ইহুদি বিরোধী, বর্ণবাদী এবং সমকাম বিরোধী বিদ্ধেষমূলক প্রচারণা চালাতে মূলধারার ভিডিও গেইম ও গেইমের চ্যাটিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে উগ্রপন্থীরা। কল অফ ডিউটি ও মাইনক্রাফটের মতো জনপ্রিয় গেইম নিয়ে আলাপচারিতা ও স্ট্রিমিংয়ের প্ল্যাটফর্ম ডিলাইভ এবং ওডিসি ব্যবহার করে এমন বিদ্বেষমূলক প্রচারণার প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা।
বিবিসি বলছে, দৈনন্দিন আলাপচারিতায় এভাবে উগ্রপন্থী বিষয় জুড়ে দেওয়ার মাধ্যমেই খুলে যায় মৌলবাদী অধঃপতনের পথ। ওই আলাপচারিতাগুলোই পরবর্তীতে ব্যক্তিগত টেলিগ্রাম চ্যানেলে চলে যায়।
“আর তখনই আপনি অন্যান্য ছোট গ্রুপে যাওয়া শুরু করবেন, ছোট ছোট ওই দলগুলোর সদস্যরা সাধারণত গেইমারও হয় না, আলাপে রাজনীতি আরও বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে”– নিজস্ব প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে বিবিসি।
উগ্রপন্থীদের টেলিগ্রামের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি বিবিসিকে বলেছে, প্ল্যাটফর্মের নীতিমালা ভঙ্গকারী কন্টেন্ট মুছে দিতে “ব্যবহারকারীদের অভিযোগ আর সর্বসাধারণের ব্যবহৃত স্থানগুলোর উপর স্বপ্রণোদিত নজরদারির উপর নির্ভর করে” তারা।
তবে বিবিসি’র প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো মন্তব্য করেনি ডিলাইভ ও ওডিসি। সহিংস আচরণ ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা ঠেকাতে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বলা আছে উভয় প্ল্যাটফর্মের নীতিমালায়।
এই প্রসঙ্গে জনপ্রিয় ভিডিও গেইম কল অফ ডিউটির নির্মাতা বলছে, “বর্ণবাদী আচরণ বন্ধে আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি, তার মধ্যে আছে বর্ণবাদী বা বিদ্বেষমূলক নাম হলে ওই গেইমারকে নিষিদ্ধ করা, নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং গেইমের ভেতরে গেইমারদের আপত্তিকর আচরণ নিয়ে অভিযোগ জানানোর উপার আরও সহজ করা”।
তবে গেইমের মধ্যেই ‘উগ্রপন্থী রোলপ্লে’র প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকরা। বিভিন্ন গেইম প্ল্যাটফর্ম গেইমারদের নিজেদের পছন্দ মতো ম্যাপ ও গেইমের পরিবেশ কাস্টোমাইজ করার সুযোগ দেয়। বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালাতে প্ল্যাটফর্মগুলোর এই ফিচারগুলোর সুযোগ নিচ্ছে উগ্রপন্থীরা।
বিবিসি জানিয়েছে, রোব্লক্স এবং মাইনক্রাফট গেইমের কাস্টম ম্যাপে এভাবেই নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প এবং উইঘুর ডিটেইনমেন্ট ক্যাম্প বানাচ্ছে উগ্রপন্থীরা।
এর মধ্যে রোব্লক্সের একটি কাস্টোম গেইমে গেইমারদের ‘বর্ণবাদী হওয়ার’ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ওই গেইমটিতে জাতিগত সংখ্যালঘুদের গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা করতে হতো গেইমারকে।
“এই গেইমগুলো ছোট এবং অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও অনেক বেশি নয়। তবে এটা উগ্রপন্থীদের রোল-প্লেয়িং অভিজ্ঞতা তৈরি করতে দেয়– অনলাইনে মৌলবাদী কল্পনা বাঁচতে পারে তারা,”– মন্তব্য করেছেন ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক ডায়লগ-এর গবেষক জ্যাকব ডেভি।
এই প্রসঙ্গে রোব্লক্স বলছে, “আমরা সব সময়ই নিশ্চিত করার চেষ্টা করি যেন আমাদের প্ল্যাটফর্ম নিরাপদ এবং সভ্য থাকে। দুই হাজারের বেশি মডারেটর ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির মিশেলে আমরা সাত দিন ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার উপর নজর রাখি এবং অগ্রহণযোগ্য আচরণের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নেই।”
অন্যদিকে মাইনক্রাফট বলছে, “সন্ত্রাসী ও সহিংস উগ্রপন্থী কন্টেন্ট আমাদের কমিউনিটি মান অনুযায়ী নিষিদ্ধ। আমাদের সিস্টেমে এমন কন্টেন্ট নজরে এলে সেই কন্টেন্ট মুছে দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেই আমরা।”
তবে গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, সামাজিক মাধ্যমগুলোতে উগ্রপন্থী কন্টেন্ট নিয়ে কড়াকড়ি আরোপের ফলে সেখানে সুবিধা করে উঠতে পারছে না উগ্রপন্থীরা; তাই তারা এবার গেইমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর দিকে ঝুঁকছে।
এই প্রসঙ্গে জ্যাকব ডেভি বলেন, “সম্ভবত নিজেদের মতবাদ প্রচারের জন্য বা প্রচলিত প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর নতুন নিরাপদ উপায় খুঁজে পেয়েছে চরমপন্থী মৌলবাদীরা– এই ধরনের কাজগুলো কয়েক বছর আগে তারা ফেইসবুক, ইউটিউব এবং টুইটারের মাধ্যমে করতো।
“অনলাইন গেইমিং আদতে একই শখ আছে এমন মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ করে দেয়, আর এর মধ্যে চরমপন্থীরাও পড়ে”।
“এর মাধ্যমে তারা একই চিন্তাধারার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পায়, এক পর্যায়ে শক্ত সামাজিক সম্পর্ক তৈরি হয়, যা বিশ্বব্যাপী চরমপন্থী আন্দোলনকে সামনে এগিয়ে নিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে”।
অনলাইন গেইমিংয়ের জগতে বড় পরিসরে উগ্রপন্থা বিরোধী তদন্ত করছে যুক্তরাজ্যের দ্য রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট। সংস্থাটির কর্মকর্তা ড. জেসিকা হোয়াইট এই প্রসঙ্গে বলেন, “অনলাইন এবং চ্যাটিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে নজরদারি সাধারণত দুর্বল হয় বলে উগ্রপন্থীরা ক্রমশ এর সদ্ব্যবহার করছে। কিন্তু এর পরিসর নিয়ে বিস্তারিত প্রমাণ প্রয়োজন আমাদের”। গেইমিং জগতে উগ্রপন্থীদের সংক্রমণ ঠেকাতে ব্রিটিশ সরকার এই খাতের শীর্ষস্থানীয়দের সঙ্গে আলোচনা করছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।