রোখসানা আক্তার পপি, টাঙ্গাইল জেলার প্রতিনিধি, টেকজুম ডটটিভি // স্টেপল ফুড হলো সেই সকল খাবার যা প্রতিদিন আমরা শস্য খাবার তালিকায় ব্যবহার করে থাকি। এর মাঝে অন্যতম একটি হলো গম। গম হলো এমন একটি শস্য যেখানে জীবন ধারণের সব উপকরণ ই আছে, তাই একে বলা হয় শস্যের রাজা।
একটা সময় ছিলো যখন টাঙ্গাইল চর এলাকায় তামাক চাষ হতো। এখন তার জায়গা কেড়ে নিয়েছে গম। কিন্তু কিভাবে, আজ জানবো সেইসব গল্প।
আমরা মোটামুটি সবাই জানি টাঙ্গাইল এ বিশাল এলাকা জুড়ে চর এলাকা রয়েছে। এবং এই চর এলেকায় যেহেতু চাষাবাদের সম্ভাবনা কম। এখানে মূলত মাসকালাই, তামাক, পাট এসব ই ঘুড়েফিরে উৎপাদন করা হতো। মাসকালাই হবার পরে রবি সিজন জমি একেকবারেই খালি যেত, সংসারে অস্বচ্ছল অবস্থা আসতো কৃষকদের। সেই সময় কিছু তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্ররোচনায় পরে চাষীরা তামাক উৎপাদনের পিছনে ছুটে। এতে তাদের ও কিছুই করার নাই কেননা পেট তো চালাতে হবে। যার কারণে ভুয়াপুর এর প্রায় ৯৬৬২ হেক্টর এলাকাজুড়ে গড়ে উঠা চর এর শস্যবিন্যাস হয়ে উঠে তামাক-পাট-মাসকালাই।
কিন্তু, এই তামাক আমাদের পরিবেশ, মাটি সবকিছুর জন্য ই হুমকিস্বরূপ, পাশাপাশি মাটির উর্বরতা নষ্ট করে পরবর্তী সিজনের ফসলের আবাদ ও কমে যাচ্ছিলো।
এই অবস্থায় পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া রোধে এবং দানা জাতীয় শস্যের বৃদ্ধির লক্ষ্যে আঞ্চলিক গম গবেষণা কেন্দ্র, উন্নতমানের গমের বীজ নিয়ে আসেন বিএম আর আই, জয়দেবপুর, গাজীপুর থেকে এবং চাষীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেন। চাষীদের মাঝে বিনামূল্যে গম এর বীজ বিতরণ করেন এবং জনস্বার্থে ই তাদের তামাক এর স্বাস্থ্যঝুকি থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শ দেন, গমচাষে উদবুগ্ধ করেন।
শুরুটা হয় ২০১২-১৩ সাল নাগাদ। এভাবে চাষীরা ধীরে ধীরে তামাক থেকে ফিরে আসে গম এ এবং তাদের শশ্য বিন্যাস এখন হয়ে উঠেছে মাসকালাই-গম-পাঠ। ইভেন শুধু পাট না গম কাটার পর জমি যথেষ্ট উর্বর থাকে তাতে পাট ছাড়া ও তিল, কাউন, তিসি এসব খুব ভালো পরিমাণে চাষ হয়।
যেখানে আমাদের দেশের মোট চর এলাকা ০.৮২ মিলিয়ন হেক্টর সেখানে টাঙ্গাইলএর ১৯৭৬৩ হেক্টর চর এর মাঝে ভুয়াপুর এর ৯৬৬২ হেক্টর জমির চর এলাকায় ও যদি এই দানাশস্যের কেন্দ্রবিন্দু হয় সেটা ও আমাদের জন্য অনেক কিছু৷
এখনকার কথা যদি বলি এই সময়ে চাষীরা উচ্চ ফলনশীল জাতের গম চাষ করে, এবং এর উৎপাদনমাত্রা স্থানীয় জাতের থেকে তিনগুণ বেশি৷ এ বছর টাঙ্গাইল জেলায় ৫৩১০ হেকটর এর ও বেশি এলাকাজুড়ে চাষ হয়েছে গম এর। এর মাঝে সদর উপজেলা, বাসাইল, কালিহাতি, ঘাটাইল, নাগরপুর, সখীপুর, ভূয়াপুর, গোপালপুর , দেলদুয়ার, ধনবাড়ি, মির্জাপুর এ প্রতিয়া জায়গায় ই গম এর চাষ করা হয়।
গম আমাদের অন্যতম প্রধান শস্যজাত ফসল৷ ধান এর পরে ই গমের অবস্থান।এটি সকল পরিবেশে জন্মাতে পারে। ইদানীং কালে রোগ প্রতিরোধে এবং স্বাস্থ্যসচেতনাতার লক্ষ্যে গমের লাল আটার রুটি র ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। গমের উপরের লাল আবরন সহ ভাঙ্গানো হলে, আটা লাল রঙের হয় বলে একে লাল আটা বলে। আর যখন রিফাইন্ড করে খোসা ফেলে দিয়ে ভাঙ্গানো হয় তখন তা সাদা রঙের হয়। এই সাদা আটাই আমরা সাধারনত বেশি খেয়ে থাকি।
সাদা আটা খেতে সুস্বাদু হলে ও পুষ্টিমাণ বেশি লাল আটা তে ই। শুধু যে রুটির জন্য গম এর প্রয়োজন তা না বাচ্চাদের হোমমেইড সেরেলাক এ ও ব্যবহার করা হয় গম।
সামান্য করে ও যদি এর উপকারীতা বলি-
◑ লাল আঁটা রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
◑ এই আটা তে উপস্থিত লিগনান ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
◑ লাল আটায় বিদ্যমান অদ্রবণীয় খাদ্যআঁশ যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষ উপকারি।
◑ ওজন কমাতে বড় ভূমিকা পালন করে।
◑ কোষ্ঠকাঠিন্য ও দূর হয়।
◑ মৃগী রোগীদের জন্য খুব উপকারী।
শুধু গম না, গম এর আটার পাশাপাশি গম এর পাতার রয়েছে ভেষজ অনেক ব্যবহার। যেমনঃ
◑ লিভার কে সুস্থ রাখতে গমের রস ব্যবহার অত্যন্ত উপকারী।
◑ এছাড়া গমের পাতায় এত ক্লোরোফিল বিদ্যমান যে যা অন্য কোথাও পাওয়া দুরূহ। এর ক্লোরোফিল রক্তে শোষনের ফলে হার্ট সহ শরীরের অন্যান্য অনেক শারীরিক সমস্যা দূরীভূত হয়।
◑ গম এ আছে শক্তিশালী এনজাইম ও বায়োকেমিক্যাল যা দূষিত টক্সিন, ভারী ধাতু, রেডিয়েশন এসব থেকে শরীর কে বিশুদ্ধ রাখে।
◑ গমের পাতার রস মুখের দাগ, ব্রণ নিরাময়ে খুব কার্যকরী ভূমিকা রাখে। রোদে পোড়া দাগ ও ম্যাজিক এর মত চলে যায়।
◑ দাঁতের মাড়িকে শক্ত রাখে এই গমের পাতার রস।
◑ মাথায় খুশকির অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতেও এর বিকল্প নেই। এর পেস্ট ১৫ মিনিট মাথায় মেখে শ্যাম্পু করে ফেললে খুশকি মুক্ত থাকা যায়।
দেশে যেহেতু ডায়বেটিস রোগীর সংখ্যা লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়ে চলছে এবং রুটিতে শর্করার পরিমাণ কম তাই ডাক্তার রা ও যেমন রোগীকে ভাত এর পরিবর্তে রুটি খেতে বলেন ঠিক তেমনি অনেকে ডায়বেটিস না হলে ও সচেতনতামূলকভাবে ই রুটি বেছে নিয়েছেন রাতে এবং সকালে।
অনেকের রুটি খেতে ভালো লাগেনা তারা রুটির পাশাপাশি আটা দিয়ে তৈরি অন্যান্য জিনিস বেছে নিচ্ছেন। হতে পারে তা পাউরুটি, বিস্কুট কিংবা অন্যান্য আটা জাতীয় খাবার।
আবার বিকেলের নাশতা তে ও আটার তৈরি স্ন্যাকস এর ব্যবহার লক্ষণীয় যেমন সিংগারা, পুরি, মোগলাই, সমুচা, রোল, লুচি ইভেন ফুচকা পর্যন্ত ও আটা র তৈরি। সব মিলিয়ে এই সেক্টর এর চাহিদা বেড়েই চলছে লক্ষণীয় ভাবে।
একটা সময় হোটেল গুলোতে ভাতের চাহিদা বেশি থাকলেও ইদানীং রুটি বা আটার তৈরি খাবার এর চাহিদা বেশি দেখা যায় বিশেষ করে সকাল, বিকাল এবং রাতে। এর ফলে উৎপাদন বাড়লে ও বিশাল অংকের একটা বাজেট চলে যাচ্ছে গম আমদানীতে। বাংলাদেশ গম আমদানীতে ৫ম। অথচ আজ থেকে কয়েক বছর আগে ও এই র্যাংকিং এ বাংলাদেশ প্রথম ১০ টি দেশের মাঝে ও ছিলোনা। এই একটা জায়গায় তুলনা করলে ই বুঝা যায় যে গমের চাহিদা কতটা বেড়েছে। ২০১৯ এর লাস্ট শুমারি মতে বাংলাদেশ এ গমের আমদানী বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। তবে দেশে যে উৎপাদন বাড়ছে না তা নয়, উৎপাদন ও বাড়ছে। উৎপাদন ও বেড়েছে ২০ শতাংশ৷ এরপরে ও গমের এত ঘাটতি যে আমাদের অবশ্যই আমদানী নির্ভর হতেই হচ্ছে। এই দিকে খেয়াল রেখেও দেশে গম উৎপাদন এর মাত্রা আরো বাড়ানো উচিৎ এবং টাঙ্গাইল জেলা হতে পারে অন্যতম একটি জায়গা গম উৎপাদন এর জন্য যেহেতু এখানকার মাটি, জলবায়ু সব ই গম উৎপাদন এর জন্য উপযোগী।
বহুল সম্ভাবনাময় এই সেক্টর এবং কতটা তা একটু ভাবলে ই হয়তো নিজেরা ও বুঝতে পারবো।
পুষ্টিবীদদের মতে সাদা আটার থেকে লাল আটায় পুষ্টি বেশি থাকে, এবং ভূষিতে আরো বেশি। যদিও রুটি মোটা হয় এর পরেও পুষ্টির দিক থেকে বিবেচনা করলে এগুলো ই শ্রেয়।
তাই গম প্যাকেট এর আটার থেকে বেটার অপশন হলো নিজেরা আটা ভাংগিয়ে খাওয়া৷ কিন্তু কথা হলো জীবনকে আমরা সহজ ভাবে পেতে চাই, সেখানে এত ঝামেলা কে করবে?
উপায় হলো ই-কমার্স।
ই-কমার্স এর মাধ্যমে লাল আটা কিংবা একেবারে বিশুদ্ধ আটা ঘরে বসে পাওয়া সম্ভব। টাঙ্গাইল এ যেমন গমের উৎপাদন অনেক বেশি তেমনি টাঙ্গাইল এ আছে আটার মিল যেখান থেকে নিজের পছন্দ অনুযায়ী লাল আটা ও করে নেয়া যায় এবং সাদা আটাতো অবশ্যই। ই-কমার্স ই পারে এই পুষ্টিগুণে ভরপুর আটাকে দেশের যেকোন প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে, এতে ক্রেতাদের ও ভোগান্তি কমে যাবে নিশ্চিত।
অবশ্যই প্রান্তিক চাষীদের পাশে দাঁড়ানো যায় গম বা গমের আটা র উদ্যোগ নিয়ে ই-কমার্স এর মাধ্যমে। অনেকে ই যদি এই উদ্যোগ নেয় তাহলে আমদানীর পরিমাণ অনেক কমবে বলে ই আশা রাখি। ফ্রেশ লাল আটা যদি ই-কমার্স এর মাধ্যমে সকলের দ্বারে পৌছানো যায় তাহলে এই সেকটরে ভবিষ্যত উজ্জ্বল হবে ইন শা আল্লাহ।