হোগলা, হোগল, ধাড়িপাতা এসব নামে পরিচিত এটি। হোগলার বৈজ্ঞানিক নাম Typha, পরিবার Typhaceae। হোগলা একটি বহুবর্ষজীবী, একবীজপত্রী, উভয়লিঙ্গ, বাতাসে পরাগায়িত, হার্ব জাতীয় উদ্ভিদ। বিভিন্ন নামে হোগলা পরিচিত।
হোগলা এক জাতীয় উদ্ভিদ। ‘হোগলা’ গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিল্প। এ শিল্পের কারিগর নারীরা। গ্রামের নারীরাই এ শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে। হোগলার জন্য প্রসিদ্ধ মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার পৌর এলাকার তিনটি গ্রাম পাতাবালী, জুরগাও ও নয়াকান্দি; সিডিখান ও নবগ্রাম ইউনিয়নে ( আমার ইউনিয়ন ) হোগলা তৈরি হয়।
যেভাবে তৈরি হয়:
হোগলা পাতা দেখতে ত্রিকোণাকৃতির। মাদুর তৈরির জন্য প্রথমে শুকনো পাতাগুলো ‘কেচতে’ হয়। অর্থাৎ ত্রিকোণাকার পাতার এক পিঠে তিন-চার ইঞ্চি মাপের একটি বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ফাঁড়ার জন্য দাগ দিতে হয়। এরপর পাতা চ্যাপ্টা করে শুরু হয় মাদুর বোনার কাজ। বুনন শেষে ‘মুড়ি ভাঙা’ দিয়ে কাজ শেষ করতে হয়। দক্ষ হাতে ১০ বাই ১২ ফুট বড় একটি হোগলা পাতার মাদুর তৈরি করতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। বারো মাসই হোগলা তৈরি করা যায়।
মাদারীপুর জেলায় প্রায় ৩ হাজার পরিবারের প্রায় ৫ হাজার মহিলা হোগলা শিল্পের সাথে জড়িত। মাদারীপুর সদর উপজেলায় আড়িয়াল খাঁর তীর ঘেষে হোগলাপাতিয়া নামে একটি গ্রাম আছে। এক সময় হোগলা গাছের জন্য কিম্বা হোগলা তৈরির জন্য বিখ্যাত হওয়ায় এ গ্রামটির নাম রাখা হয়েছিলো হোগলাপাতিয়া।
হোগলা পাতা দিয়ো অনেক সামগ্রীই তৈরি করা যায়। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাবে ও এর জন্য আনুষঙ্গিক জিনিসের অভাবে তারা বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতে পারছে না।
হোগলাপাতা কোথায় কোথায় ব্যবহার হয়?
পাকা কাঁচা ফ্লোরের বিছানা পাটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডেকোরেটর সামগ্রী হিসেবে
দালানের ছাদসহ নির্মাণের কাজে
মাছ প্যাকিং
ফল, সবজি পরিবহনে
সমস্যা সংকুল কারণে মানুষের মৃত লাশ বহনে হোগলা ব্যবহার করা হয়
কারুকার্য করে ঘরবাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে
বিভিন্ন মঞ্চ সাজানোর কাজে শোভাবর্ধক উপকরণ হিসেবে
কুটিরশিল্পের ব্যঞ্জরিত কাজে
মাথার ম্যাট
ঝুড়ি
পলিথিনের বিকল্প বাজারের ব্যাগ
মাছ ধরার ঝুড়ি
দড়ি
জুতা
কাগজ তৈরিতে
ডোল/ধামা ধান, গম, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, রসুন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফসল সংরক্ষণের কাজে
রান্না ঘরের ঝুড়ি, সাজি, সিকা, হাতা খোল, দ্রব্য সামগ্রী রাখার জন্য বিভিন্ন আকারের পাত্র তৈরি করা হয়
জ্বালানি কাজে ব্যবহার করা হয়
হোগলা পাতা ঘরের ছাউনি ও বেড়া তৈরি করার কাজে ব্যবহার করা হয়
হোগলাপাতা শুধু পাতা হিসেবেই কার্যকর না। খাদ্য হিসেবে হোগলার গুঁড়ি বেশ সুস্বাদু সুস্বাদু খাবারের মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হোগলা ক্ষেতে শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে ফুল হয়, এ ফুলে সুমিষ্ট ও সুগন্ধি এক প্রকার গুঁড়া পাওয়া যায় যা হোগলার গুঁড়ি নামে পরিচিত। এ হোগলার গুঁড়ি গ্রাম বাংলার মানুষের মন জয় করেছে বহুদিন আগ থেকে তা এখন শহরের রান্না ঘরে বহু সমাদৃত এবং উপদেয় খাদ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। হোগলার জমিতে অনায়াসে মাছ চাষ করা যায়।
আমার দেখা হোগলাতার ব্যবহার:
এখনকার দিনে প্রত্যেকঘরে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহারের জন্য হোগলাপাতার তৈরি জিনিস দেখা যায় না। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের ঘরের ছাউনি ছিলো হোগলাপাতার। মাটিতে ঘুমাতাম হোগলাপাতায়। এখনতো চেয়ার এসে গেছে। কিন্তু আগে মানুষ হোগলাপাতার যে বসার টুল ( ফিরা ) এ বসতো। যে কোন অনুষ্ঠানের রান্না বান্নার সব কাজ হোগলাপাতায় করা হতো। গরমের দিনে সবচেয়ে আরামের ছিলো হোগলা পাতার হাতপাখা। এটা এখনো আছে। আর এই হোগলাপাতায় ঘুমাতে অনেক শান্তি লাগে। এটা ঠান্ডা হওয়ায় বাচ্চারা খেলাধুলা করতে বেশ পছন্দ করতো।
ই-কমার্সে সম্ভাবনা কেনো?
আমাদের বাড়ির কাকিমারা অনেকেই এই কাজ করতো। আর এখন প্লাস্টিকের পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় তা আজ প্রায় হারাতে বসেছে। এর ব্যবহার মানুষ আজ ভুলতে বসেছে। আর আমরা যদি তাদের মাঝে এর ব্যবহার আবার তুলে ধরতে পারি। তাহলে আবার এই শিল্প ঘুরে দাড়াবে। আর তা যদি আমরা ই-কমার্সে তুলতে পারি। তাহলে এটা ছড়িয়ে যাবে দেশের সব প্রান্তেই। আর এর ফলে এই কাজে যারা সংযুক্ত আছে তাদের অর্থনৈতিক চাহিদা মিটবে। আর দেশের অর্থনৈতিক চাকাও ঘুরে দাড়াবে। আমরাই পারি এই কাজ।
লেখক,
আশীষ পাত্র