কাজটি করার পরিকল্পনা ছিল আরো কয়েক বছর পরে, আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে। কিন্তু অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর কান্না দেখে কাজটি এখনই হাতে নিতে হলো। অন্তত কাজটা শুরু হোক। যতটা সাহায্য তাদের করা যায়!
শিরোনাম দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমি কী নিয়ে কথা বলছি। জি, বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের হাতে কীভাবে বিনা মূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ল্যাপটপ তুলে দেয়া যায়, সেটা নিয়েই লিখতে বসেছি। বিষয়টি অনেক দিন ধরেই মাথায় ছিল। কয়েক বছর আগে একটু শুরু করেছিলাম। কিছু মানুষকে তখন সাহায্য করা গিয়েছিল। এখন আরেকটু ধাক্কা দেয়া যেতে পারে বলেই বিষয়টির অবতারণা করছি।
ছাত্রছাত্রীদের ল্যাপটপ দরকার কেন?
সারা বিশ্বে শিক্ষাব্যবস্থা যেভাবে পাল্টে গেছে, তাতে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল পদ্ধতি ছাড়া আর উপায় নেই। কেউ কি বর্তমান সময়ে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার অবস্থা দেখেছেন? বেশিভাগই বই কেনে না- বই হয়তো বাজারে পাওয়া যায় না, কিংবা কেনার সামর্থ্য থাকে না। তারা ফটোকপি করে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আশপাশে যে ফটোকপির দোকান, সেগুলোর দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন আমাদের পরের প্রজন্ম কীভাবে ফটোকপি করে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বই, ক্লাসনোট, প্রশ্নপত্র, সাজেশন- সবকিছুই ফটোকপি। এবং একটা বর্ষ শেষ, সেই ফটোকপি চলে যাচ্ছে ঝাল-মুড়ি বিক্রেতার কাছে। তাদের কাছে বই থাকছে না। (কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বইগুলো আমার এখনো আছে। স্কুলের বইও খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে।) আমি বর্তমান সময়ের ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করেছি, তাদের সংগ্রহে বই নেই। বই নাকি তাদের লাগেও না। হবে হয়তো। যেহেতু আমি এখন পড়ছি না, তাই এটা নিয়ে আমার মতামত ঠিক হবে না। বই ছাড়াও যদি বিষয়টি শিখে ফেলা যায়, তাহলে হয়তো বই না-ও লাগতে পারে।
বর্তমান সময়ে বই না লাগলেও একটা ডিভাইস যে লাগবে, সেটা আমি নিশ্চিত। শিক্ষার অসংখ্য ম্যাটেরিয়াল এখন সে চাইলেই ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে নিতে পারে, যা আমাদের সময় সম্ভব ছিল না। আমাদের সম্বল ছিল লাইব্রেরি। কিন্তু সেই লাইব্রেরির আবেদন এখন কমে এসেছে। তাই বর্তমান সময়ের ছাত্রছাত্রীদের একটি ডিভাইস হলে তার শিক্ষা কার্যক্রম আরো উন্নত হতে পারে।
সব শিক্ষার্থী কি ডিভাইস এফোর্ড করতে পারবে?
বাংলাদেশ এখনো ধনী দেশ হয়ে ওঠেনি। বাংলাদেশ এইমাত্র উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নাম লেখাল। তাই এ দেশের অসংখ্য শিক্ষার্থী ডিজিটাল ডিভাইস পেয়ে যাবে, সেটা সম্ভব নয়। এটা সরকারের পক্ষে দেয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি ছাত্রছাত্রীদের পক্ষেও কেনা সম্ভব নয়। বেশিভাগ পরিবার তাদের সন্তানদের ট্যাবলেট বা ল্যাপটপ কিনে দিতে পারবে না। এটাই বাস্তবতা। আমি যদি আমার স্কুল/কলেজের কথা মনে করি, আমার মা-বাবা আমাকে একটি ল্যাপটপ কিনে দেয়ার মতো সামর্থ্য রাখতেন না। এমন লাখ লাখ পরিবার পাওয়া যাবে, যাদের পরিবার এটা এফোর্ড করতে পারবে না।
তাহলে উপায়! এই বিশাল জনসংখ্যা তাহলে ডিজিটাল ডিভাইস পাবে না বলে শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়বে? আসলেই কিন্তু পিছিয়ে পড়বে। এই গ্রহের অন্য দেশের ছেলেমেয়েরা যা শিখবে, আমাদের ছেলেমেয়েরা সেটা পাবে না। যারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে পারবে, শুধু তারাই কিছুটা পাবে। কিন্তু সবাই তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারবে না। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারলেই তার যে একটা ল্যাপটপ থাকবে, সেটা না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আমাদের পরিবারগুলোর তো সেই সক্ষমতা এখনো তৈরি হয়নি। এটা মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে।
যেভাবে ল্যাপটপ দেয়া হবে
আমরা একটা ফাউন্ডেশন (নন-প্রফিট) করতে যাচ্ছি, যার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের ল্যাপটপ দেয়া হবে। কারা এই ল্যাপটপগুলো পাবে, সেটা ধীরে ধীরে ঠিক করব। তবে কীভাবে ল্যাপটপগুলো জোগাড় হবে, সেটা একটু বলা যেতে পারে।
১. আমাদের চারপাশে বিপুল মানুষ আছে, যাদের একাধিক ল্যাপটপ আছে। কিংবা কিছুটা পুরোনো ল্যাপটপ আছে। সেগুলোকে একটু ঠিক করে নিলেই অন্য একজন ব্যবহার করতে পারে। আমরা সেই ল্যাপটপগুলো সংগ্রহ করে, ঠিক করে তারপর ছাত্রছাত্রীদের মাঝে বিতরণ করতে পারি। তাতে রিসাইক্লিন হবে।
২. বিদেশে অনেক ফ্যাক্টরি রিফারবিশড ল্যাপটপ পাওয়া যায়, যেগুলোর মূল্য খুবই কম; কিন্তু গুণগত মান যথেষ্ট ভালো। সেই ল্যাপটপগুলো আমরা বিদেশ থেকে নিয়ে আসতে পারি। সেগুলো পরীক্ষা করে, তারপর ছাত্রছাত্রীদের হাতে তুলে দেয়া যেতে পারে।
৩. যারা কিছু টাকা দিয়ে ল্যাপটপ কেনার সামর্থ্য রাখেন, তাদের একত্র করে বাল্ক ল্যাপটপ অর্ডার করলে খরচ অনেক কম পড়বে। আমরা কিছু কিছু ল্যাপটপ কম মূল্যে তাদের দেব। সে জন্য পুরো প্রোগ্রামটি বিনা মূল্যে ট্যাপটপ নয়, স্বল্পমূল্যেও কেউ কেউ পাবেন।
এভাবে বেশ কিছু ল্যাপটপ জোগাড় করে ফেলা যাবে, যেগুলো ছাত্রছাত্রীদের কাজে লাগতে পারে।
যাদের ল্যাপটপ প্রয়োজন
আমরা একটি ওয়েবসাইট চালু করছি, যার ঠিকানা হলো https://priyo.org (প্রিয়.অর্গ)। যাদের ল্যাপটপ প্রয়োজন, তারা এই ঠিকানায় গিয়ে আবেদন করতে পারেন। এতে তাদের চাহিদা এবং সক্ষমতা জানা যাবে। আবেদন করলেই যে ল্যাপটপ পেয়ে যাবেন, তা কিন্তু নয়। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করেই ল্যাপটপগুলো দেয়া হবে। কতগুলো ল্যাপটপ কোথা থেকে পাওয়া গেছে এবং কাকে দেয়া হয়েছে, সবকিছুই ওই ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে। ওয়েবসাইটটি কেবলই তৈরি করা হচ্ছে। এখন মাত্র আবেদনটা করা যাবে। শীঘ্রই অন্যান্য তথ্য যুক্ত করা হবে।
তবে আবেদনকারীদের মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সবাইকেই পুরোনো ল্যাপটপ ধরিয়ে দেয়া হবে। ল্যাপটপগুলো ব্যবহারযোগ্য হলেই আমরা সেগুলো বিতরণ করব। পাশাপাশি আমরা নতুন ল্যাপটপও দেব, যা কেবল ছাত্রছাত্রীদের জন্য।
যাদের ল্যাপটপ প্রয়োজন, তারা এই ওয়েবসাইটে গিয়ে আগামী ২৬ মার্চের ভেতর আবেদন করতে পারেন।
যারা ল্যাপটপ দান করতে চান
আপনার কাছে যদি পুরোনো ল্যাপটপ থাকে, যা আপনি ব্যবহার করছেন না, তাহলে তার ডেটা মুছে ফেলে ল্যাপটপটি আমাদের ল্যাপটপ ব্যাংকে দান করতে পারেন। আমরা সেই ল্যাপটপটি যদি ব্যবহারের উপযোগী করতে পারি, তাহলে সেটা ঠিক করে কোনো শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দিতে পারি। আমাদের ওয়েবসাইটে যোগাযোগের ঠিকানা পেয়ে যাবেন। কুরিয়ারে ল্যাপটপটি পাঠিয়ে দিতে পারেন। নয়তো আমাদের টিমের কেউ একজন গিয়ে আপনার কাছ থেকে ল্যাপটপটি সংগ্রহ করে আনতে পারে।
তবে আপনাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, ঘরে কিংবা অফিসে একটু চোখ বুলিয়ে দেখুন। অনেক ল্যাপটপ হয়তো আশপাশে রয়েছে, যেগুলো বছরের পর বছর এমনিতেই পড়ে থাকবে। কিছুদিন পর ব্যাটারি নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি আর ব্যবহার করতেই পারবেন না। অনেক অফিস আছে, যারা নতুন ল্যাপটপ কিনেছে, পুরোনোগুলো কী করবে বুঝতে পারছে না। সেগুলো কিন্তু আমাদের ল্যাপটপ ব্যাংকে দিয়ে দিতে পারেন।
শর্তসমূহ:
এখানে যারা ল্যাপটপ পাবেন, তাদের জন্য একটি শর্ত আছে। আর যারা আমাদের মাধ্যমে অন্যকে ল্যাপটপ দান করতে চান, তাদের জন্য একটি শর্ত রয়েছে।
ক. ছাত্রছাত্রীদের জন্য শর্ত: মিথ্যা তথ্য দেয়া যাবে না। এই একটাই শর্ত। যে মুহূর্তে কেউ মিথ্যা তথ্য দেবে, তাকে সিস্টেম থেকে ব্যান করা হবে। তার কোনো কথাই শোনা হবে না, সে যত ভালো শিক্ষার্থীই হোক না কেন।
খ. ল্যাপটপদানকারীদের জন্য শর্ত: আমরা সবেমাত্র ফাউন্ডেশনের কাজে হাত দিয়েছি। এখনো সবকিছু গোছানো হয়নি। তাই এখনই আপনাদের সব হিসাব-নিকাশ হাতে তুলে দিতে পারছি না। যদি আমাদের বিশ্বাস করেন, তবেই আপনার পুরোনো ল্যাপটপটি আমাদের দিতে পারেন। মনে কোনো রকম সন্দেহ নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করার পরামর্শ থাকল।
যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই প্রসঙ্গটা দিয়ে শেষ করি।
এই প্রকল্পটা আমাদের হাতে ছিল। কিন্তু এখন সামনে নিয়ে এসেছি এ জন্য যে এই করোনাকালে আমাদের অনেক ছাত্রছাত্রী ডিভাইসের জন্য লেখাপড়া করতে পারছে না। স্মার্টফোন দিয়ে হয়তো তাদের কাজ চলছে, কিন্তু স্মার্টফোন আসলে শিক্ষা-উপকরণ নয়। ওই ছোট স্ক্রিনে তার শেখাটা হয় না। তাদের কথা মাথায় রেখেই আমরা আমাদের কিছুটা সময় ওই দিকে দিচ্ছি। যদি আপনারা কেউ আমাদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক হতে চান, তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। সবাই চেষ্টা করলে অনেক শিক্ষার্থীর জীবনই পাল্টে দেয়া যেতে পারে। প্রয়োজন শুধু সামান্য চেষ্টা।
এ বছর বাংলাদেশ তার পঞ্চাশে পা দিল। দেখি, বাংলাদেশের এই বছরে কতগুলো ছাত্রছাত্রীর হাতে ল্যাপটপ তুলে দিতে পারি!