ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। উপজেলার সংখ্যানুসারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণীভুক্ত জেলা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলায় গ্রে-হাউন্ড কুকুর বেশ নামকরা। এই জাতের কুকুর পোষা শৌখিনতা ও আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে, যা লালন-পালন যথেষ্ট ব্যয়বহুল। সরাইলের ঐতিহ্য হিসেবেও পরিচিত গ্রে-হাউন্ড।
” গ্রে হাউন্ড কুকুর “, উন্নত বিশ্বে দিন দিন এর কদর বাড়লেও বাংলাদেশ থেকে এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ।চিতাবাঘ, ঘোড়া, সিংহ আর ক্যাঙ্গারুর পর দ্রুতগামী প্রাণী হিসেবে সরাইলের এই গ্রে হাউন্ডের অবস্থান । এমনকি দৌড়ে গাড়িকেও পেছনে ফেলতে পারে এই গ্রে হাউন্ড ৷ এই কুকুর দিয়ে একসময় শিকার করা হতো, এদের দিয়ে বনজঙ্গলে ঘেরাও করে তারপর শিকার করা হতো।অপরাধী সনাক্তকরণে ব্যবহার করা হয় এই কুকুরকে, তাই বাইরের দেশে এদের ভালো মূল্যে বিক্রি করা যায়৷ আবার আমাদের দেশে র্যাবের ” ডগ স্কোয়ার্ডে ” এদের ব্যবহার করা হয়। এই কুকুর পালন করা অনেক ব্যয়বহুল তাই শৌখিন মানুষজন তা কিনে থাকে ৷
অন্যকুকুর থেকে এই কুকুর আলাদা কারণ এদের দেহের গঠন, চলন, আচরণ সবদিক থেকেই এরা বৈচিত্র্য বহন করে। দেহের গঠন অনেকটা হালকা-পাতলা গড়নের , দেহ তিন থেকে চার ফুট লম্বা, কান-মুখ লম্বা, লেজ অন্য কুকুরের মতো বাঁকানো থাকে না, পা-পায়ের নখ লম্বা, চোখ বাদামি। এদের ঘ্রাণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি,শ্রবণশক্তি,গতিশক্তি প্রখর হওয়ায় এদের শিকারের কাজে ব্যবহার করা হয়৷ এই কুকুর প্রভু ভক্ত হলেও অপরিচিত ব্যক্তিদের জন্য মারাত্মক হিংস্র। তাই বাড়ির নিরাপত্তা, গুরুত্বপূর্ণ প্রাতষ্ঠানিক নিরাপত্তার কাজে এদের ব্যবহার করা হতো।
এই গ্রে হাউন্ড অনেক ব্যয়বহুল। ১মাসের একটা বাচ্চার দাম বর্তমানে ২০/২৫ হাজার টাকা, আর কিছু বয়স্ক হলে দাম লাখ টাকারও বেশি। এদের খাবারের আয়োজনে আছে ভিন্নতা। প্রতিদিন অল্প খেলেও ভালো খাবার দিতে হয় এদের। খাদ্য তালিকায় দুধ-ভাত-মাংস রাখতে হয়। আগে একসময় এলাকায় এই গ্রে হাউন্ডের প্রদর্শনী চলতো তা স্থানীয় প্রশাসন আর এলাকাবাসীর উদ্যোগেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে শৌখিন ব্যক্তিরা এসে এই কুকুর কিনে নিতো,এমনকি বিদেশেও পাঠানো হতো। ক্রাইম আইডেন্টিফাই করার জন্য এদের ব্যবহার করা হতো।এ কুকুর দিয়ে অপরাধীদের ধরা হতো, এরা প্রচন্ড গতিতে দৌড়াতে পারে। ৩য় / ৪র্থ শ্রেনীর বাংলা বইয়েও এই কুকুর নিয়ে অধ্যায় ছিল। একসময় চিড়িয়াখানায়ও এই কুকুর দেখা যেতো।
এই গ্রে হাউন্ডের উৎপত্তি নিয়ে এলাকায় কিছু কথা প্রচলিত আছে। সরাইলের দেওয়ান একবার হাতি নিয়ে কলকাতা যাওয়ার পথে এক ইংরেজের কাছে এই কুকুর দেখতে পান। তিনি ইংরেজ থেকে উনার হাতির বিনিময়ে সেই কুকুরটিকে(মাদি-স্ত্রি জাতের) কিনে নেন। পরবর্তীতে একবার শিকার করতে যাওয়ার পথে কুকুরটি হারিয়ে যায়, বেশ কিছু দিন পর কুকুরটি প্রেগনেন্ট অবস্থায় ফিরে আসে ৷আর ঐ বাচ্চাগুলোর বৈশিষ্ট সাধারণ কুকুর থেকে ভিন্ন ছিলো, বাঘের বৈশিষ্ট্যের সাথে অনেকটা মিল ছিলো। ধারণা করা হয়, দেওয়ানের কুকুরের সাথে নেকড়ের মিলন হওয়ায় এমন এক নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে ।
এই ঐতিহ্যবাহী কুকুর বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে। পুরো এলাকা খুঁজলে ১০/১৫ টার মতো পাওয়া যেতে পারে , কিন্তু এই প্রাণীই হতে পারতো বাংলাদেশের অন্যতম সম্পদ। আমরা আমাদের দেশী সম্পদের মর্ম বুঝি না, পুষ্টির অভাবে যত্নের অভাবে টাকার অভাবে এই সম্পদ এখন বিলুপ্তির পথে। আমরা বিদেশি কুকুর কিনে নিয়ে আসি পালনের জন্য কিন্তু আমরা এই জানি না যে পৃথিবীর দ্রুততম সেই কুকুর আমাদেরই দেশে অযত্নে বিলুপ্ত হতে বসেছে।
লেখক-রুপা
সত্ত্বাধিকারী -শখের বিক্রতা