এদেশের চিরায়ত সংস্কৃতির সাথে শীতলপাটির ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত অন্যতম কুটির শিল্প হচ্ছে শীতলপাটি। আমাদের দেশের মা বোনেরা শীতলপাটি বিছিয়েই যুগের পর যুগ ধরে কাঁথা সেলাই করে আসছে। গ্রামীণ জীবনের সাথে যেন ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে আছে এই শীতলপাটির কাহিনী।চৈত্রের কড়া দাবদাহে খানিকটা আরাম বাতাস গায়ে লাগানোর জন্য আজও গ্রাম বাংলার মানুষজন শীতলপাটি বিছিয়ে উঠোনের কোনো এক গাছের নিচে বসে পড়ে। গরমে শীতলপাটিতে শুয়ে বা বসে যে প্রশান্তি পাওয়া যায় অন্যকিছুর সাথে তার তুলনা হয় না।
পাটি সাধারণত ৪ ধরনের হয়ে থাকে- সাধারণ পাটি, ডালার পাটি,শীতল পাটি,বুকার পাটি। শীতলপাটি এদের মধ্যে প্রথম পছন্দের তালিকায় ও সুনাম কুড়িয়েছে বেশি। শীতলপাটির চাহিদা এখনও কোনো অংশে কমেনি। মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান হচ্ছে বিয়ে। বিয়ের অনুষ্ঠান কিন্তু শীতলপাটি ছাড়া চলেই না। বিয়ের অনুষ্ঠানে হলুদ সন্ধ্যায় কনেকে বসানো হয় শীতলপাটির উপর। আধুনিকতার এই যুগেও কনে সাজানোর আনুষাঙ্গিক জিনিসের সাথে দেয়া হয় শীতল পাটি।আর সেই পাটিতে বসে কনেকে সাজানো হয়। এটি আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতি যা আদিকাল থেকেই চলে আসছে। এজন্যই বলা যায় সেই যুগ আর এই যুগ সব যুগেই শীতলপাটির চাহিদা বরাবরই বেশি।
“আসুক আসুক মেয়ের জামাই
কিছু চিন্তা নাইরে
আমার বিছানায় বিছাই থইছি
কামরাঙা পাটি নারে।”
পল্লীকবী জসীমউদ্দিন তার বিখ্যাত ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থে শীতলপাটিকে কামরাঙা নামে ব্যবহার করেছেন।ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলার মাটিকে কারুকাজের শীতল পাটির সাথে তুলনা করেছেন।
“চন্দনেরই গন্ধ ভরা
শীতল করা ক্লান্তি হরা
যেখানে তার অঙ্গ রাখি
সেখানটাতেই শীতল পাটি।”
যুগে যুগে শীতলপাটিকে নিয়ে কত গান, কাব্য রচিত হয়েছে তা গুনে শেষ করা যাবে না।
শীতলপাটি তৈরির প্রধান উপকরণ হচ্ছে মুর্তা গাছ। অঞ্চল ভেদে এই গাছকে একেক নামে ডাকা হয়ে থাকে। কেউ কেউ পাটি বেত, আবার কেউ মোস্তাক গাছ বলেও চেনে। গাছ গুলো সরু ও বেশ লম্বা। টাংগাইল জেলার কালিহাতী, ঘাটাইল,দেলদুয়ার উপজেলার কিছু কিছু গ্রামে মুর্তা গাছ বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করা হয়। জেলার মাটি ও আবহাওয়া মুর্তা গাছ চাষের জন্য উপযুক্ত। সমতল জায়গার মাটি বেশ উর্বর হওয়ায় বেতগুলো বেশ উন্নত মানের হয় । আর সেই বেত দিয়ে তৈরি পাটিও টেকসই ও আরামদায়ক হয়।মূলত বেতের উপর নির্ভর করে পাটি নরম হবে নাকি শক্ত হবে।বেতগাছ গুলো পতিত জায়গায় লাগিয়ে দেয়া হয় এবং বছরে একবার কিনবা দুইবার আগাছা পরিষ্কার করে দিলেই চলে।জমিতে আলাদা সার দেওয়ার কোনো প্রয়োজন হয় না। যে জমিতে সার প্রয়োগ করা হয় সেখানে উৎপন্ন বেত দিয়ে পাটি তৈরি করলে পাটি বেশ নরম হয়। এজন্য জমিতে সার না দেয়াই উত্তম। বর্তমানে অনেক মানুষ ধানের পরিবর্তে এই পাটি বেত গাছ বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করছে।আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় অনেক পরিবারের মূল জীবিকাই হচ্ছে এই মুর্তা গাছ চাষ।
শীতলপাটিগুলো দেখতে যেমন সুন্দর এর নামগুলোও ঠিক তেমনি সুন্দর। টিক্কা, সিকি,আধুলি,নয়নতারা,আসমান তারা নানা রকম বাহারি নাম। শীতলপাটিগুলোতে একেক কারিগর একেক নকশা বুনন করে থাকে।অবশ্য চাহিদা অনুযায়ী নকশার মধ্যেও তারতম্য দেখা দেয়। কি বাহারি সব নকশার নাম জামদানী নকশা, পুকুর নকশা, ঢেউ নকশা, যোগ নকশা, সাপা নকশা, তারা নকশা ইত্যাদি। চমৎকার নকশা ও রঙে কারিগররা শীতলপাটি গুলোকো সাজিয়ে তোলা । বুননকৃত পাটিগুলো বেশ মসৃণ হয় যাতে পাটিতে বসে কিনবা শুয়ে আরাম পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে মসৃণ হয় সিকি নামক শীতলপাটি। হাত দিলেই সিকি শীতলপাটির মসৃণতা টের পাওয়া যায়।
শীতল পাটি বুননে প্রথমেই মুর্তা গাছের গোড়া থেকে কান্ড কেটে আলাদা করতে হয়। তারপর যত শাখা ডালা,পাতা আছে সেগুলো কাস্তে দিয়ে কেটে ফেলে দিতে হয়।কাটা ডালগুলোকে ভালোভাবে পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হয়।এরপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো লম্বালম্বি ফালি বা বেতি বের করা। এক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে বেতিগুলো যতটা সম্ভব সরু, চিকন ও পাতলা হয় যেন। কেননা বেতি যত সরু ও পাতলা হবে পাটি তত মসৃণ হবে।তারপর কাটা বেতিগুলো একসাথে বেঁধে বিড়া বানাতে হবে।এরপর চলে বিড়াগুলো সিদ্ধ করার পালা।পাতিলে পানির সাথে ভাতের মাঁড় মিশিয়ে বেতের বিড়াগুলো সিদ্ধ করতে হয়।সাধারণ পাটি তৈরি করতে বেতিগুলো সিদ্ধ করার কোনো দরকার হয় না। কিন্তু শীতলপাটি তৈরি করতে বেতিগুলো অবশ্যই সিদ্ধ করতে হয়।রঙিন শীতলপাটি বুননে বেতিগুলো রং করা হয়।এক্ষেত্রে বেতিগুলো রঙ করার জন্য পানি ও ভাতের মাড়ের সাথে কৃত্রিম রং ব্যবহার করা হয়ে থাকে।এতে করে বেতিগুলো আরো নরম ও মসৃণ হয়। সিদ্ধ করা এই বেতিগুলো রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। বেতিগুলো যদি আরো সরু করার প্রয়োজন মনে হয় তবে আবারো এগুলো বটি কিনবা দা দিয়ে চিকন ও পাতলা করা হয়। এই কাজটি করার জন্য আঙ্গুলে অবশ্যই কাঁপড় পেঁচিয়ে নিতে হয়। কারণ রোদে শুকিয়ে বেতিগুলো বেশ শক্ত হয়ে যায়। আঙ্গুলে যাতে আচর না পড়ে কিনবা কেঁটে না যায় এজন্য সাবধানতা অবলম্বন করাই ভালো। বেতিগুলো আবার খানিকটা রোদে দিয়ে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। এরপরই শুরু হয় আসল কাজ।একে দশ আঙ্গুলের কৌশল বললে অবশ্যই ভুল হবে না। একজন দক্ষ কারিগরের দশ আঙ্গুল দিলেই কিন্তু বুনন করা হয় এক একটি শীতলপাটি। কারিগররা মেঝেতে বসে তাদের পছন্দ অনুযায়ী কিনবা ক্রেতার চাহিদা মতো ডিজাইন, নকশা এবং বিভিন্ন সাইজের পাটি বুননের কাজ করে। পাটিগুলো নকশা,সাইজ ও দক্ষতার উপর ভিত্তি করে বুননে একেক পাটির একেক সময় লাগে।প্রতিটি পাটির দাম নির্ভর করে এর গুণগত মান, নকশা ও ডিজাইনের উপর। তবে গড়ে পাটির দাম ৩০০ থেকে ১০০০০ এর মত হয়।
টাংগাইল জেলার ৩টি উপজেলা কালিহাতি,ঘাটাইল,দেলদুয়ারে শীতলপাটি তৈরি করা হয়ে থাকে। এইসব এলাকায় মানুষজন বংশ পরম্পরায় এই কুটির শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।তারা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে পরিবারের অন্যতম আয়ের উৎস হলো এই শীতলপাটিগুলো।অনেক অনেক নতুন ও পুরাতন কারিগর আছে যারা শীতল পাটি তৈরিতে খুবই পারদর্শী। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি এই পাটিগুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। ফলে জেলায় তৈরি করা পাটিগুলোর চাহিদা অনেক বেশি।একসময় সুদূর কলকাতা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাটিগুলো রপ্তানি করা হতো।
কালিহাতি উপজেলার সিলিমপুর, বাগুটিয়া,চাটিপাড়া,পাটিতাপাড়া,মহিষজোড়া,আউলটিয়া,পিটুটিয়া,খিলদা গ্রামের পাইত্রা সম্প্রদায়ের অসংখ্য পরিবার পাটি তৈরির সাথে যুক্ত। এ গ্রামগুলোতে শীতলপাটির বুননের সাথে সাথে সাধারণ পাটি, ডালার পাটি ও বুকার পাটি তৈরি করা হয়। প্রতি মঙ্গলবার বাগুটিয়াতে পাটির বিশাল বড় হাট হয়। যেখানে অনেক অনেক পাইকাররা পাটি কিনতে ভীড় করে। ঘাটাইল উপজেলার বেশ কিছু গ্রাম মুর্তা গাছ আবাদ এবং পাটি তৈরির জন্য বিখ্যাত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গ্রাম হচ্ছে বানীবাড়ি,রৌহা,কুতুবপুর,চক-পাকুটিয়া, নাগবাড়ি। গ্রামের স্থানীয় পাটিয়ালরা রামপুরে সপ্তাহে দুইদিন সোমবার ও বৃহস্পতিবার হাট করে। হাট জুড়ে থাকে বিভিন্ন নকশা ও সাইজের পাটি।
টাংগাইল জেলার সবচেয়ে বেশি শীতলপাটি তৈরি করা হয় দেলদুয়ার উপজেলায়। প্রায় ২০০ বছর ধরে এখানে বংশ পরম্পরায় পাটি বুনন করা হচ্ছে। শুধুমাত্র হিঙ্গানগর নামক এক গ্রামেই দুই হাজার পরিবারের মানুষদের প্রধান জীবিকা হচ্ছে এই শীতলপাটি বুনন। ছোট থেকে শুরু করে বুড়ো নানা বয়সের পরিবারের সদস্যরা এই পাটি তৈরির কাজগুলোতে অংশগ্রহণ করে। হিঙ্গানগর গ্রাম ছাড়াও দেলদুয়ারের বিশাল একটা অংশজুড়ে এই পাটি বেত আবাদ ও পাটি বুনন হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। আটিয়া ইউনিয়নের এলাসিন,সিংহরাগী,গাজিয়া বাড়ি,নল্লাপাড়া এবং দেউলি ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রাম এর অন্তর্ভুক্ত। পুরো দেলদুয়ার উপজেলায় হাজার হাজার পাটি তৈরি হয় প্রতি সপ্তাহে। ফলে এখানে সপ্তাহে দুইদিন পাটির হাট বসে। বিন্নড়ি নামক গ্রামে প্রতি মঙ্গলবার ও শুক্রবারে সকাল ১০ টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত পাটির হাট বসে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও মাত্র দুই ঘণ্টায় এই হাটে লাখ লাখ টাকার শীতলপাটি বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা ভীড় জমায় পাটি কেনার জন্য। কথিত আছে হাটে কোনো খুচরা বিক্রি হয় না।পাইকাররা পাটিগুলো নিয়ে যার যার গন্তব্য চলে যায়। পরবর্তী সপ্তাহে আবারো একই রকম জমজমাট শীতলপাটির হাট হয়, এভাবেই চলছে ২০০ বছর ধরে। তবে চাহিদায় কখনো ভাটা পড়েনি। নিত্য নতুন নকশা, মন কাড়া ডিজাইন এবং টেকসই এই শীতলপাটি গুলো কত কত কাহিনীর জন্ম দেয় একেক পরিবারে তা বলে শেষ করা যাবে না।
শীতলপাটির কথা লিখতে গিয়ে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেলো। যখন ছোট ছিলাম, দাদু উঠোনের মাঝখানে শীতলপাটি বিছিয়ে দিতো। সেখানে বসে মাটির খেলনা হাঁড়ি পাতিল দিয়ে খেলতাম, কখনো কখনো পুতুলের বিয়ে দিতাম।আহা ছোটবেলার সেই দিনগুলো আজও মনে পড়লে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে বারবার । আমাদের জেনারেশনটা নব্বই দশকের। তখন স্মার্টফোন ছিলো না।পুতুল খেলা ও রান্নাবান্না খেলা প্রায় মেয়েদেরই খুব পছন্দের খেলা ছিলো।এছাড়াও মাঠে কত দৌঁড়ঝাপ করতাম। এখন তো বাচ্চারা সব চার দেয়ালের মাঝে বন্দি জীবন কাটায়।সকাল, দুপুর ও রাত তিনবেলাই সবাই মিলে শীতলপাটিতে বসে খাবার খাওয়ার সেই দিনগুলো খুব করে মনে পড়ছে আজ। রাতের বেলা দাদু বালিশ এনে দিতো। শীতল পাটির মধ্যে শুয়ে শুয়ে আকাশের চাঁদ দেখতাম আর তারা গুনতাম। দাদু বলতো তোর দাদা ঐ দূরের আকাশের তারা হয়ে গেছে।কত কত কাহিনী, রুপকথার গল্প শোনাতো দাদু।বাংলার গ্রামীণ জীবনে এরুপ হাজার হাজার কাহিনী প্রতি ঘরে ঘরে জন্ম নিয়েছে শীতলপাটিকে ঘিরে।ফলে বলতেই পারি শীতলপাটিকে কেন্দ্র করে আমার ছোটবেলার স্মৃতি আবেগতাড়িত হয়ে আজো বেঁচে আছে।
বর্তমানে শীতলপাটি শুধু পাটি হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে না। শীতলপাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ডিজাইনের ব্যাগ,জুতা, বিভিন্ন অলংকার কানের দুল,চুরি,মালা ইত্যাদি । ভাবা যায় সাজসজ্জার এসে পড়েছে শীতল পাটির ব্যবহার। শুধু সাজসজ্জা নয় ঘরবাড়ির শোভাবর্ধক হিসেবেও শীতলপাটির ব্যবহার হচ্ছে । শীতলপাটি দিয়ে টিস্যু বক্স, টেবিলম্যাট, নানা ডিজাইনের শোপিস, ওয়ালমেট তৈরি হচ্ছে। এগুলোর চাহিদা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।শীতলপাটি প্রাকৃতিক গাছ থেকে বুনন করা হয়। এটি একই সঙ্গে কারুশিল্প ও লোকশিল্প। আমাদের প্রান্তিক মানুষেরও যে শৈল্পিক মন কম নয় তার পরিচয় বহন করছে এই শীতলপাটি। শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্ব দরবারে সুখ্যাতি অর্জন করেছে আমাদের এই শীতলপাটিগুলো।যেহেতু শীতলপাটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য ফলে এটি দ্বারা বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে। যা আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। উপযুক্ত প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে শীতলপাটি ই-কমার্স সেক্টরে সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে সক্ষম।
লেখক,
ইসরাত জাহান জীম
স্বপ্নডিঙ্গা