বাড়ি কোথায়? শেরপুর। কোন শেরপুর? শেরপুর জেলার অধিকাংশ মানুষকে এই প্রশ্ন ও রিস্থিতির স্বীকার হতে হয়। দেশের অনেক মানুষই জানে না শেরপুর নামে কোন জেলা আছে। অথচ ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জামালপুর জেলার মহকুমা থেকে আলাদা করে শেরপুরকে জেলার মর্যাদা দেওয়া হয়।
শেরপুরের অতীত ইতিহাস খুবই সমৃদ্ধ। দেশের সবচেয়ে পুরাতন পৌরসভা গুলোর মধ্যে শেরপুর অন্যতম। তৎকালীন ইংরেজ সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যাতায়াত সুবিধার উন্নতিকল্পে ১৮৬৯ সালে পহেলা এপ্রিল শেরপুর পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করেন। তখন এটির নাম ছিল ”সেরপুর টাউন”। কাগজপত্র অনুসারে সেরপুর পৌরসভা নাসিরাবাদ (বর্তমানে ময়মনসিংহ) পৌরসভার আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষিত প্রবীন ব্যক্তিদের সূত্রে জানা যায় দক্ষিণ আফ্রিওকার কেপ-টাউন, আমেররিকার জজ-টাউনের পরেই পূর্ব পাকিস্তানের ”সেরপুর টাউন” এর খ্যাতি ছিল।
বৃটিশ আমল থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে শেরপুর ছিল সমৃদ্ধ। তৎকালীন সময়ে শেরপুরের টাউনের বাগরাকসার অধিবাসী কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাশয় ছিলেন। শেরপুর নয়আনী জমিদার চারুচন্দ্র চৌধুরীর একটি ছাপাখানা ছিল “চারু প্রেস” নামে। এটিতে মীর মোশারফ হোসেনের বিষাদ সিদ্ধু গ্রন্থটি প্রথম এবং ভাই গিরিশচন্দ্র সেন কর্তৃক কুরআন শরীফ অনুবাদের প্রথম সংস্করণ (১০০০ কপি) মুদ্রিত হয়েছিল।
ইংরেজ, জমিদার এবং পাক শানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সমস্যার বৈষম্য দূরীকরণ ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় শেরপুরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। তাই এ জেলার সাথে মিশে আছে গৌরব ও সংগ্রামের ইতিহাস।
দেশের স্বাধীন হওয়ার পর শেরপুর কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের ৬১ তম জেলা ঘোষণা দেয়। রাজনৈতিক কারণে তা স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শেরপুরকে জামালপুর জেলার মহকুমা করেন এবং ১৯৮৪ সালে জামালপুর জেলা ভেঙ্গে ৫ টি উপজেলা নিয়ে শেরপুরকে জেলার মর্যাদা দেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ।
শেরপুরের অতীত ইতিহাস সমৃদ্ধ হলেও জেলার সম্ভাবনাময় পণ্য, জায়গা বা উদ্যোগের পরিচিতি না থাকায় দেশবাসীর কাছে অপরিচিত রয়েগেছে শেরপুর জেলা। এখন সময় এসেছে সম্ভাবনা কে কাজে লাগিয়ে সকলের কাছে স্বতন্ত্র ভাবে শেরপুর জেলাকে পরিচিত করানোর। এতে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে।
২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইনোভেশন সামিটে বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ব্র্যান্ডিংয়ের সিদান্ত গৃহীত হয়। সে সিদান্তের অধীনে শেরপুর জেলা প্রশাসন জেলার ”পর্যটন ও তুলশীমালা ধান/চাল” কে ব্র্যান্ডিং করার উদ্যোগ নেয়। ব্র্যান্ডিং স্লোগনা নির্ধারণ করা হয় “পর্যটনের আনন্দে, তুলশীমালার সুগন্ধে”। এই ব্র্যান্ডিং উদ্যোগের কল্যাণে ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে শেরপুর জেলার পরিচিতি বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে।
শেরপুর গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলা। এ জেলায় রয়েছে সবুজ ও পাহাড়ি সৌন্দর্যের অপূর্ব সমাহার। ছোট বড় প্রাকৃতিক টিলা বেস্টিত বনভূমি, সীমান্ত সড়ক, মধুটিলা ইকোপার্ক, গজনী অবকাশ, রাবার বাগান, পানিহাতা, রাজার পাহাড়, অর্কিড পর্যটন, মাইসাহেবা -ঘাঘড়া খান বাড়ি জামে মসজিদ, পুরাতন জমিদার বাড়ি সহ বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনা।
দেশের সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় কোন কলকারখানার কোলাহল নেই। চারদিকে সবুজ গাছপালা আর বিস্তীর্ণ ফসলি জমির সমাহার। পাহাড়ি ও সমতল এলাকায় কোচ, গারো, হাজং, ডালু, বানাই এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস। দর্শনীয় স্থান দেখার পাশাপাশি প্রকৃতি আর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিজস্ব সংস্কৃতির সাথে পরিচয় হওয়ার চমৎকার সুযোগ রয়েছে পর্যটকদের। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও পর্যটন এলাকার বাঙ্গালীদের ’কমিউনিটি ট্যুরিজম’ বাস্তবায়নে আগ্রহী করা গেলে দেশ-বিদেশের পর্যটকের সমাগম বাড়বে কয়েক গুণ। এতে স্থানীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং শেরপুর জেলার ব্র্যান্ডিং হবে।
রাজধানী ঢাকা সহ দেশের প্রায় অধিকাংশ জেলার সাথে শেরপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত। সবচেয়ে সুবিধার দিক হলো ঢাকা ও আশেপাশের পর্যটকরা শেরপুরে “ডে ট্যুর” করতে পারে। রয়েছে শহরে নিরাপদ রাত্রীযাপনের চমৎকার সুযোগ। কমিউনিটি ট্যুরিজম বাস্তবায়ন হলে প্রকৃতির বা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর খুব কাছাকাছি সময় কাটানোর জন্যে শহরের যান্ত্রিকতার এক ঘেঁয়েমিতা কাটাতে ৩-৪ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনার করতে পারবে পর্যটকরা। তারা মুগ্ধ হবে সাধারণ জীবন যাত্রা ও প্রকৃতির নীরবতায়।
শত বছর আগে থেকে শেরপুরে উৎপাদন হচ্ছে তুলশীমালা ধান। পূর্বে অভিজাত শ্রেণীর কৃষকরা জমিদারদের জন্য চাষ করতো তুলশীমালা ধান। শেরপুরের জমিদাররা এ চালের খাবারে অভ্যস্থ ছিল। জমিদার বাড়িতে ইংরেজদের আগমন হলে তুলশীমালা চালের বাহারি খাবার পরিবেশন করা হতো এবং ইংরেজদের বিদায় দেওয়ার সময় গাড়িতে তুলে দেওয়া হতো তুলশীমালা চাল। স্থানীয় লোকদের কাছে জামাই আদুরি চাল হিসেবে পরিচিত এ চাল। তাই মেহমান আপ্যায়ন বা বিশেষ আয়োজনে গুরুত্ব পায় তুলশীমালা।
দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা প্রজাতির সুগন্ধি আতপচাল উৎপাদন হলেও তুলশীমালা চালের বিকল্প নয়। জেলার নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী উপজেলায় আমন মৌসুমে উৎপাদন হয় তুলশীমালা ধান। তুলশীমালা চাল আকারে ছোট, সুস্বাদু ও সুগন্ধী যুক্ত। এ চাল দিয়ে পোলাও, পায়েস, ভাত, পিঠা, ফ্রাইড রাইস ইত্যাদি করা হয়। এছাড়াও ঘরোয়া বিভিন্ন খাবার তৈরি করা হয়। এ চালের তৈরি খাবারের সবচেয়ে ভালো দিক হলো খাওয়ার পর আরাম লাগে এবং হজমে সমস্যা সৃষ্টি হয় না। তুলশীমালা চালের খাবার ছোট থেকে বৃদ্ধ সকলে পছন্দ করে।
২০২০ সালের শুরুর দিক থেকে ইন্টারনেট আর ফেসবুকে এ চাল নিয়ে ব্যপক প্রচারণা চালানোর কারণে ফেসবুক/ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের একাংশের কাছে পরিচিতি পায় শেরপুরের তুলশীমালা চাল। এতে অনলাইনে দিনে দিনে বাড়ছে তুলশীমালা চালের ক্রেতা, উদ্যোক্তা এবং শেরপুর জেলার পরিচিতি। প্রিয়জনদের তুলশীমালা চাল উপহার দেওয়ার রেওয়াজ অনলাইনেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
তাই আশাকরা যায়, পর্যটন আর তুলশীমালা চালের প্রচারণার ধারা অব্যাহত থাকলে শেরপুরের মানুষেকে মুখোমুখি হতে হবে না ”কোন শেরপুর?” প্রশ্ন ও পরিস্থিতির।
লেখক : মোঃ দেলোয়ার হোসেন, প্রতিষ্ঠাতা- আওয়ার শেরপুর।