প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রশ্নফাঁসে যখন ধরা পড়ছে, তদন্ত হবে বিচার হবে। যারা বেনেফিসিয়াল তাদের খুঁজে বের করা গেলে ব্যবস্থা নেব। তাদের চাকরি করার অধিকারই থাকবে না। তাহলে ভবিষ্যতে আর কেউ এসব কাজ করবে না।
রোববার (১৪ জুলাই) বিকেলে গণভবনে চীন সফর নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা হয়েছিল ২০০২/০৩ সালে। বিএনপির আমলে সেই সময়ে যত চাকরি হতো, হাওয়া ভবন থেকে তালিকা পাঠানো হতো, আর সে তালিকায় থাকাদের চাকরি হতো। সেই সময় ঢাকা কলেজের পরীক্ষা হয়। একটা বিশেষ রুমে তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়। প্রশ্নফাঁস বা অনিয়মগুলো তখন থেকেই শুরু। আমরা সরকারে আসার পর ২০০৯ সাল থেকে সম্পূর্ণভাবে এগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলাম। যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের পর এই গ্রুপটা কী করে যেন আবার জায়গা করে ফেলে। যেটা এখন ধরা পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় এগুলো ধরতে গেলে অনেকে বলে যে প্রচার হলে ভালো হবে না, ইমেজ নষ্ট হবে। আমি বলেছি যে আমি এগুলোতে বিশ্বাস করি না। কীসের ইমেজ নষ্ট হবে? অন্যায়-অবিচার যারা করবে তাদের আমরা ধরবোই। তাদের ধরতে হবে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবে যেন চলতে না পারে তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, অনেকে বলে আমাদের সময় থেকে প্রশ্নফাঁস শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটা শুরু হয়েছিল সেই জিয়ার আমল থেকেই। খালেদা জিয়া আসলে আরও এক ধাপ এগিয়ে। তখন তালিকা আসতো। তালিকায় যা থাকত ওটা মানতে হতো। না মানলে কেউ জানে বেঁচে থাকতে পারতো না। এইতো ছিল বাংলাদেশের অবস্থা, সেটা ভুলে গেলে চলবে? ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত কী ছিল? কেউ কী কথা বলতে পেরেছে? যে অনিয়মগুলো করেছে সেইগুলো থেকে সুস্থতা ফিরিয়ে এনেছিলাম।
শেখ হাসিনা বলেন, প্রশ্নপত্র যারা ফাঁস করে আর যারা প্রশ্নপত্র ক্রয় করে, দুইজনই অপরাধী। খুঁজে বের করে দেবে কে? সাংবাদিকরা যদি খুঁজে বের করে দেয়, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছেন, একসময় আমার বাসার পিয়ন ছিল। সেও নাকি ৪০০ কোটি টাকার মালিক। হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না। পরে তাকে ধরা হয়েছে। খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে।
পিএসসির গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর অঢেল সম্পদ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন ড্রাইভার কীভাবে এত কোটি কোটি টাকার মালিক হলো, সেটা কীভাবে বলবো? তাদের অপকর্ম আমরা ধরছি বলেই তো এখন জানতে পারছেন। এতদিন তো আপনারা জানতে পারেননি। প্রথমে আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। এখন জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে, তাদের থামিয়েছি। এখন আমরা দুর্নীতি নিয়ে কাজ করছি, দুর্নীতবাজদের ধরছি। এটা চলতে থাকবে।
শেখ হাসিনা বলেন, অনেকে আমাকে বলেন— এটা করলে সরকারের ইমেজ নষ্ট হবে। আমি সেটা মনে করি না। যারা অপরাধ করছে, দুর্নীতিতে জড়াচ্ছে; তাদের ধরতে হবে। এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হবে না।
সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কী রাজাকারের নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে— এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিরা কোটা পাবে? তা তো আমরা দিতে পারি না।
চীনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফর প্রসঙ্গে ভারতীয় পত্রিকা ইকোনমিক টাইমসের ‘আপসেট শেখ হাসিনা, রিটার্ন ফ্রম চায়না’ শীর্ষক প্রতিবেদন এবং দেশে এ নিয়ে সমালোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পৃথিবীর বহু দেশে যখন আমি যাই, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি দেশে চলে আসি। কাজ শেষ হয়ে গেলে আমার তো শপিংয়েও যাওয়ার প্রয়োজন নাই, দেখারও জায়গা নাই, বেড়ানোরও কিছু নাই। বহুবার আমি এভাবে এসেছি। এগুলোকে এত রং-চং মাখিয়ে এত কিছু বলার তো কিছু নাই। আমি শুধু বলব যারা এসব বানোয়াট কথা বলে, তাদের যেন দেশবাসী চিনে রাখে।
ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদন ও সমালোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের গণমাধ্যমের কথা শুনে আমাদের এখানে যারা কথা বলেন, তারাই তো দু’দিন আগে বলেছে ভারতের কাছে আমরা সব বিক্রি করে দিয়ে এসেছি। অসম চুক্তি করে এসেছি, দেশ বিক্রির চুক্তি করে এসেছি, তাদের কথা আসলে কোনটা ঠিক?
শেখ হাসিনা বলেন, সফরে আমার মেয়েকেও তাদের (চীনের) হেলথ মিনিস্ট্রি থেকে দাওয়াত দিয়েছিল। সে অনুযায়ী সে এসেছিল। সেখানে তার সকাল বেলা যাওয়ার কথা কিন্তু তার প্রচণ্ড জ্বর থাকায় আমার সঙ্গে যেতে পারেনি, এটা বাস্তবতা। আমি একটা মা, ওই অবস্থায় রেখেই আমাকে চলে যেতে হয়। সব কার্যক্রম শেষে আমাদের ১১ তারিখ বিকেলে আসার কথা, সেখানে আমরা সকালে চলে এসেছি। মাত্র ছয় ঘণ্টার পার্থক্য। এই ছয় ঘণ্টার মধ্যেই এত বড় তোলপাড় হয়ে যাবে, এটা তো বুঝতে পারিনি।
তিনি বলেন, এসব সমালোচনা আজ নতুন না। এর আগে যখন ভারতে গেলাম, আমার তিন বা চার দিনের প্রোগ্রাম ছিল। এরপর যখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিলেন বাংলাদেশে আসবেন, তখন আমার দায়িত্ব ছিল উনি আসার আগেই আমার বাংলাদেশে এসে পৌঁছানো এবং তাকে রিসিভ করা। আমি তখন ভারতে দুই দিনের প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে বাংলাদেশে চলে এলাম। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি দেশে চলে আসি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে আসার পর প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসব নেগেটিভ কথা শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সবসময় আমার বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানো, নানা ধরনের কথা বলা, বলতে বলতে তারা এখন এত বেশি বলে যে তাদের বলায় এখন আর আমার কিছু আসে যায় না। যারা বলছে তাদের বলতে দিন। চীন কেন, এর আগে আমি ভারতে গেলাম, তখন বলা হয়েছে ভারতের কাছে আমি দেশ বিক্রি করে দিয়েছি। এরপর চীনে গেলাম, এখন বলে তারা আমাদের কিছুই দেয়নি। এগুলো তারা সবসময় বলেই আসছে। ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করা, অসম চুক্তি স্বাক্ষর করা, এগুলো বলা– এটা তো একটা শ্রেণির লোকের এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা আমি মনে করি। মানসিক অসুস্থতা ছাড়া এভাবে বানোয়াট কথা কেউ বলতে পারে না। তাদের প্রতি আমার করুণাই হয়।
প্রসঙ্গত, গত ৮ জুলাই বেইজিং সফর শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১১ জুলাই দেশে ফিরে আসার কথা ছিল তার। কিন্তু সফরসূচিতে পরিবর্তন এনে একদিন আগে (১০ জুলাই) দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী।
বেইজিংয়ে অবস্থানকালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া, চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গেও প্রতিনিধি পর্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে অংশ নেন।
সফরের শেষ দিন ১০ জুলাই বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক হয়। এরপর দুই দেশ ২১টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করে এবং সাতটি প্রকল্পের ঘোষণা দেয়।