বাঙালির ভুরিভোজে অন্তত এক চিলতে লেবু না হলে চলে না! অতিথিকে খুশি করতে সবার আগে ঠান্ডা ঠান্ডা এক গ্লাস লেবুর শরবতই যথেষ্ট। আবার বিয়ে বাড়িতে বর-বউ কে বরণ করতেও কিন্তু বাঙালির চাই লেবুর শরবত! এদেশে লেবুর এমন হাজারো ব্যবহার রয়েছে, যা লিখতে শুরু করলে শেষ করা দুরূহ হয়ে উঠে।
আর বর্তমানে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে শরীরে ভিটামিন ‘সি’ সরবরাহ করা সবচেয়ে জরুরী। আর শরীরের ভিটামিন ‘সি’ এর চাহিদা পূরণে অন্যতম প্রধান উৎস হতে পারে লেবু। তাই বর্তমানে দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় লেবুকে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে শুধু করোনা থেকে বাঁচতেই নয়, সারবছরই লেবু খাওয়া উচিত ভিটামিন সি এর ঘাটতি পূরণের জন্য। কারণ এর অভাবে শরীরে অনেক রোগ বাসা বাঁধে।
ভিটামিন ‘সি’ দেহের রোগ প্রতিরোধকারী কোষগুলোর কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে বা ক্ষত হলে দ্রুতগতিতে কোলাজেন কোষ উপাদান তৈরি করে ক্ষত নিরাময়েও সাহায্য করে এই ভিটামিন ‘সি’।
এছাড়া বর্তমান যুগে বেশির ভাগ মানুষের প্রধান সমস্যা ওজন বৃদ্ধি, রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বৃদ্ধি। আর এই সমস্যাগুলো থেকে বেরিয়ে আস্তে সাহায্য করতে পারে লেবু।
লেবুর গুনের কথা আসলে বলে শেষ করা যাবে না। শুধু লেবুই যে কাজে লাগে তা নয়, লেবু পাতা এমনকি লেবুর খোসাও অনেক কাজের। এতো সব গুনের কথায় পরে আবার আসছি, আগে বলে নেই ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক পরিসরে উৎপাদিত সীডলেস বা বীজ বিহীন লেবুর কথা।
বীজবিহীন বারোমাসি বিনালেবু-১ যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) গবেষকদের হাত ধরে। ভিয়েতনামের একটি স্থানীয় জাত থেকে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে দীর্ঘ সময় গবেষণার পর সফল হয়েছিলেন তারা। আশানুরূপ ফলন হওয়ায় ২০১৮ সালে ‘বিনালেবু-১’লেবু কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য নিবন্ধিত করে জাতীয় বীজ বোর্ড।
এ লেবুর বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বারোমাসই ফলন দেয়। এটি সুগন্ধিযুক্ত ও বীজবিহীন। এটিতে রসের পরিমাণও বেশি এবং ভিটামিন-সি এর পরিমাণও বেশি। প্রতি গাছে প্রতি মৌসুমে ২৫০-৩০০ টি লেবু ধরে।
বিনা লেবু-১ রোপণের ১০ থেকে ১১ মাস বয়সে ফল পাওয়া যায়। একটি গাছ ১৫ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে। এ লেবু চাষ অত্যন্ত লাভজনক হওয়ায় এর কদর দিনদিনই বাড়ছে। বর্তমানে ময়মনসিংহসহ দেশের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে চাষ হচ্ছে এ লেবু।
প্রচলিত জাতের তুলনায় বিনালেবু-১’র ফলন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেশি। বিনার উদ্ভাবিত লেবু চাষের মাধ্যমে এক বিঘা জমিতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করেই বছরে লক্ষাধিক টাকা আয় করা সম্ভব। তাই এ লেবু চাষে আগ্রহী হচ্ছেন কৃষকরা। সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং লেবু চাষের জন্য পতিত জমি লিজ দিয়ে উপকৃত হচ্ছেন ভূমির মালিকরাও।
ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে বীজহীন লেবু চাষে সাফল্য
গৌরিপুর উপজেলা
ময়মনসিংহের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় ঘেঁষে গৌরীপুর উপজেলার কাশিয়ারচর এলাকায় পাঁচ একর জমি লিজ নিয়ে এ লেবু চাষ করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন বিনা গবেষকরা।
এ লেবুবাগানের পাশেই নারী উদ্যোক্তা জেসমিন আরা কাজল সাত একর জায়গা লিজ নিয়ে একটি নার্সারি গড়ে তুলেছেন। সেখানে ৫০ হাজার বিনালেবু-১ জাতের চারা উৎপাদন করা হয়েছে। এখানে কাজ করছেন বেকার যুবকসহ অনেক নারী। সেখান থেকে চারাগুলো স্বল্পমূল্যে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
গফরগাঁও উপজেলা
ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার মনির হোসেন বারোমাসি সীডলেস লেবু চাষ করে সাফল্য অর্জন করে রোল মডেল হয়ে উঠেছেন এলাকার অন্যান্য বেকার যুবকদের জন্য।
মাত্র ২০ হাজার টাকা পুজি নিয়ে শুরু হয়েছিল তার পথ চলা। ৩০ শতক জমিতে প্রথমে তিনি তিনশ বারোমাসি সীডলেস লেবু চারা রোপণ করেন। আর এখন পর্যন্ত তিনি ৬০ হাজার কলম চারা উৎপাদন করে প্রতিটি কলম ৫০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন।
বছরে প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন শুধু কলম চারা বিক্রি করে। তার সাফল্যে অনেক বেকার যুবকরা অনুপ্রাণিত হয়ে বীজহীন লেবুর চাষ শুরু করে সাফল্যের পথে হাঁটতে চলেছেন।
ভালুকা উপজেলা
ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলার তামাইট বাজার এলাকার জাহিদ হাসান ৪০০ কলমের চারা দিয়ে তিন বিঘা জমিতে বাগান শুরু করলেও আজ তিনি ১৫ বিঘা জমিতে সীডলেস লেবু চাষ করছেন। লেবু চাষে ঘুরেছে তার ভাগ্যের চাকা এখন তিনি ৩০ বিঘা জমিতে করছেন লেবু সহ নার্সারী ব্যবসা যেখানে মাতৃ গাছের ছায়ন কেটে তৈরি হচ্ছে লক্ষ্য লক্ষ্য গাছের চারা।
জাহিদুল হাসানের লেবুবাগান থেকে মাসে ২ বার লেবু বাজারজাত করতে হয়। অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে তার লেবুবাগানে। গাছের খাবার হিসেবে জৈব সার ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করা হয়না তার বাগানে। দুই থেকে তিন বছরের একটি লেবু গাছ থেকে বছরে প্রায় ১০ হাজার টাকার লেবু বিক্রয় করা যায়। এছাড়া লেবুর সারা বছরই চাহিদা থাকে ফলে এটি একটি লাভ জনক চাষ বলে মনে করেন জাহিদুল হাসান।
ভালুকা উপজেলার কাচিনা ইউনিয়নের আরেকজন সফল লেবু চাষী মাজহারুল ইসলাম শামীম। তিনি পেশায় একজন ওয়েব ইঞ্জিনিয়ার হলেও, পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বন্ধুদের নিয়ে নিজ গ্রাম ভালুকা উপজেলার কাদিগড়ে ২০১৮ সালে ৮ একর জমিতে মাল্টা ও লেবু চাষ শুরু করেছিলেন।
১৫ একর জমিতে বারি -১ জাতের মাল্টা ও ১০ একর জমিতে সিডলেস জাতের বীজবিহীন লেবু চাষ করছেন এবং উনিশ সালে সারে পাঁচ হাজার গাছের লেবু বিক্রি করেছেন ১২ লাখ টাকা। ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত তারা ৯হাজার গাছ থেকে ২০ লাখ টাকার লেবু বিক্রি করেছেন।
এছাড়াও ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলার নকলার অনেক চাষীরা এই বিশেষ বীজবিহীন লেবু চাষ করে সফল হয়েছেন। আর তাদের সাফল্য দেখে প্রতিনিয়ত আরও অনেক কৃষক যুবক এই লেবু চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
লেবুর যত গুণগান
লেবু পাতার গুন ও ব্যবহার
শুধু লেবুই নয়, লেবু পাতাও বিভিন্ন গুণে সমৃদ্ধ। এমনকি পুষ্টিবিদদের মতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে লেবুর চেয়ে কিনা লেবুর পাতাই বেশি স্বাস্থ্যকর!
লেবুর পাতার ঘ্রাণ বমিভাব কাটাতে সাহায্য করে।
লেবুর পাতার রস শরীরের বাড়তি ওজন নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করে।
লেবু পাতার রসের সাথে বেকিং সোডা মিশিয়ে ব্যবহার করলে দাঁতের কালচে ভাব দূর হয়।
লেবুর মতই লেবু পাতা কচলে বানানো শরবত সব ক্লান্তি দূর করে দিতে পারে নিমিষেই।
বাচ্চাদের পেটে কৃমির সংক্রমণ দেখা দিলে ১০ গ্রাম লেবু পাতার রসের সঙ্গে ১০ গ্রাম মধু মিশিয়ে খাওয়ালে ১০-১৫ দিনের মাঝে সংক্রমণ রোধ করা যায়।
এছাড়া লেবু পাতা দিয়ে বানানো চা, লেবু পাতার ভর্তা সহ, অঞ্চল ভেদে রান্নার স্বাদ বাড়াতে অনেক রান্নায়ই ব্যবহৃত হয় লেবু পাতা।
লেবুর খোসার গুন ও ব্যবহার
লেবুর রসের চেয়ে লেবুর খোসায় ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি ভিটামিন সি। লেবুর খোসার ভিতরে রয়েছে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফাইবার, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং বিটা ক্যারোটিন।
প্রায় ১০০ গ্রাম লেবুর খোসায় ১৩৪ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ম, ১৬০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, ১২৯ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি এবং ১০.৬ গ্রাম ফাইবার রয়েছে। আর্থ্রাইটিস, অস্টিওপোরোসিস, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো রোগগুলোকে সারিয়ে তোলে এ উপাদানটি।
খুব সহজেই সংরক্ষণ করা যায় লেবুর খোসা। রোদে শুকিয়ে গুড়ো করে অর্গানিক চা বানিয়ে কিংবা খাদ্যদ্রব্যের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
এছাড়াও লেবুর খোসার শুকনো গুড়ো দিয়ে রূপচর্চায় ব্যবহৃত প্রাকৃতিক স্ক্রাব এবং ফেস প্যাক তৈরি করে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া ঘরের বিভিন্ন কাজে যেমন আসবাবপত্র, ফ্লোর, ফ্রীজ, বাসনপত্র, এমনকি হাত-পা পরিষ্কার করতেও লেবুর খোসা খুব কাজে দেয়।
লেবুর খোসার মধ্যে উপস্থিত ফাইবার বা আঁশ অন্ত্রকে পরিষ্কার রাখে। এটি হজমে সাহায্য করে এবং পেট ফোলাভাব রোধেও সহায়তা করে। লেবুর খোসা ওজন কমাতে সাহায্য করে। এর মধ্যে যে পেকটিন রয়েছে তা অন্ত্রের শর্করা শোষণ করতে সাহায্য করে এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্যও লেবুর খোসা বেশ ভালো। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং বিপাকে সাহায্য করে। এটি হাড়ের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে।
তবে লেবুর খোসাতে অক্সালেট থাকে বলে বেশি পরিমাণে খাওয়া যাবে না। কারণ অক্সালেট অতিরিক্ত গ্রহণ করলে কিডনি ও পাকস্থলিতে পাথর হতে পারে। তাই দিনে সর্বোচ্চ তিন চামচ খাওয়া যাবে।
লেবুর গুন ও ব্যবহার
লেবুর গুন ও ব্যবহার সম্পর্কে সবাই অবগত, এই আর্টিকেলের শুরুতেও আলোচনা করা হয়েছে। তাই এখানে আলাদা করে খুব বেশি কিছু লেখার নেই।
সকালে খালি পেটে মধু মিশ্রিত গরম লেবু জল খেলে ওজন নিয়ন্ত্রনে সহায়ক হয়। এই মিশ্র্ন মাথা ব্যথা আর ক্লান্তি দূর করতে, ত্বককে ভালো রাখতে ও ঠান্ডা-কাশি প্রতিরোধেও সাহায্য করে।
লেবুর রসের সাথে চিনি মিশ্রিত করে মুখের ফেসিয়াল স্ক্রাব হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
মুরগির স্যুপের সঙ্গে লেবুর রস মিশিয়ে খেলে দুর্বলতা কমে। ক্যানসার বা অস্ত্রোপচারের পর এভাবে স্যুপ খেলে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব।
খেলাধুলার পর লেবুর শরবত খেলে শরীরে ইলেকট্রোলাইটসের ভারসাম্য রক্ষা হয়।
তবে বেশি ভালো ফল পাওয়ার আশায় পুরো একটা লেবু বা একাধিক লেবু একসাথে খেয়ে ফেলা যাবে না, এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়, গ্যাস্ট্রিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
যেহেতু একিসাথে অধিক স্বাদযুক্ত, রসে টুইটুম্বুর এবং ঘ্রাণযুক্ত লেবু মানুষ খুঁজে বেড়ান, তাই সীডলেস লেবু হতে পারে সবার জন্য সেরা সমাধান।
এই উদ্ভাবিত সম্ভাবনাময় নতুন জাতের লেবুর প্রচারণা যত বাড়বে, কৃষি সেক্টরে তত বেশি উদ্যোক্তা তৈরী হবে। এটাই চাচ্ছেন বীনা এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তারা উদ্যোক্তাদেরকে সব ধরণের সুবিধা দিতে প্রস্তুত।
তাই সীডলেস বা বীজবিহীন এই লেবুর সম্ভাবনা ও সাফল্যের গল্পগুলো ই-কমার্স ও মিডিয়ার মাধ্যমে সারাদেশে ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে দিতে হবে।
বর্তমানে ছাদ বাগানের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায়, ই-কমার্স সেক্টর কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তারা এই জাতের লেবুর চারা সরবরাহ করতে পারে শহরের বাড়িগুলোতে।
আবার প্রক্রিয়াজাত লেবু পাতা ও লেবুর খোসার গুড়া বিভিন্ন কাজের জন্য ব্যবহার উপযোগী করে প্যাকেজিং করে সরবরাহ করতে পারে সারাদেশেই।
সর্বোপরি, বীনা উদ্ভাবিত ময়মনসিংহ অঞ্চলে উৎপন্ন এই সীডলেস লেবু দেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে এক নব বিপ্লবের সূচনা করতে পারে।