শরীর ঝিমুনি তে এক কাপ কফি হলে যেন পুরো শরীরের এনার্জি বুস্টিং হয়৷ আড্ডার ফাঁকে একটু খানি কফি মানেই আড্ডা জমে গেলো বেশ।। ট্রেইনিং কিংবা কোন সেমিনার বা কনফারেন্স টি ব্রেক বা কফি ব্রেক তো আছেই। চা না কফি এই তর্কে গেলে তর্ক যেন লম্বা হতে ই থাকবে কিন্তু সবকিছুর পরে ও আমরা জানি চা র পাশাপাশি কফি ও এখন সমান তালে জায়গা করে নিয়েছে আড্ডার ফাঁকে, কাজের ফাঁকে, একাকিত্ত্বের সংগী হিসেবে কিংবা আলাপচারিতার মাঝে।
কফির জনপ্রিয়তা এখন আকাশচুম্বী কোন সন্দেহ নেই, বিশ্বের ২য় বাণিজ্যিক পানীয়। চা তে তো আমরা স্বনির্ভর এবং চা আমাদের প্রয়োজন মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বাহিরে৷ কিন্তু কফি? কফি চাষে আমরা পিছিয়ে থাকলেও কফি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি অর্থকারী ফসল আমাদের দেশের জন্য৷ আর এই সম্ভাবনায় এগিয়ে আছে আমাদের টাঙ্গাইল জেলা।
কফি এলো কোথায় থেকে? এত পছন্দের পানীয়, যার ইতিহাস জানতে আমরা হয়তো সবাই আগ্রহী।
একেবারে সঠিক ব্যাখ্যা না থাকলে ও বলা হয়ে থাকে কফির জন্মস্থান ইথিওপিয়াতে। সেখানে নবম শতকের দিকে একজন রাখাল তার ছাগল পালের দিকে খেয়াল করে দেখছিলো যে ছাগল বিশেষ একটা গাছের ফল খেয়ে প্রতিবার ই কেমন অদ্ভুত আচরণ করে। এর পরে ই সেই রাখাল ও ঐ ফল খায় এবং খেয়াল করে যে ঐ ফল খেয়ে নিজেকে কেমন উদ্যোমী , ফ্রেশ লাগে। পরবর্তীতে সেই ফল মসজিদ এর ইমাম এর কাছে নিয়ে গেলে তারা আগুনে পুড়ে ফেলে কিন্তু আগুনে দেয়ার সাথে পুরে না গিয়ে অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে পরে চারদিকে। ইমাম এর ছাত্র এবং এলাকার লোক উৎসুক হয়ে পরে গন্ধে, পানিতে মেশায় নরম করে খেয়ে দেখার জন্য এবং হয়ে যায় আজকের কফির আবির্ভাব।। এমন টা ই পাওয়া যায় কফির ইতিহাস ঘাটলে ।।
চা বা কফি ব্রেক রীতি চালু হয়েছিলো আমেরিকায় আঠারো শতকের প্রথম দিকে তবে বাংলাদেশে কফির জনপ্রিয়তা শুরু হয় ২০০৫ সালে, সেই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার একটি ব্রান্ড ঢাকায় আনা হয়। এরপর ই প্রায় ৫ থেকে ৬ বছরে কফি এতটা ই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে কফিকে ঘীরে অনেক ব্রান্ড, অনেক বাণিজ্য গড়ে উঠে৷ শুধু ঢাকা শহরে ই কফির প্রিমিয়াম আউটলেট আছে ৫০ টি র বেশি।।
এই যে এত কফি প্রেমী, কফিকে ঘীরে এত আবেগ, এত এটাচমেন্ট আমাদের অথচ দুঃখজনক হলে ও এটাই সত্যি যে এই কফি র ৯৫% ই আমাদের আমদানী করতে হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানিকৃত কফির পরিমাণ ৩২.৫৬৭ টন। আমাদের দেশে যা ও উৎপাদন হয় তার ৯০% ই উৎপাদন হয় পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলায় এবং বান্দরবান এ বেশি। অথচ আমাদের টাংগাইল এর মধুপুর, সখীপুর এর পাহাড়ি এলাকা গুলো কফি চাষের জন্য খুব ই উপযুক্ত। এখানের ঢালু পাহাড়ি এলাকা, এখানকার মাটি তে কফির বাম্পার ফলন হতে পারে। এখানকার মানুষের আয়ের খুব ভালো একটি উৎস হয়ে উঠতে পারে এই কফি কেননা কফির চাহিদা সম্পর্কে কম বেশি আমাদের সকলের ই ধারণা আছে।
পৃথিবীতে প্রায় ৬০ জাতের কফি হলেও বাংলাদেশ এ দুই ধরনের কফির চাষ হয়। একটি আফ্রিকার জাত কফিয়া ক্যানিফোরা যা রোবাস্তা কফি নামে পরিচিত। অন্যটি কফিয়া অ্যরাবিকা যার আরেকটি নাম পর্বত কফি বা কফি এরাবিকা। রোবাস্তার ফলন অ্যারাবিকার চেয়ে আড়াই গুণ বেশি কিন্তু অ্যারাবিকার স্বাদ ও ফ্লেভার রপবাস্তার চেয়ে বেশি তাই চাহিদাও বেশি।
কফির ফলন ভালো হয় হালকা ছায়াতে, পাহাড়ি অঞ্চল যেখানে পানি জমবেনা, সেচ এর ও তেমন দরকার নেই। কফি চাষের উপযোগী মাটি হলো গভীর, ঝুরঝুরে, জৈব পদার্থ ও হিউমাস সমৃদ্ধ মাটি। একেবারে ঝামেলাবিহীন একটা ফসল কিন্তু সাহস, ইচ্ছা এবং নতুন উদ্যোগ গ্রহনের অভাবে তা পিছিয়ে আছে।
তবে হ্যা, আশার আলো জ্বালিয়েছেন টাংগাইল এ মধুপুর উপজেলার মহিষমাড়া গ্রামের সানোয়ার হোসেন। চা কফির তীব্র নেশা থেকে শখের বসে ই প্রথমে কফির চাষ শুরু করেন তিনি। ২০১৬ সালে বান্দরবান এর রায়খালী কৃষি গবেষণা কেন্দ্র থেকে ২০০ চারা আনেন। এর মাঝে তিনি চাষ করছেন রোভাস্টা এবং এরাবিকা নামক কফির দুইটি জাত।
তিনি খুব ই সন্তুষ্ট এ কাজে কেননা তার চারা লাগানোর দুই বছর পর প্রতিটি গাছে প্রচুর ফুল এবং ফল এসছে। তিন বছরের মাথায় প্রতি গাছ ফুলে ফলে ভরে গেছে। ছোট ছোট লাল কফিতে পূর্ণ তার কফি বাগান, দেখে মনে হয় কফির রাজ্য এখানে। লাল কফিগুলো এক সময় কালো হয় এবং এই কালো কফিকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় শুকালে কফির বিন পাওয়া যায়। এরপরে তা মেশিনে গুড়া করা হয়। প্রথম আবাদেই তিনি ৭০ থেকে ৮০ কেজি কফির বিন পান, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক চারা করার জন্য রেখে দেন এবং বাকি অর্ধেক কফিন বিন গুঁড়ো করেন। প্রথমে সরঞ্জামাদি না থাকলে ও এখন তার এ কাজে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় প্রশাসন এবং তাদের সহযোগীতা করায় তিনি ভীষণ আশাবাদী। স্থানীয় প্রশাসন ও কফি নিয়ে সানোয়ার হোসেন এর এ উদ্যোগ কে সাধুবাদ জানিয়েছেন এবং এটা অনেক বেশি ফলপ্রসূ বলে ই মনে করেন।
কফি যেহেতু দীর্ঘমেয়াদি একটা ফল, কফি চাষের জন্য আলাদা জমির ও প্রয়োজন নেই, পাশাপাশি অন্যান্য ফলমূল, আদা, হঁলুদ অনেক কিছুই চাষ করা, তাছাড়া উৎপাদন ব্যয় ও অনেক কম। সব মিলিয়ে কৃষিখাতের এ সম্ভাবনায় সানোয়ার হোসেন কোন লস দেখেন নি বরং তার এই কফি বাগানের সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে কিছু কর্মী যাদের জীবনে ও স্বচ্ছলতা এসেছে তার এই কফির উদ্যোগ এর কারণে ই। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই কফির চাষে তাকে দেখে অনেকেই ভীষণ ই আগ্রহী হয়েছেন এবং তার কাছ থেকে চারার প্রসার ও সম্ভব হয়েছে।
ইউরোপ এর বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত কফি এখন আমাদের দেশে চাষ হচ্ছে। পাশাপাশি এটা আমাদের জন্য বড় একটা বিপ্লব যে কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট এ বহুল আবাদি রোবাস্তা ও অ্যারাবিকা দুই জাত মিলিয়ে আরেকটি জাত প্রস্তাবনায় আছে যা হলো বারি কফি-১। এই জাতটি সকলের জন্য প্রসার হলে কফির রোগ বালাই একদম কমে যাবে এবং উৎপাদন ও বেশি হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় বীজ বোর্ডের সদস্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় এর বীজ অনুবিভাগের মহাপরিচালক বলাই কৃষ্ণ। আমাদের দেশের জন্য কফি এতটাই সম্ভাবনাময় যে কফি ও কাজুবাদান উৎপাদন জোড়দার করতে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বারি সম্প্রতি সোয়া ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছেন। এখানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এর অধীনে থাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের চারা ও জমি দেয়া হবে এবং চাষাবাদ পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াজাতকরণের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এ থেকেই বোঝা যায় কফি নিয়ে কতটা চিন্তাভাবনা চলছে এবং এসব প্রকল্পে বিবেচনাধীন আছে আমাদের টাঙ্গাইল জেলা।
কফির চারা উৎপাদন অনেক সহজ প্রক্রিয়া এবং ৬ মাস পরে ই নতুন চারা করা যায়। তাই বাংলাদেশের যে কোন হর্টিকালচার সেন্টার হতে পারে কফির চারা উৎপাদন এর কেন্দ্র যদি তারা উদ্যোগ নেয়।
কফি শুধু পানীয় হিসেবে না, কফি থেকে পাওয়া সম্ভব মধু এবং শ্যাম্পু ও। মধুর জন্য কফি বাগানে কয়েকটি গাছের মধ্যেকার ফাঁকা জায়গায় বসাতে হবে আর্টিফিশিয়াল মধুর বাক্স, মধু গাছে ফুল আসলেই মৌমাছরা সেখানে বসবে এবং ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে কাঠের ঐ বক্সে বাসা বাঁধবে। পাশাপাশি কফি গাছের অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে বানানো যায় শ্যাম্পু ও।
অতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীরের জন্য ক্ষতি হলেও গবেষণায় দেখা গেছে মানসিক চাপের সময় ২০০ মি.গ্রাম ক্যাফেইন শরীরে গেলে মনোযোগ বৃদ্ধি পায়৷ এছাড়া ও কফি উদ্যোম ও উৎসাহ তৈরি করে।
যেখানে দেশে ১ হাজার টনের বেশি কফি আমদানি করতে হয় এবং আমাদের দেশে মাত্র ৫৫ হাজার কেজি র মত কফি উৎপাদন হয় তাই অবশ্যই কফি উৎপাদন আমাদের দেশের জন্য অনেক সম্ভাবনাময় একটা সেক্টর। কফির এ বিপুল চাহিদা নিরসনে যদি অনেকে উদ্যোগ নেয় তাহলে আমদানী নির্ভরতা অনেক কমে আসবে এবং দেশের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। পাশাপাশি অনেক অনেক কর্মসংস্থান এর সুযোগ তৈরি হবে।
যেহেতু আমাদের মধুপুর এবং সখীপুর এলাকা, এ এলাকার মাটি ও আবহাওয়া কফি চাষের জন্য উপযুক্ত তাই অবশ্যই নতুন উদ্যোগ সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা আছে। দীর্ঘকালীন সময় বলে পিছিয়ে না গিয়ে এই উদ্যোগ কে সামনে আনতে হবে এবং একটা কথা সব সময় ই মনে রাখতে হবে পুরো মধুপুর এলাকায় যেহেতু কৃষির অনেক সম্ভাবনা তাই এখানে উদ্যোগ নিয়ে এই সেক্টর কে সমৃদ্ধ করা সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
ই-কমার্স এর আওতায় যদি এই সম্ভাবনাময় কফি কে আনা যায় অবশ্যই তা সাফল্য মন্ডিত হয়ে থাকবে। কেননা কফি এমন ই পানীয় যার সাথে আমাদের নিত্যদিনের সম্পর্ক এবং ই-কমার্স এর অনেক বেশি প্রচারণা ই পারে এই সম্ভাবনা কে নিশ্চিত সাফল্যে রূপ দিতে।