সরিষার তেল এর গন্ধে মৌ মৌ করে ঘর। চানাচুর মাখা, মুড়ি মাখা কিংবা অন্য কোন পরিবেশনায় সরিষার তেল এর ঝাঁঝালো সেই গন্ধ নাকে আসবে,, গন্ধের টানেই খাওয়ার ইচ্ছা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে মুড়ি মাখতে গিয়ে চোখের জল গড়িয়ে আসবে। কি সুন্দর সে তেল এর গন্ধ। আহ এ যেন কোন অতীতে ফিরে গেলাম।
না, অতীত না, এখনো সম্ভব, এখনো পাওয়া সম্ভব একদম খাঁটি, বিশুদ্ধ, কেমিক্যাল মুক্ত ঘানিতে ভাঙ্গানো সরিষার তেল।
ঘানিতে ভাঙ্গানো তো অনেক কষ্টসাধ্য একটা কাজ। কষ্ট করতে কে ই বা চায়? যন্ত্রের কাছে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে কালের গর্ভে হাড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের এ শিল্প…
তবে টাংগাইল এ এখন ও আছে ঘানি শিল্প।
কলুর বলদ সবাই শুনেছি আমরা কিন্তু কি আসলে এই কলুর বলদ.?
ঐ যে যারা ঘানি ভাংগা সরিষার তেলের সাথে জড়িত, এই পেশায় জড়িত ব্যক্তি ই হলো কলু। সরিষা পেষার জন্য কলুরা যে যন্ত্র ব্যবহার করে তা হলো ঘানি.. ঘানি এমন একটা যন্ত্র যেখানে বিন্দু পরিমাণ লোহার ব্যবহার হয়না। এত বিশাল এ যন্ত্র যে প্রায় একটা গাছ এতে ই লেগে যায়। আট থেকে দশ ফুট লম্বা একটা কান্ডের অর্ধেকের বেশি মাটিতে পোতা থাকে।। কড়ই কাঠ দিয়ে খুব ভালো হয় এই অংশ টা। যেটা মূলত গাছ নামে পরিচিত। এর উপরে থাকে কাঠের আরেকটি অংশ, সাথে থাকে সরিষা পেষার জন্য লম্বা একটা জাইট যেটা দেখতে অনেক টা ঢেকির ওঁচা র মত । গাছের একটা অংশ বরাবর ছিদ্র থাকে , ছিদ্রের সাথে লাগানো থাকে পাতারি। যা দিয়ে পাত্রে ফোঁটায় ফোঁটায় তেল পরে৷
কিছুদিন আগেও বহুল ব্যবহার করা এই যন্ত্র টি এখন আর দেখা মেলে না বললে ই চলে।। বর্তমানে ইলেকট্রিক মোটর চালিত যন্ত্র দিয়ে কম সময়ে বেশি সরিষার তেল পাওয়া যায়। কলু সম্প্রদায় এর রাত দিন পরিশ্রম এর তেল তাদের সাথে পাল্লা দিতে পারেনা। দামে বেশি, উৎপাদনে সময় লাগে অনেক বেশি, প্রাইস ও অবশ্যই বেশি হয়ে যায়, সব মিলিয়ে এ যেন এক অসম প্রতিযোগিতায় টেকাই দুরূহ হয়ে গেছে।
অথচ একটা সময় ছিলো যখন কত কত কলু ছিলো, যাদের বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে ও দেখা যেত কলুর বলদ চলছে, চোখে মোটা কাপড়ের পর্দা দেয়া, কলু ঘুরছে ঘানির চারপাশে, ঘানি বেয়ে পরছে তেল মাটির পাত্রে। এরপর মাটির সেই হাড়ি নিয়ে কলুরা ছুটছে বাজারে।। এমন ও হতো বাড়ি থেকেই কত তেল নিয়ে যেত অনেক বাড়ির কর্তা কিংবা পাতিল ভরা তেল নিয়ে কলুরা বাড়ি বাড়ি ও ছুটতো৷
সেই দৃশ্য আর দেখা না গেলে ও এটা কিন্তু সত্য যে আমাদের দেশে সরিষা এখন ও অন্যতম একটা ফসল।। যার উৎপাদন হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়। আর এই সরিষার নাম আসলে ই চলে আসে টাংগাইল জেলার নাম কারণ টাংগাইল সরিষা উৎপাদন এর জন্য অন্যতম একটা জেলা।
আমাদের দেশের মধ্যে টাংগাইল অনেক বড় একটা এরিয়া যেখানে বেশ ভালো মানের সরিষা উৎপাদন হয়। প্রায় ৫০০০০ টন সরিষা উৎপাদন হয় এক বছরে।
টাংগাইল এর প্রায় ৪৫০০ পরিবার যুক্ত সরিষা উৎপাদন এবং এ থেকে তেল উৎপাদন এ৷ টাংগাইল জেলার কালিহাতি, বাসাইল, গোপালপুর, মধুপুর, ঘাটাইল, ধারিয়াল, চকপারা, আতিয়া, কদমতলি, তেজপুর, পালাতাইল, রতনগঞ্জ, বল্লা, করটিয়া, চানদি, বেতকা সহ আরো বিভিন্ন জায়গায় চাষ হয় সরিষার, ফলন ও হয় বাম্পার।
এসব এলাকায় অনেক বেপারি ছিলো যারা যুক্ত ছিলো ঐতিহ্যবাহী ঘানির সাহায্যে তেল তৈরির পেশায়। যদি ও এখন অনেকে ই পূর্বপুরুষের এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে।। বাজারে সরিষার তেলের পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে সয়াবিন তেল। মান যেমন ই হোক দামে কম এবং প্রাপ্যতা বেশি জন্য এ তেলের আধিক্য বেড়ে গেছে এমন ই যে ৭০ এর দশকে ও ঘরে ঘরে ঘানিতে ভাংগা তেলের রান্না হলে ও এখন তা খুব ই সীমিত। আমার নিজের দাদুকে ও দেখেছি তিনি সরিষার তেল ছাড়া অন্য রান্না কখনো খাননি।
ভোজ্য তেল এর চাহিদা এত বেশি যে সেখানে সয়াবিন জায়গা করে নিলো সরিষা তেলের। যেখানে ঘানিতে ৫ কেজি সরিষার তেল তৈরি হতে দুই ঘন্টা সময় লাগে সেখানে মেশিন এ মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার৷
একটা করে ঘানিতে দুইটা গরু পালাক্রমে ঘানিতে বদল করতে হয়, একটা ঘানি এক বছর বা তার কিছু সময় বেশি যায়।। গরুর খরচ, ঘানির পিছনে খরচ, গো খাদ্যের অভাব বা এর পিছনের খরচ, যত্ন,তাদের দেখভালের জন্য ও দিনমজুর মিলেনা এখন, শারীরিক পরিশ্রম সব মিলিয়ে যেন মেশিনের বাজেট এর কাছে ধরা ছোয়া হয়না। অনেক সমস্যা তে ই পরতে হয় ঘানির সাথে জড়িত কলুদের। হার না মানতে চাইলেও প্রতযোগীতার বাজারে টিকে থাকি দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে কলু সমাজের।
তবে হ্যা, সুদিন ফিরছে, এ বছর তো সরিষার বাম্পার ফলন ও হয়েছে টাংগাইল এ। চাষীরা খুব ই খুশি। পুরো পরিবার মিলে সরিষা খেতে কাজ করে তারা, এতে প্রোডাকশন খরচ কমে যায়, এক্সট্রা দিন মজুর লাগে না৷। বীজ বপন থেকে সরিষা পাওয়া পর্যন্ত মাত্র দুই মাস সময় লাগে এর ফলে খরচ তুলনামূলক কম হয়। সরিষা পরবর্তী ফসলের জন্য অনেক ভালো , এগুলার উচ্ছিষ্ট পরবর্তী ফসলের জন্য জৈব সারের কাজ করে, ফলন ভালো হয়।
শুধু টাংগাইল এলাকায় ৪৫,৬৬০ হেক্টর হেকটর জমিতে চাষ করা হয় সরিষা, যা বিগত বছর গুলোর তুলনায় বেশি। এখানে লোকাল ভ্যারাইটি এবং হাইব্রীড ভ্যারাইটির চাষ করে চাষীরা। হাইব্রীড সরিষা তে ফলন বেশি হয়। এই ফলন গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এতে ই কিন্তু ধারণা করা যায় এ সরিষার ফলন দিন দিন বাড়বে ইন শা আল্লাহ।
এখানকার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রা ও এখন সরিষা চাষের উপর গুরুত্ত্বারোপ করেছেন এবং তাদের বিভিন্ন বীজ, সার বিনামূল্যে প্রদান করছেন। সবাইকে সম্ভব না হলে ও কিছু কৃষকের কাছে বিনামূল্যে যাচ্ছে এসব বীজ। ট্রেইনিং ও দেয়া হয় যার ফলে আরো কম খরচে ভালো সরিষা উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এসবের মাধ্যমে এ এলাকায় অনেক আগের মত সরিষার আবাদ হবে এবং ঘানি শিল্প ফিরে আসবে বলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রা আশা করছেন।
আসলে আমরা যত ই আধুনিক হচ্ছি কিংবা দিন যত ই যাচ্ছে জনগণের মাঝে স্বাস্থ্যসচেতনতা বেড়ে চলছে। তাই এখন আবার অনেক পরিবারে সরিষার তেল খাবার সহ অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে জায়গা করে নিচ্ছে। সচেতনতাবোধ থেকে মানুষ এখন অর্গানিক পণ্যের খোঁজ করছে। আর ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল যেহেতু অর্গানিক তাই ক্রেতার সামনে পর্যন্ত পৌছাতে পারলেই নিঃসন্দেহে এর চাহিদা সৃষ্টি হবে অনেক বেশি।
ঘানিতে ভাংগা সরিষার তেল মেশিনের তেল কিংবা সয়াবিন তেলের থেকে অনেক বেশি উপকারি। এর স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক বেশি। যেমনঃ
◑সরিষার তেল হজমে সহায়তা করে।
◑এই তেলে বিদ্যমান গ্লুকোসিনক্লেট মলাশয় এবং অন্ত্রের ক্যান্সার রোধে সাহায্য করে।
◑এই তেল এ এক ধরনের উপাদান থাকে যা শ্বাসতন্ত্র পরিষ্কার রাখে৷ এ কারণে এই তেল রসুন এবং কালিজিরার সাথে মিশিয়ে বুকে ও পিঠে মালিশ করলে ঠান্ডা এবং কফজনিত সমস্যায় উপকার হয়। আমার বেবিদের একদম ছোট থেকেই এই পথ্য টা খুব কাজ করে মা শা আল্লাহ ।
◑সরিষার তেল এ থাকে মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট যা হৃদরোগের ঝুঁকি ৭০% কমিয়ে আনতে পারে৷
◑আগে যখন লোশন ছিলোনা তখন কিন্তু একমাত্র সরিষার তেল ই শরীরে মালিশের কাজে ব্যবহার করা হতো৷ ইভেন এখন ও ব্যাথা নাশক হিসেবে সরিষার তেল ম্যাসেজ করা হয়ে থাকে৷
◑পোকামাকড় এবং মশা তাড়াতে এই তেল ব্যবহার করা যায়।
◑রিবোফ্লাভিন এবং নায়াসিন সমৃদধ সরিষার তেল শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে।
◑কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। সামান্য কাটা ছেড়ায় এন্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এসব কিছু বিবেচনায় আবারো প্রাণ ফিরে পাচ্ছে সরিষার তেল। আবারো হাসি ফুটছে কৃষকের মুখের যারা সরিষার সাথে জড়িত।
টাংগাইল এ এই ঐতিহাসিক ঘানি শিল্প এখন ও বিদ্যমান৷ যেহেতু এখানে সরিষার ফলন বেশি তাই টাংগাইল এর বিভিন্ন জায়গায় এই ঘানি এখন ও প্রচলিত আছে। খুব আশা র কথা হচ্ছে এখানে বাসাইল এলাকায় এবং এর আশে পাশে ৮ টি ঘানি আছে, যা এখন এক সাথে পাওয়া আমাদের দেশে ভাবনাতীত।
এছাড়া ও টাংগাইল এ অন্যান্য এলাকায় ও ঘানির দেখা মেলে।তাই নিঃসন্দেহে এখান থেকে ভালো কিছু হওয়া সম্ভব।
শীতের দিনে যেহেতু চাহিদা অনেক বেশি থাকে কিন্তু ঘানিতে ভাংগানো সময় সাকূল্য। দশ কেজি সরিষা থেকে তেল হয় ৩ কেজি বা সাড়ে তিনকেজি সেখানে মেশিনে হয় এর থেকে ঢের বেশি। যার কারনে ঘানি বাদ দিয়ে অনেকেই এখন মেশিনের সাথে জড়িয়ে ফেলতে চায় নিজেদের।।। তবে এই সেক্টর কে ই আরো বিস্তার এর পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে সবার হাতের কাছে ঘানিতে ভাংগানো অর্গানিক তেল পৌছে যায়।
যেহেতু লিকুইড পণ্য অনেক সময় ই কুরিয়ার সার্ভিস গুলোতে ঝামেলা করলেও তা পৌছে দেয়া সম্ভব দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। ইতিমধ্যে টাঙ্গাইল জেলা থেকে এর সাথে ই-কমার্স এ যুক্ত হয়েছেন উদ্যোক্তা। বোতলজাত পণ্য তাই একটু কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করলে ডেলিভারিতে সমস্যা ও হয়না। এই তেল দীর্ঘসময় ভালো থাকে, নষ্ট হয়না, এমনকি বছরের উপর ও কিচ্ছু হয়না।
এটাই সত্য যে যত ই অপ্রতুল হোক ঘানিতে প্রক্রিয়াজাতকরন এ তেল সবথেকে সেরা।। অর্গানিক এ পণ্য সবার হাতের নাগালে পৌছাতে ই-কমার্স সবথেকে বেস্ট মাধ্যম।
এই শিল্প আমাদের টাংগাইল এ আবারো মাথা নাড়া দিয়ে ফিরতে পারে ই-কমার্স এর হাত ধরে৷ কেননা শিক্ষিত সমাজের ই-কমার্স, যারা এখন অনেক বেশি স্বাস্থ্যসচেতন। এই সচেতনতা ই পারে আবারো স্বাস্থ্যসম্মত সরিষার তেল নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ বাড়িয়ে দিতে।। ভেজালের মাঝে খাঁটি র স্বাদ পেতে ইচ্ছুক এখন শহুরে বা গ্রামীন শিক্ষিত সমাজ। এত সরিষার উৎপাদন কেন্দ্র টাংগাইল এ ঘানি ভাংগা সরিষার তেল নিয়ে উদ্যোগ শুরু করে এবং ই-কমার্স এ সেগুলো প্রচার করতে থাকলে এটি ভবিষ্যতে অনেক এগিয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।