প্রতি বছরের জুন মাসের ৩০ তারিখ শেষ মানেই আয়কর রিটার্ন দাখিল নিয়ে প্রস্তুতি শুরু। ব্যবসায়ী বা পেশাজীবী মানুষগণ যদি প্রথম থেকে নিজেদের কর্মক্ষেত্রের আয় ব্যয়ের হিসাব রাখেন তবে রিটার্ন দাখিল সহজ হয়। আয় ব্যয়ের খাত বুঝলে অনেকের ক্ষেত্রে নিজে নিজে রিটার্ন ফরম পূরণ করা সহজ হয়। যারা আইনজীবী বা পেশাজীবীর সহায়তায় রিটার্ন দাখিল করেন তাদেরও কোন কোন খাত আয়ের হিসাব থেকে বাদ যাবে জানা জরুরী।
অনেকেই ধরে নেয় যে পুরো আয়ের অঙ্কের উপর কর দিতে হবে এবং অনীহা বোধ করেন। ক্ষুদ্র বা মাইক্রো ব্যবসায়ীগণ অনেক ক্ষেত্রে আয়করকে ভয় পান। অথচ আয়কর মোটেও জটিল কোন বিষয় নয় এবং আমাদের আয়ের কেবল ক্ষুদ্র একটি অংশ আমরা রাষ্ট্রকে সুন্দরভাবে পরিচালনায় সহায়তা করতে দিয়ে থাকি। আমরা যত তথ্য জানবো তত আমাদের কাছে এটি সহজ হবে।
ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীর বাদযোগ্য ব্যয়ের খাত :
একজন পেশাজীবী বা ব্যবসায়ী তার গ্রস প্রাপ্তি বা বিক্রয় হতে ব্যবসা বা পেশা সংশ্লিষ্ট সকল খরচ বাদ দিয়ে নীট আয় নির্নয় করবেন।
গ্রস প্রাপ্তি বা গ্রস মুনাফা বের করতে একজন ব্যবসায়ী বা পেশাজীবী যে সকল খরচ বাদ দিবেন:
পন্যের পাইকারী ও খুচরা বিক্রয়কারী ব্যবসায়ীগন আয়কর বর্ষে বিক্রিত মালামাল ক্রয়ের খরচ বাদ দিবেন। অর্থাৎ কেউ যদি ২০১৯ এর ১ লা জুলাই থেকে ২০২০ এর ৩০ শে জুন পর্যন্ত ৩০ লক্ষ টাকার পন্য বিক্রি করেন তাহলে ঐ পরিমান পন্য ক্রয় করতে তার কত টাকা খরচ হয়েছে তা বাদ দিলে গ্রস মুনাফা আসবে। ধরে নেই শিলা একজন শাড়ী ব্যবসায়ী। তিনি ১লা জুলাই ২০১৯ থেকে ৩০ শে জুন ২০২০ পর্যন্ত ১২ বার পাইকারী দোকানে গিয়েছেন তাই শাড়ী কিনতে তার এই খরচ, শাড়ীর ক্রয়মূল্য, এই শাড়ী আনতে যদি আলাদা ডেলিভারি খরচ লাগে তবে সেগুলো যোগ করতে হবে।
আবার কেউ যদি শাড়ী নিজেরা কারিগর দিয়ে তৈরী করেন তাহলে বিক্রিত শাড়ীগুলো তৈরী করতে সমস্ত খরচ বাদ দিতে হবে। যেমন ধরে নেই শিলা ব্লক ও বাটিকের শাড়ী বিক্রি করে। একটি কর বছরে সে ৫০০ শাড়ী ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। ৫০০ শাড়ী ক্রয়ের মূল্য, ডিজাইন বাবদ খরচ, কারিগর খরচ, শাড়ী প্রস্তুত করতে ভাড়া বাবদ খরচ শাড়ী প্রস্তুতের সব খরচ থাকতে হবে। ধরে নিলাম প্রতিটা ব্লক শাড়ী তৈরী করতে তার ৭০০ টাকা খরচ পড়েছে। এক্ষেত্রে ৫০০ শাড়ীর ক্রয়মূল্য বা উৎপাদন মূল্য হবে ৩৫০০০০ টাকা। তাহলে গ্রস মুনাফা ৪ লক্ষ টাকা।
সরাসরি বিক্রিত মূল্যের ক্রয় বা উৎপাদন খরচ বাদ দেবার পর ব্যবসা সংশ্লিষ্ট সকল খরচ বা দিবেন। আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ এর ধারা ২৯ অনুমোদিত বাদযোগ্য খরচ সম্পর্কে বলা আছে।
বাড়ীভাড়া:
ব্যবসা বা পেশা পরিচালনার জন্য বাড়িভাড়া প্রদত্ত হলে তা বাদযোগ্য হবে। তবে উদ্যোগতা যদি বাড়ীর মালিক হন তবে ভাড়া বাদ যাবে না। করদাতা যদি আংশিক আবাস ও আংশিক ব্যবসায় বা পেশার কাজে ব্যবহার করেন তাহলে যে ভাড়া দিবেন তা হতে অনুপাতিক হারে বাদ যাবে। যেমন যদি ধরে নেই শিলা ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন এবং একটি রুম ব্যবসার কাজে ব্যবহার করেন। সেক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে তিনি ঐ একরুমের ভাড়া তার গ্রস মুনাফা থেকে বাদ দিবেন। যেমন তিনি যদি ৫০০০ মাসিক টাকা ভাড়া ধরেন তবে ৬০০০০ টাকা গ্রস মুনাফা থেকে বাদ যাবে।
বাড়ী মেরামত খরচ:
ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত বাড়ির মেরামত খরচ যদি ভাড়াটে বহন করে তবে তা বাদ যাবে।
অবচয় খরচ:
বাড়ি, যন্ত্রপাতি আসবাবপত্রের ক্ষয়ক্ষতির জন্য তৃতীয় তফসিলে বর্নিত অবচয় বাদযোগ্য খরচ। তৃতীয় তফসিলের ৩ নং অনুবিধিতে বিভিন্ন সম্পত্তির স্বাভাবিক অবচয়ের হার বর্ননা করা হয়েছে।যেমন: যন্ত্রপাতির জন্য ১০% হার ধরা হয়েছে। সম্পত্তি যদি সংশ্লিষ্ট আয় বছরে হস্তান্তর করে তবে ঐ সম্পত্তির কোন অবচয় বাদ যাবে না।
ঋণকৃত মূলধনের সুদ:
ব্যবসায় পরিচালনার জন্য হাওলাতী মূলধনের উপর প্রদত্ত সুদ বাদযোগ্য হবে। তবে ঋণের অংশবিশেষ অকরযোগ্য ব্যবসায়ে নিয়োজিত হলে ঐ অংশের সুদ বাদ যাবে না
অংশীদারিত্বে তহবিল ব। লাভলোকসান হিসেবে জমাকৃত অর্থ:
ইসলামী নীতি দ্বারা পরিচালিত কোন ব্যাংকের সাথে কোন ব্যক্তির লাভ-ক্ষতির অংশের হিসাব থাকলে অথবা উক্ত ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে সেই ব্যক্তিকে ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত লভ্যাংশ বা অর্থ প্রদান করলে তা বাদযোগ্য হবে।
চলতি মেরামত খরচ:
যন্ত্রপাতি ব্যবহার উপযোগী রাখতে মেরামতের প্রয়োজন হলে, যেমন মোবাইল, ল্যাপটপ যদি সার্ভিসিং করানো হয়, অন্যান্য যন্ত্রপাতিও যদি মেরামত করা হয় তার খরচ বাদ যাবে।
জমির খাজানা, কর:
ব্যবসা বা পেশায় ব্যবহৃত বাড়ি বা জমির খাজনা, স্থানীয় কর বাদযোগ্য কর।
কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ ব্যয়:
রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে ব্যয় করলে বাদযোগ্য হবে।
ব্যবসার জন্য বিবিধ খরচ:
বিজ্ঞাপন খরচ, অডিটের করচ,আইন সংক্রান্ত খরচ, ব্যবসার প্রয়োজনে যাতায়ত ও ভ্রমন খরচ, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উপহার বাবদ খরচ, ডাক, তার ও টেলিফোন খরচ, কোন জরিমানা ইত্যাদি। মূলধনী ও ব্যক্তিগত খরচ বাদযোগ্য হবে না।
ট্রেডলাইসেন্স সহ অন্যান্য কাগজপত্র তৈরীর খরচ:
ব্যবসা পরিচালনায় চুক্তি তৈরীর কাগজ, ট্রেডলাইসেন্স তৈরী, নবায়ন, ট্রেড মার্ক তৈরী, নবায়ন। কর্মচারীদের উপকারের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল করা হলে এবং যদি অর্থ উপার্জনের লক্ষ না থাকে তবে তা বাদযোগ্য খরচ।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা:
বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য যদি খরচ হয় তবে তা বাদ যাবে।
ব্যাংকের অনাদায়ী দেনার জন্য:
পল্লী এলাকায় কৃষিঋণের জন্য দেড় শতাংশ বা প্রকৃত ঋণ এর মধ্যে যেটি কম এবং বাংলাদেশ কৃষিব্যাংকসহ সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ ও অনাদায়ী ঋণের চার শতাংশ বা প্রকৃত সঞ্চিতি এর মধ্যে যেটি কম।
অনাদয়ী ও অনিশ্চিত পাওনা:
ব্যবসা বা পেশা পরিচালনায় কোন অনাদায়ী এবং অনিশ্চিত পাওনা থাকলে অথবা ব্যাংকিং বা লগ্নি ব্যবসায় কোন ঋণ অনাদায়ী হলে তা শর্তসাপেক্ষে ব্যয়যোগ্য হবে।
এভাবে ব্যবসায়ের সংশ্লিষ্ট বছরের আয় হতে প্রথমে গ্রস আয় বের করতে হবে। তারপর গ্রস আয় হতে বাদযোগ্য ব্যবসা সংশ্লিষ্ট খরচ বাদ দিয়ে নীট আয় বের করতে হবে। নীট আয়ের পরই করদাতা কর দিবেন।
লিখনীটি সাধারন জ্ঞানার্থে প্রকাশিত, বিস্তারিত তথ্য জানতে আইনজীবী বা পরামর্শকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
লেখক: ব্যারিস্টার রহিমা হক
প্রতিষ্ঠাতা, আইন সেবা।