মা, মাটি ও আচিক ভাষায় আবিমার টানে যারা পড়ে আছে তারা আমাদেরই বন্ধু, প্রতিবেশী টাংগাইলের ঝরাপাতার শালবন মধুপুরে প্রথম বসতি স্থাপন করা গারো সম্প্রদায়। বারবার তাদের বন থেকে উচ্ছেদ ঘোষণা করলেও ছাড়তে পারেনি এই মা ও ঝরাপাতার গন্ধ। বনের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী গারো হলেও বছরের পর বছর ধরে নেই তাদের ভূসম্পত্তির কোনো দলিল। শত বছরেও তারা খোজে পায়নি। কথায় বলে না –
না থাকুক আমার দলিল খানা
রয়েছে তো আমার মা খানা
তারা সেই মায়ের টানেই নিজস্ব সত্তা নিয়ে আজও বহুকষ্টে পড়ে আছে এখানে। যেখানে তারা এখনও তেমন কোনো কাজ পায় না, হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে প্রতি মূহুর্তে। এতো এতো বাধা অতিক্রম করেই আজ গুছিয়ে নিয়েছে তাদের রাজ্য। যেখানে নিজের দক্ষতা ও নারীবৈসম্যতা দূর করতেই গড়ে তুলেছে তাদের নিজস্ব তাঁতশিল্প সহ নানান কৃষিপণ্যের সমাহার, সেইসাথে সম্মাননা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের গ্রাম গারোপাড়া কে।
গারো পাড়ার একদিকে তাকালে দেখা যায় কলার বিশাল বিশাল বাগান, অন্যদিকে পাহাড়ের ঢাল বেয়েই তৈরি হয়েছে ছোট ছোট মাল্টা গাছ, যেখানে মিশ্র ফসল হিসেবে দেওয়া হয়েছে হলুদ। গারোদের ভাষায় থিরিক(কলা), থারিং(কচু), পেত ইচিং (হলুদ) থা.বালচু ( শিমলাই আলু) , লিচু সহ আরো অনেক কৃষিপণ্য। যা পুরোটাই গারোদের নিজস্ব ব্যাবসার অংশ।
টাংগাইল মধুপুরের জলছএ বাজারের দিকে তাকালে শুধু আনারস ও কলার ছড়িয়ে দেখা যায়। গারোপাড়া ও মধুপুর বনের অধিকাংশ জুড়েই রয়েছে কলার সমাহার।
কলা রুয়ে না কেটোপাত
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত…
এই কথা থেকেই আমরা বুঝতে পারি কলা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থকরী ফসল। যেখানে একটি কলা আমাদের প্রায় ১০০ ক্যালরি শক্তি জোগায় সেখানে পুরো বন জুড়েই কলার চাষ করে থাকে গারো নারীরা। গারোরা তাদের ব্যাবসার সাথে কলাকে কতোটা জড়িয়ে রেখেছে তা আমরা জলছএ বাজারের দিকে একবার তাকালেই বুঝতে পারি। কলাতে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম, ম্যাংগানিজ, আঁশ, ভিটামিন সহ এতো চাহিদা থাকার পরও গারোরা একটা সময় হতাশ হয়।
মৌসুমে তারা এতো কলা বাজারজাত করতে না পারায় দেখা যায় কলা বাগানেই পেকে পচে যাচ্ছে, যা একজন ব্যাবসায়ীর জন্য অনেকটা ক্ষতির কারণ। কলা নিয়ে আমরা বর্তমানে ই কমার্সে অনেক বেশি সম্ভাবনা দেখতে পাই। কারণ এখানে আছে জানা ও জানানোর সুযোগ। যেমন –
🔘 বিচি কলার মোচা সবার অনেক বেশি পছন্দের থাকলেও এটা বাজারে খুব একটা পাওয়া যায় না। যেখানে গারোরা বাণিজ্যিক পর্যায়ে চাষ করে থাকে বিচি কলা। ক্রেতা বা বাজারজাত করার সুবিধা না থাকায় কেটে ফেলে দেওয়া হয়।
🔘 একটা কলা গাছ ফল দেওয়ার পর কেটে ফেলা হয়। অথচ আমরা জানিই না যে গাছের ভেতরে থাকা কেন্জাল কতো মজা। অন্যদিকে কলার গাছ থেকেও তৈরি করা হচ্ছে গোল্ডেন ফাইবার। যা ই কমার্সে দেখাচ্ছে নতুন সম্ভাবনা ।
এমন অনেক তথ্য আছে যা মানুষ প্রকাশের সুযোগ পায়নি। যার কারণে আরও অনেক বেশি পিছিয়ে আছে আমাদের এই গারো সম্প্রদায় সহ আমাদের দেশের অর্থনীতি।
আমরা গারোপাড়ার গির্জার রাস্তা ধরে একটু এগিয়ে আসলেই দেখি সারি সারি লিচু গাছ। যেগুলো একদমই ফ্রেস লিচু। পুরো টাংগাইলের চাহিদা পূরণ করে এগুলো বাজারজাত করা যেতে পারে বাইরে। আমরা টাংগাইলের মানুষরাই একটা সময় জানতাম না এতো মজার লিচু কোথা থেকে আসছে। ছোট কালে যখন দৈনিক লিচু খেতাম জিজ্ঞাসা করলে বলতো গারোপাড়া থেকে এনেছি। অথচ কখনো বলাই হতো না এটা বাণিজ্যিক পর্যায়ে চাষ করা হয় লিচু।
আমরা যখন একটা পণ্যকে শুধুমাত্র ওই গ্রাম বা ওই উপজেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবো তখন তার চাহিদা থাকবে কম ও ব্যাবসায়ীও তার মন মতো দাম পাবে না। যখন এটা পাবলিকলি চলে যাবে তখন এর চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে।
আমরা যদি মাল্টার কথাই বলি, পাহাড়ের ঢালে বেয়ে লাগানো হয়েছে মাল্টা গাছের সারি। প্রথম দিকে গারোরা খুব বেশি হতাশ থাকলেও একটা সময় তাদের দিন ফিরে আসে। একসময় যা আমাদের জন্য স্বপ্নের ফল ছিলো আজ তাই হয়েছে আমাদের হাতের নাগালে। লাল মাটির ঐহিত্য ধরে রাখতেই এই চাষাবাদ। আমাদের দেশের জনপ্রিয়তার শীর্ষে পথচলা আজ মাল্টার যার আবাদ আমাদেরই লাল মাটিতে। মাল্টার আদি উৎপত্তি ভিয়েতনাম, উত্তর পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ চীনে হলেও পাহাড়ি অঞ্চলে গারোরা নতুন করে এর চাষাবাদ শুরু করে অনেক লাভবান।
আসলে আমরা যাই করি না কেন দিনশেষে খুজেঁ বেড়াই ফ্রেস জিনিস। গারোরা বলে থাকেন আমরা ফ্রেস মাটির মানুষ তাই ফ্রেস ফল দিয়েই জিতেছি। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমূহের সমৃদ্ধ উৎস। শরীরের জন্য ভিষণ উপকারী এই ফল গ্রাম থেকেই আজ শহরের সেরা ফলের জায়গা করে নিয়েছে।
আমাদের ই কমার্স যদি আরও এগিয়ে চলা ও ফ্রেস ফলের চাহিদা বৃদ্ধি করে তাহলে নিঃসন্দেহে টাংগাইলের ই কমার্স হবে সেরা। গারোরা হবে কৃষি পণ্যের রাজা।
মধুপুরের গারোদের নিজস্ব একটা পণ্য, যা আমাদের কাছে পুরোপুরি অচেনা, মান্দি ভাষায় যাকে বলা হয় থা. বালচু, আমাদের বাংলায় তাকে বলা হয় শিমলাই আলু। এই আলু মূলত মাটির নিচে হয় আনারস বাগানের মিশ্র ফসল হিসেবে। একটা কান্ড লাগিয়ে দিয়ে মাটির নিচে হয় আলু। যা আমরা ফল হিসেবে সিদ্ধ করে খেতে পারি এবং মাংসের সাথে রান্নাও করতে পারি। হালকা নুনতা লাগে স্বাদে।
এটা পুরোপুরি অচেনা একটা আলুই বলা চলে। লাল মাটি বা মধুপুর যাই বলি না কেন আনারসের রাজধানী। এই আনারসের এতো এতো সম্ভাবনার মাঝেই চাষাবাদ করা হচ্ছে থা. বালচু। যা শুধুমাত্র গারোরা নিজেদের চাহিদা মেটাতে চাষ করে থাকে। বাণিজ্যিক পর্যায়ে কতোটা ভালো করতে পারে তা সম্পর্কে হয়তো তাদের ধারণাও নেই। এইতো কয়েকদিন আগে যখন আমি থা বালচু নিয়ে লিখি ইনবক্সে আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করে কিভাবে পাবো এই আলু। অনেক বেশি চাহিদা থাকলেও আমি মেটাতে পারিনি কারণ এটা শুধুমাত্র গারোরাই চাষ করে থাকে তাদের চাহিদা মেটাতে।
রাজিব আহমেদ স্যারের একটা কথা সেদিন মনে হয়েছিলো, আমরা যদি আমাদের কন্টেন্ট ঠিক রাখি পরিচিতি বাড়াতে পারি তাহলে এফ কমার্সে একদিন ছাই ও বিক্রি হবে। বাস্তবতা কিন্তু তাই মনে হচ্ছে। যেখানে গারোরা তাদের নিজস্ব চাষ করা আলুকে অকেজো মনে করছে সেখানে একটা লিখা পড়ে কাষ্টমার আগ্রহ প্রকাশ করে। এটা আমাদের জন্য হতে পারে বিশাল এক সম্ভাবনাময় পণ্য।
মূল বাগান আনারস।
এটা ফল হিসেবেই শুধুমাত্র জনপ্রিয় নয় বর্তমানে এর পাতার চাহিদাও অনেক বেশি, যা একটা সময় পাহাড়ের মানুষ কল্পনা করতো না। আনারস দুবার ফল দিলে গাছ কেটে ফেলে দেওয়া হতো গরুর খাবারের জন্য। কলা গাছ একবার কলা দিলে কেটে ফেলে নতুন গাছ লাগানো হতো। কিন্তু বর্তমানে এই দুটো গাছ থেকেই তৈরি করা হচ্ছে গোল্ডেন ফাইবার। যা গারোরা সহ মধুপুরের মানুষের জন্য বিশাল এক সুযোগ ও সম্ভাবনা।
ই কমার্সে গারোদের এই পণ্য গুলি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মাত্র সুন্দর করে প্রচারণা পারে এই সংখ্যা লঘু গারোদের নিজস্ব একটা ঐহিত্য গড়ে দিতে। একটু উৎসাহ বা ভরসা দিয়ে যদি কেউ এগিয়ে আসে তারা আরও বেশি আগ্রহী হবে কাজে।যারা মা, মাটি, গারোপাড়া ছেড়ে যায়নি তাদের জন্য এই ফসল গুলোই হতে পারে ভরসা ও নারীদের শক।
লেখক
আমিনা
সত্ত্বাধিকারী- অপরাজিতা -Oporajita