ্যোক্তার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি নিজে অনেক আইডিয়া নিয়ে কাজ করেছি এই ট্রেনিং গুলো করার মাধ্যমে।এবং দক্ষ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বিশ্বের কাছে আমাদের তুলে ধরা হচ্ছে।
আমি মনে প্রানে বিশ্বাস করি এবার ও যদি উই গ্রুপের মাধ্যমে সঠিক দিকনির্দেশনা না পেতাম তাহলে আবার ও আমি বিফল ও হতাশ হয়ে পরতাম।আমার উদ্যোক্তা জীবনের জার্নিটা উই এর সাথে শুরু হওয়ার কারনে আজ আমি অনেক মানুষের কাছে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছি। আমার উদ্যোগের নামে সবাই আমাকে চিনতে পারছে। উই এর প্রতিষ্ঠাতা নিশা আপুকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এমন একটা প্লাটফর্ম তৈরী করার জন্য।
Digital skills for Bangladesh (DSB) এর মাধ্যমে আমি ই- কমার্স এর খুটিনাটি সব বিষয় গুলো নিয়ে জানতে পারছি। পডকাষ্ট,কন্টেন্ট রাইটিং, ব্লগ, ওয়েবসাইট, স্টোরি টেলিং এমন বিষয় গুলো একজন উদ্যোক্তার জার্নিটাকে আরো সহজ করে দেয়। গ্রুপের ১০ মিনিট রাইটিং পোষ্ট লিখার মাধ্যমে খুব দ্রুত লিখা ও পড়ার গতি বৃদ্ধি পায়। এবং একজন উদ্যোক্তার সবচাইতে বড় গুন থাকা উচিত নিজের মতো করে লিখতে পারার দক্ষতা, সেটা আমি এই গ্রুপ থেকে শিখতে পেরেছি। ই-কমার্স বিজনেস এ যদি কেউ দীর্ঘমেয়াদি বিজনেস করতে চান তবে তাদেরকে অবশ্যই DSB পোস্ট পড়ে বেসিক নলেজগুলো শিখে নেয়া দরকার। আমি ব্যক্তিগত ভাবে আমার উদ্যোগে এই গ্রুপ থেকে শেখা আইডিয়াগুলো কাজে লাগিয়ে ভালো উপকার পাচ্ছি। তাই আমার উদ্যোগে আমি DSB group কে সবসময়ই প্রাধান্য দিয়েছি।এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা রাজিব আহমেদ স্যার আমাদের কে প্রতিনিয়ত দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন কিভাবে আমরা কাস্টেমারদের সাথে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী করে আমাদের উদ্যোগ কে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। স্যার কে ধন্যবাদ জানাই ই- কমার্স ভিত্তিক এমন একটা প্লাটফর্ম তৈরী করার জন্য। অনেক গ্রামীন অন্চলের উদ্যোক্তারা এখান থেকে একদৃ ফ্রিতে সবকিছু শিখতে পারে। এই টপিকসগুলো নিয়ে যদি ট্রেনিং করতে যেতাম তাহলে অনেক টাকা লেগে যেত যা খুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য খুবই কষ্টকর হতো। আসলে প্রযুক্তি এখন সবার হাতে হাতে কিন্তুু সঠিক ভাবে সেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে চাই প্রোপার গাইডলাইন এবং বেসিক দক্ষতা। যা DSB থেকে আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি।