প্রাচীনকাল থেকেই রাজশাহী সিল্কের (রেশম) জন্য বিখ্যাত। রাজশাহী সিল্ক শাড়ি নারীদের পছন্দের শীর্ষে থাকে। শুধু দেশে বিদেশে রয়েছে রাজশাহীর রেশমশিল্পের অনেক সুনাম। এ শিল্পের উন্নয়নের ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন বৃদ্ধি করা যায়তেমনি ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। এ শিল্পই হতে পারে বাংলাদেশেকে বিশ্বে পরিচিত করার মাধ্যম। সেই প্রাচীনকাল থেকে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে রাজশাহীর রেশম শিল্প। এই রেশম শিল্প অনেক সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। এই শিল্পের পরিধি বাড়লে কর্মসংস্থানের অনেক সুযোগ বাড়বে।
বাংলাদেশের রেশম শিল্পের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। প্রায় চার হাজার ৫০০ বছর আগে চীনদেশের চানতং প্রদেশে প্রথম রেশম আবিষ্কৃত হয়।খ্রিস্টপূর্ব ১৪১০ অব্দে তিব্বত থেকে হিমালয়েরপাদদেশে এর বিস্তৃতি ঘটে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে মোগল আমলে ভারতবর্ষে রেশমের ব্যাপকবিস্তৃতি ঘটে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ১৯১৪ সালে অবিভক্ত বাংলায় রেশম উন্নয়নের জন্য আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তৎকালীন রেশম কার্যক্রম শিল্প দফতরের অধীনে ন্যস্ত ছিল। তখন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) দুটি রেশম বীজাগার গড়ে তোলা হয়।
বীজাগার দুটি মীরগঞ্জে (রাজশাহী) ও বগুড়ায় অবস্থিত। বিগত দিন থেকেই সারা বিশ্বে রাজশাহীর রেশমের একটি সুখ্যাতি ছিল এবং এখন পর্যন্তদেশে রেশম চাষ ও রেশম শিল্পের বিকাশ।
রাজশাহীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। সে কারণে ১৯৬২ সালে তৎকালীন সরকার রেশম শিল্পের উন্নয়নের স্বার্থে টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তীকালে রেশম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে দেশের গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড গঠন করা হয় এবং বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে (বারেগপ্রই) বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এ বোর্ড সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের রেশম চাষ ও শিল্পের উন্নয়ন সম্প্রসারণের মাধ্যমে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের কল্যাণ সাধন করা। কিন্তু বাংলাদেশ রেশম বোর্ড ২০০২ সালে ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী রেশম কারখানা ও ঠাকুরগাঁও রেশম কারখানা বন্ধ করে দেয়।
ফলে এ কারখানায় জড়িত হাজার হাজার জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে পড়ে। রাজশাহী রেশম শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। এ শিল্পের তেমন কোনো অগ্রগতি সাধন হয়নি। বর্তমানে রেশম শিল্পের উন্নয়নে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। পরবর্তীকালে ১৯৯৭ সালের ১১ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে (বারেগপ্রই) বাংলাদেশ রেশম বোর্ড থেকে পৃথক করার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০৩ সালে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড থেকে পৃথক হয় বাংলাদেশ।
রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে পৃথক করা হয়। পরে (বারেগপ্রই) জাতীয় স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেশম বোর্ডকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করে। এর ফলে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে কিছুটা গতিশীলতা ফিরে আসে।
(বারেগপ্রই) এরই মধ্যে ৯টি উচ্চফলনশীল তুঁতজাত উদ্ভাবন করেছে। ফলে রেশম গুটির গড় উৎপাদন ২৫ থেকে ৩০ কেজির স্থলে এখন ৬০ থেকে ৭০ কেজিতে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে। এতে এ শিল্পের কিছুটা উন্নয়ন হয়েছে। আগে ১টি রেশমগুটি হতে ২৫০ থেকে ৩০০ মিটার সুতা পাওয়া যেত সেক্ষেত্রে বর্তমানে ৭০০ থেকে ৮০০ মিটার সুতা পাওয়া যাচ্ছে। উন্নত তুঁতজাত ও উন্নত রেশম কীটজাত মাঠ পর্যায়ে ব্যবহারের ফলে ১ বিঘা জমিতে তুঁতচাষ করে একজন রেশম চাষি বছরে ১২০ কেজির স্থলে বর্তমানে ২৪০ কেজি রেশমগুটি উৎপাদন করছেন। ফলে বর্তমানে একজন চাষি আগের তুলনায় ২ থেকে ২.৫০ গুণ বেশি মূল্যও পাচ্ছেন। বর্তমানে রেশম শিল্পের উন্নয়নে দুটি প্রকল্পম বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্প দুটি হলো বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি খাতে রেশম চাষ।
সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন (২০০৯-২০১৪)। এ প্রকল্প ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৫২.৫১ লাখ টাকা ব্যয়ে কিছু উন্নয়ন সাধন করে। এ প্রকল্প থেকে ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৪৮০টি রোগমুক্ত ডিম উৎপাদন, ২.৯৫ লাখ কেজি রেশমগুটি উৎপাদন, ৮ লাখ তুঁত চারা রোপণ, ২৩টি রেশমপল্লী স্থাপন ও ১৭৩৫ জন লোককে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। এ প্রকল্পটি ৬৮ ভাগ অগ্রগতি সাধন করে। অপর প্রকল্পটি হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের রেশম চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প (২০০৮-২০১৩)। এ প্রকল্প ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১৯.৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কিছু অগ্রগতি সাধন করে। এর মধ্যে এ প্রকল্প থেকে চার লাখ তুঁত চারা উৎপাদন, ২২৯০ জনকে প্রশিক্ষণ, ২৭১২টি ডালা, ১৮৭৫টি চ-কী, ২৮৮টি ঘোড়া, ৪৩৫০টি সুতার জাল চাষিদের মধ্যে সরবরাহ করে।
এছাড়া রেশমগুটি উৎপাদনে ১০০টি পলু ঘর তৈরির আর্থিক সহায়তা দেয়া হয় এ প্রকল্প থেকে। এপ্রকল্পটি ৯২ ভাগ অগ্রগতি সাধন করে। এছাড়াও রেশম বোর্ড এরই মধ্যে আরও দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এগুলো হলো বাংলাদেশের রেশম শিল্পের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের জন্যে সমন্বিত পরিকল্পনা (২০১৩-১৭ সাল) এবং রেশম চাষ সম্প্রসারণের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের মঙ্গা এলাকার দারিদ্র্য হ্রাসকরণ প্রকল্প (২০১৩-১৮ সাল)। এ দুটি বাস্তবায়ন হলে রেশম শিল্পের উন্নয়নের কিছুটা অগ্রগতি সাধন হবে।
এ ব্যাপারে রাজশাহী রেশম বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মনতোষ ধর বলেন, বর্তমানে চীন রেশম চাষ সঙ্কোচন করায় আন্তর্জাতিক বাজারে রেশম সুতার দাম বেড়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত ও ভিয়েতনাম রেশম চাষ সম্প্রসারণ করছে। বাংলাদেশও এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে রেশম চাষে ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটাতে পারে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্বতন্ত্র ও স্বকীয়তা বজায় থাকলে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কাজ ত্বরান্বিত করা সম্ভব হতে পারে এবং বাংলাদেশ রেশম বোর্ড ও রেশম চাষে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মাঠ পর্যায়ে রেশম চাষ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে উপকৃত হতে পারে।
ঐশী তাবাসসুম
ওনার অফ কাঠমুকুট