বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মানুষগুলোর কথা আমরা যখন ভাবি তখন আমাদের মনে হয় যে তাদের মতো হতে গেলে আমাদের হয়তো অনেক কিছুই করতে হবে।
হয়তোবা অনেক টাকা পয়সা লাগবে অথবা চমৎকার একটা ইউনিক আইডিয়া লাগবে অথবা প্রচুর পরিমাণে পরিশ্রম করতে হবে। ইন্টারপ্রেনিয়ার হওয়া কি এতটাই সহজ?
কিন্তু ডেভিড জেসনের ওয়ার্ক বইতে লেখক এই কথাগুলোর ঠিক উল্টো কথা বলছেন। তার আগে বলে নেই যে লেখক অনেক বছর ধরে একটি বড় সফটওয়্যার কোম্পানি চালাচ্ছেন যেখানে শত শত লোক কাজ করে যাচ্ছে। তার মতে নতুন কোন ব্যবসা শুরু করতে গেলে এসব কোনো কিছুরই দরকার হয় না। আসলে সমস্যাটা আমাদের অন্য জায়গায়। আমরা যখন ঐ নতুন কোন ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবি তখনই আমরা আমাদের এই ব্যবসাকে তুলনা করতে শুরু করি বিল গেটস বা ল্যারি পেজ এর ব্যবসার সাথে। আর ঠিক তখনই আমাদের মাঝে ভয় বা হতাশা কাজ করতে শুরু করে।
লেখক এর মতে আমাদের আসলে বিষয়গুলোকে এত বড় পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে না ভেবে প্রথমত এটা কে আমাদের সাইট ইনকাম হিসেবে ভাবা উচিত। যে কাজগুলো আমরা আমাদের লেখাপড়া বা চাকরির পাশাপাশি করে অতিরিক্ত কিছু উপার্জন করতে পারি। আর আমাদের ব্যবসার আইডিয়াটি হতে হবে প্রফিটেবল এবং সাসটেইনেবল।
লেখক বইটিতে তার বহু বছরের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নতুন স্টার্টআপে কিভাবে সফল হওয়া যায় সেই মূলনীতিগুলো খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। আমি এই বিষয়গুলোকে দুইটি বাক্যের মাধ্যমে বলছি।
এই দুইটি বাক্যের মধ্যে আমি আপনাদেরকে কার্যকরী চারটি মূলনীতি ইতোমধ্যে বলে ফেলেছি। তো চলুন সেগুলো ব্যাখ্যা করা যাক।
১। scratch the itch
বিষয়টা আমি আপনাদেরকে একটি সত্য ঘটনার মাধ্যমে বলছি। ভিক ফির্থ , যিনি আমেরিকার একটি বড় ব্যান্ডের ড্রাম বাজাতেন। তিনি অনেক ভালো ড্রাম বাজাতেন। কিন্তু তিনি তার নিজের কাজে সন্তুষ্ট ছিলেন না, খুব হতাশায় ভুগতেন। এর কারণ ছিল, তিনি যে দুইটি স্টিক ড্রাম বাজানোর কাজে ব্যবহার করতেন সেই স্টিক দুইটি ভর বা সাইজে যে একটা আরেকটা থেকে অনেকটা ভিন্ন ছিল। আর আকার আকৃতি বা ভরের এই পার্থক্যের কারণে ড্রাম থেকে যে আওয়াজ বের হচ্ছিল তার পিস লেভেলে অনেকটা পার্থক্য তিনি উপলব্ধি করেছিলেন।
তখন তিনি হতাশা থেকে বের হওয়ার জন্য রিসার্চ করতে শুরু করলেন। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে তিনি ঠিক একই সাইজের এবং একই রকম ভরের দুইটা স্টিক বানিয়ে ফেললেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত তার কোম্পানি পৃথিবীর-সবচেয়ে-বড় স্টিক কোম্পানি হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। এবং সারা পৃথিবীতে স্টিক মার্কেটের প্রায় ৬০ শতাংশ মার্কেট তার কোম্পানি দখল করে আছে।
ঠিক একই রকম ভাবে বিল বউ ম্যান, যখন একজন ট্র্যাক কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন তখন তিনি স্বল্পমূল্যের এক ধরনের হালকা জুতার খোঁজ করছিলেন। কিন্তু মার্কেট খুঁজে তিনি তার মনের মত কোন জুতা পাচ্ছিলেন না। এরপর তিনি নিজেই রাবার নিয়ে মেশিনের মাধ্যমে এক ধরনের হালকা এবং স্বল্প মূল্যের জুতা আবিষ্কার করে ফেললেন যেখান থেকে আজকের নাইক কম্পানি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। নাইক কোম্পানিকে আজকে সবাই চিনে।
ঠিক একইভাবে লেখক প্রথমে একটি কোম্পানি শুরু করেছিলেন যাদের কাজ ছিল কনসালটেশন। কিন্তু একটা সময় গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন যে এ সকল ব্যবসা ম্যানেজ করার জন্য মার্কেটে ভালো তেমন কোন ম্যানেজমেন্ট টুলস সচরাচর ছিলনা। তখন তিনি তার পার্টনারের সাথে আলাপ আলোচনা করে একটা ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার বানিয়ে ফেললেন। আর সেখান থেকেই তার আজকের মিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার কোম্পানি।
এই তিনটি উদাহরণ থেকে আমরা একটা কমন বিষয় দেখতে পাই যে, তিনজনের প্রত্যেকেই তাদের কোম্পানি শুরু করার আগে একটা করে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। তারপর কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করে এখান থেকে বেরিয়ে আসা যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। আর এখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে তাদের মিলিয়ন ডলারের কোম্পানি।
তো এখান থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আপনাকে এমন কোন আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে হবে যা আপনার চলার পথে একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই সমস্যাকে সমাধান করেই আপনার নতুন বিজনেস শুরু করতে হবে। কারণ এই সমস্যা থেকে কিভাবে বের হওয়া যাবে বা এই সমস্যা মানুষের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে সেটা একমাত্র আপনি ভালো জানবেন।
কিন্তু আপনি যদি অন্যের সমস্যা খুঁজে নিয়ে কাজ করা শুরু করেন তাহলে বিষয়টি হবে অন্ধকারে তীর চালানোর মত যেখানে আপনি সফল বিজনেসম্যান হতে পারেন আবার নাও পারেন।
২। Core minimum
মনে করেন আপনি রসমালাইয়ের ব্যবসা করবেন। কি নাম শুনতে খুব খেতে ইচ্ছা হচ্ছে তাই না? এর প্রধান কারণ হলো রসমালাইয়ের আকর্ষণীয় স্বাদ।
এখন এই ব্যবসা শুরু করার জন্য আপনার অনেক কিছুই দরকার যেমন একটা দোকান কিছু কর্মচারী এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র। আপনি হয়তো শুরুতেই এইগুলোর পেছনে অনেক টাকা-পয়সা বা পরিশ্রম খরচ করে ফেলবেন। আর এর মাধ্যমেই আপনি আপনার প্রধান ফোকাস থেকে শুরুতেই সরে গেছেন। কারণ আপনার শুরুতেই প্রকাশ করা উচিত ছিল আপনার রসমালাইয়ের স্বাদের ওপরে। দোকান শুরু করার সময় যখন দুই একজন মানুষ আপনার রসমালাই খেয়ে তার স্বাদ বুঝতে পারবে তখন আপনার দোকানে প্রচন্ড ভিড় করবে। তারপর আপনি এমনিতেই ধীরে ধীরে আপনার দোকান বা আপনার কর্মচারীর সংখ্যা বাড়াতে পারবেন।
লেখক যখন তার ব্যবসা শুরু করেছিলেন তখন শুরুতেই হাইলি স্ট্যান্ডার্ড একটা অফিসের বদলে শেয়ার করা অফিস ব্যবহার করতেন। কাস্টমারদের সমস্যা শোনার জন্য স্টাফ নিয়োগ না দিয়ে নিজেরাই কল সেন্টারের কাজ করেছেন। যখন তাদের ব্যবসা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তখন ঠিক ওই জিনিসগুলোকে হাইলি স্ট্যান্ডার্ড লেভেলে নিয়ে গেছেন।
তাই ব্যবসার শুরুতে আপনাকে একটা বিষয় মাথা রাখতে হবে যে, আপনার প্রোডাক্ট দেখতে কতটা সুন্দর সেটা আসল কথা নয়, আসল কথা হল আপনার প্রোডাক্ট কতটা কার্যকরী।
পড়াশোনা শেষ করে আপনি হয়তো লাখ লাখ টাকা দিয়ে যে কোন চাকরি বা ব্যবসা শুরু করতে পারেন। কিন্তু আপনার চেয়ে তার ব্যবসায় প্রফিট বেশি হবে যে ঘরে বসে থেকে সাধারণ কোন জিনিস থেকে তার নিজের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
3. Fight Passionately
যখন আপনি কোন সমস্যার সমাধান বের করবেন তখন কিভাবে সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেবেন। আপনার মত অনেক মানুষ হয়তো সেই সমস্যাগুলোর সমাধান আগেই বের করে ফেলেছে। হাজারো সমাধান এর মধ্যে কিভাবে আপনার সমাধানকে মানুষের দৃষ্টিগোচর করাবেন। এজন্য আপনাকে আপনার প্রতিযোগিদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে। আমি কিন্তু মারামারির কথা বলছি না। আমি বলছি আপনি আপনার প্রোডাক্ট দিয়ে অন্যদের চেয়ে আপনার বিজনেসকে সবার চোখের সামনে এনে তুলে ধরুন।
ডানকিন ডোনাট নিজেকে সবসময় অ্যান্টি স্টারবাকস হিসেবে দাবী করতেন। তিনি বাহিরে গিয়ে সবার মধ্যে বলে বেড়াতেন যে তিনি একজন অ্যান্টি স্টারবাকস। এমনকি তিনি একটি ওয়েবসাইট খুলে ছিলেন যেখানে লিখেছিলেন যে, একজন সত্যিকারের বন্ধু কখনো আরেক বন্ধুকে স্টারবাকস এ ইনভেস্ট করার জন্য উৎসাহিত করে না।
এবার আমাদের দেশেও প্রেক্ষাপটের একটা উদাহরণই ধরুন, স্প্রাইট এক ধরনের কোমল পানীয় যা আমরা সবাই চিনি। তারা তাদের অ্যাডভার্টাইজমেন্ট বলে থাকে যে, স্প্রাইট নাকি একদম ক্লিয়ার। এখন অন্যান্য যে কোম্পানির কোমল পানীয়গুলো বিভিন্ন গাঢ় রঙের হয়ে থাকে সেগুলো কি ক্লিয়ার না? হ্যাঁ সেগুলো অবশ্যই। কিন্তু মার্কেটিং এর কারণে স্প্রাইট অন্যান্য কোম্পানিদের সাথে অন্যভাবে ফাইট করছে তাদের এই ধরনের মন্তব্যের মাধ্যমে।
আপনি যখন আপনার প্রোডাক্ট নিয়ে মার্কেটের অন্যান্য কোম্পানির সাথে স্ট্রং লজিক এর মাধ্যমে ফাইট করবেন তখন আপনার প্রোডাক্ট এর প্রতি আপনার মত সাইকোলজির লোকজনের অনেকটা বিশ্বাস এবং সাপোর্ট জন্ম নিবে যা আপনার ব্যবসাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
4. With Less
হারভার্ট এবং কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি সারা পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত। কিন্তু তারা কেন পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় তাদের ব্রাঞ্চ খুলে না। তাদের জন্য এটা কোন কঠিন বিষয়? কিন্তু তারা কখনো এমনটি করেন না। এর কারণ হলো তারা বিশ্বাস করেন যে বিভিন্ন দেশে ব্রাঞ্চ খুললে তাদের যে কোয়ালিটি এবং প্রভাব সেটা কখনোই আগের মত থাকবে না।
বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরা বিশ্বাস করে যে, তাদের ব্যবসা কতটা সফল সেটা নির্ভর করে সংখ্যার উপরে অর্থাৎ তারা কতটি প্রোডাক্ট বা কতটি ব্রাঞ্চ লঞ্চ করল সেটার উপরে। কিন্তু লেখক বলেছেন যে, এই ধারণাটি একেবারে সম্পূর্ণ ভুল। কারণ দুইটা ব্রাঞ্চ বা দুইটা প্রোডাক্ট আপনি যতটা ভালোভাবে বা সহজভাবে ম্যানেজ করতে পারবেন দশটা ব্রাঞ্চ বা দশটা প্রোডাক্ট আপনি ততটা ভালোভাবে বা সহজভাবে ম্যানেজ করতে পারবেন না।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, আপনি আপনার বাড়ি থেকে বের হয়ে দুইটা রেস্টুরেন্ট পেয়ে থাকেন। প্রথম রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখলেন যে তাদের অসংখ্য আইটেম, সেগুলো দেখে আপনি শুরুতেই দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে গেলেন। তারপর এক এক করে অনেকগুলো আইটেম ট্রাই করার পরেও কোনোটাতেই আপনার তেমন কোনো মজা আসলো না। এর কারণ হলো তারা আসলে এতগুলো আইটেমের কোনোটাতেই ঠিকমতো কোয়ালিটি আনতে পারছে না।
তারপর আপনি পরবর্তী রেস্টুরেন্টে গেলেন এবং সেখানে দেখলেন যে তাদের শুধুমাত্র কয়েকটা আইটেম যেগুলো ট্রাই করতে আপনি প্রকৃত মজা পেয়ে গেলেন। এর কারণ হলো তারা আসলে কম আইটেম সাপ্লাই করে কিন্তু সেগুলোর কোয়ালিটি ঠিকঠাকমতো রেখে। তো আপনি অবশ্যই প্রথম রেস্টুরেন্টটিতে আর কখনো ফিরে যাবেন না।
বিষয়টা ঠিক এরকমই। আমাদের দেশে যারা নতুন ব্যবসা শুরু করে তারা এই ভুলটা বরাবরই করে থাকে। তাদের প্রতিযোগী যদি দুইটা সুবিধা দেয় তাহলে তারা সুবিধার পরিমাণ বাড়িয়ে তিনটা করে দেয়, প্রতিযোগী তিনটা দিলে তারা পাঁচটা করে দেয়। এভাবে একটা সময় গিয়ে দেখা যায় যে, তাদের সুবিধার পরিমাণ বেড়ে গেছে ঠিক কিন্তু সেগুলোর কোনটাই ঠিকঠাক মত কাজ করছে না।
তাই ব্যবসার শুরুতে প্রোডাক্ট বা সুবিধার পরিমাণ না বাড়িয়ে আমাদের উচিত সেগুলোর মান ঠিকঠাকমতো রাখা। আর অবশ্যই ব্যবসাকে সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল করে প্রোডাক্ট এর মান নষ্ট করা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। তাই শুরুতেই আমাদের লেস এর বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে। এতে করে আমরা আমাদের টাকা বাঁচাতে পারবো এবং বেস্ট কোয়ালিটি সম্পন্ন প্রোডাক্ট বাজারে সাপ্লাই করতে পারব।
অনেক মানুষ বলে থাকে যে ব্যর্থতা থেকে আমাদের শিখতে হয়। কিন্তু লেখক বলেন যে, ব্যর্থতা থেকে আমরা শুধু কোন কাজটি করা যাবে না সেটা শিখতে পারি, এটা কখনোই শিখতে পারি না যে, কোন কাজটি আমাদেরকে করতে হবে। তাই আমাদের শিখতে হবে সফল মানুষদের দেখে শুনে এবং জেনে।