শীত আর গুঁড় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের এ জীবনে তা শহুরেই বলি কিংবা গ্রামীণ জীবন। শীতের সময় পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে আমাদের দেশে। শহর গ্রাম নির্বিশেষে গুঁড় এর খীর, পিঠা পুলি তে মেতে উঠে, হয় পিঠা উৎসব যার মেইন উপকরণ ই এই গুঁড়। অপরদিকে আঁখের এক গ্লাস রস যে কতটা ক্লান্তি মেটায় সারা দিনের তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি।
নদীর পাশের গ্রামে ছোট বেলায় ঘুড়তে গিয়েছিলাম আঁখের সিজনে। সেই সময়ের দৃশ্য আজ ও চোখে ভেসে উঠে, এই লেখাটা লিখতে গিয়ে আজ ও মনে হচ্ছে সেই গুঁড় এর গন্ধ পাচ্ছি। অনেক এলাকায় কুঁশের ও বলা হয় হয় আঁখ কে। একদিকে যেমন আঁখের রস ক্লান্তি নিবারণ করে অন্যদিকে আঁখ থেকে প্রাপ্ত চিনি বা গুঁড় এর কদর নিয়ে নতুন করে কি ই বা বলবো৷ পিঠা, পুলি উৎসব, পায়েশ বা মিষ্টিমুখ কিছুই এই জিনিস ছাড়া সম্ভব না। এ তো আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের ই অংশ।
আঁখ এর প্রোডাক্ট চিনি বা গুড় খুব মিষ্টি হলেও এর অতীত এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক বেদনাদায়ক ইতিহাস। মূলত আঁখ চাষ শুরু হয় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া তে। কত হাজার বছর পূর্বে তা কেউ ই জানেনা। তবে ভারতবর্ষে আঁখ এর মিষ্টি রস এর সাথে বহুকাল এর সম্পর্ক। তখন চিবিয়ে রস খাওয়া হতো এবং রস জ্বাল দিয়ে ঘন করে সিরাপ এর মত খাওয়া হতো৷ তবে আশ্চর্যজনক হলে এটাই সত্যি যে আজ ব্রাজিল এ সবথেকে বেশি আঁখ হয় অথচ এটা একেবারেই অপরিচিত একটা উদ্ভিদ ছিলো ব্রাজিল এ।
ইউরোপবাসীর কাছে একটা সময় মধুভরা কান্ডের গাছ হিসেবে এটি ছিলো খুব বিস্ময়কর একটা উদ্ভিদ৷ ১৪৯২ সালে পাড়ি জমায় এটি ইউরোপ মহাদেশে ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর সাথে। তার হাত ধরেই আঁখ চলে যায় ডোমিনিকান রিপাবলিক এ এবং ছড়িয়ে পরে সারা ব্রিটিশ কলোনিতে। ব্রিটিশদের কাছে এক সময় চিনির অনেক বেশি কদর ছিলো, চিনিকে বলা হতো হোয়াইট গোল্ড, যার কারণে আঁখ ছিলো অনেক মূল্যবান। তবে সেই চিনির সাথে একটা কালো অধ্যায় ছিলো যা হলো দাসপ্রথা, কেননা তখন আঁখের খামারে কাজ করার মত লোকবল ছিলোনা, তাই দাসদের ধরে নিয়ে এখানে কাজ করানো ছিলো অনেকটা সময় ধরেই চলমান।
এভাবে আস্তে আস্তে সারা বিশ্বে কত কত দেশ এ যে ছড়িয়ে পরে আঁখ। তবে আঁখ উৎপাদন এ ভারত, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, চীন, কিউবা, মেক্সিকো, মিশর, জ্যামাইকা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই, ফ্লোরিডা এবং লুসিয়ানা বিখ্যাত হলে ও বাংলাদেশেও অনেক পরিমাণে ই আঁখ উৎপন্ন হয়।
আঁখ বাংলাদেশ এর অন্যতম অর্থকারী ফসল যা ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ এর গোত্রেই পরে। বাংলাদেশ এর আবহাওয়া ও মাটি আঁখ চাষের জন্য খুব ই উপযোগী। প্রায় প্রতিটি জেলাতেই কিছু না কিছু পরিমাণ আঁখ উৎপন্ন হয়৷ আঁখ উৎপাদন এ অন্যতম জেলা আমাদের টাঙ্গাইল।
টাংগাইল এ ১২ টি উপজেলার মধ্যে সখীপুর ও ধনবাড়ি বাদে বাকি ১০ টি উপজেলাতে ই চাষ হয় আঁখ।এর মাঝে সদর উপজেলা, নাগরপুর, ভুয়াপুর এবং দেলদুয়ার অন্যতম, যেখানে অনেক বেশি পরিমাণে আঁখ উৎপাদন হয়।
গত বছর টাংগাইল জেলায় ৫৫৯ হেক্টর জায়গা ছিলো আঁখ চাষের জন্য লক্ষ্যমাত্রা, তবে চাষ হয়েছিলো ৭৮৬ হেক্টর জুড়ে, যা লক্ষ্যমাত্রারবচেয়ে ২২৭ হেক্টর বেশি। এ বছর এ লক্ষ্যমাত্রা আরো বেশি। কেননা দিন বাড়ার সাথে গুড় এর চাহিদা কখনো ই কমেনা। আর চিনিতো আছেই সারাবছর জুড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে। তবে বিশ্বের উন্নত অনেক দেশে যেখানে অত্যাধুনিক চিনিকল আছে যেখানে আঁখে বিদ্যমান চিনির প্রায় ৮৫ থেকে ৮৭ ভাগ চিনি নষ্কাশন করা যায়, আর সেখানে বাংলাদেশে মাত্র ৬০ থেকে ৭০ ভাগ যা অনেক কম এবং প্রতি ১০০ কেজি আঁখ থেকে চিনি পাওয়া যায় মাত্র ৭ থেকে ৮ কেজি। ।।
টাংগাইল জেলা আঁখ চাষের জন্য সুপ্রসিদ্ধ। এখানে বেশি চাষ করা হয় অমৃত, রং বিলাশ, ঈশ্বরদী-১.২, সিএসি ২০৮ জাতের আঁখ৷ এগুলো চিবিয়ে খেতেও ভালো লাগে৷ টাঙ্গাইল সদর বা বিভিন্ন এলাকাতেই দেখা যায় গাড়ি নিয়ে সবাই এর জ্যুস বিক্রি করছে৷ যদিও এগুলো স্বাস্থ্যসম্মত নয়, তবে যদি বাসায় এনে জ্যুস করে খাওয়া হয় তবে এর স্বাস্থ্যউপকারিতা অনেক বেশি৷ আমাদের এ জেলায় অনেক বছর আগে থেকে চাষ হয় , এখানে যেহেতু চিনিকল,নেই তাই মূলত গুঁড় এর জন্যই ব্যবহার করা হয় এইসব আঁখ এবং ট্রান্সফার ও করা হয় অন্য জায়গায়।
আখের গুঁড় এর গ্রাম হিসেবে পরিচিত এমন গ্রাম ও আছে টাঙ্গাইল। কালিহাতি উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়ন এর অনেক ভেতরের চরাঞ্চলের দিকে একটা গ্রাম আছে যেখানে আশে পাশে দিয়ে হেটে যেতেও গুড় এর গন্ধ নাকে আসে। এমনকি সেই গন্ধ কেউ পাশ কাটিয়ে যেতে পারে না। চরহামজানি গ্রাম। অনেক আগে থেকে এই যেমন চাষ হয় আঁখ এর তেমনি তৈরি হয় গুড়। তাইতো এই মৌসুমে কেউ ই এই এলাকার পাশ দিয়ে হেটে গেলে এর গন্ধ থেকে পাশ কাটতে পারেনা।
এই সময়টায় একদিকে নারী পুরুষ নির্বিশেষে আঁখ কেটে আনে পাতা ঝড়িয়ে, অন্যদিকে মেশিনের সাহায্যে কারিগর রা সেই আঁখ থেকে রস বের করে এবং ঠিক এই মেশিনের পাশেই বড় বড় উনুন এ বড় লোহার কড়াই এ অনবরত জ্বাল দেয়া হয় সেই রস। দুই থেকে তিন ঘন্টা জ্বাল দেয়ার পর সেই রস গুলো এত ঘন হয় যা ১৫ থেকে ২০ মিনিট ঠান্ডা করলে ই জমে গুড় হয়। এরপর কারিগর রা এর আকৃতি দিয়ে দেয়, হয়ে যায় আমাদের পছন্দের মজার গুড়।।
প্রতিদিন প্রায় ৭ থেকে ৮ কড়াই গুড় রস জ্বাল দেয়া যায়, প্রতি কড়াই থেকে পাওয়া যায় প্রায় ৬০ কেজি গুড়। যেহেতু আঁখ একটি বর্ষজীবি উদ্ভিত তাই বছরের বেশ কয়েকটা মাস ই এই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়, মূলত শীতকালীন পুরো সময়টা তো থাকেই।
এই গুড় টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ না। চলে যায় ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা সহ অন্যান্য অনেক জেলাতে৷
আঁখের গুড় যেমন খেতে সুস্বাদু তেমনি এর উপকার ও অনেক। যেমনঃ
☞গুঁড় খেলে আমাদের দেহের তাপমাত্রার সামঞ্জস্যতা থাকে সেটা যে কোন সিজনে ই।
☞এতে রয়েছে ক্যালোরিফিক যা শীতকালে দেহকে উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে। আবার গরম কালে সজরীর কে ঠান্ডা রাখে।
☞ক্ষতিকর বিভিন্ন ধরণের অনুজীব এর বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
☞খুসখুস কাশ, গলা ব্যাথায় বেশ কার্যকরী। বুকে কাশ জমা থেকে রক্ষা করে।
☞রক্তকে পরিষ্কার রাখে এবং রক্ত প্রবাহে সমস্যা ব্যাহত করে। রক্তে হেমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়।
☞যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য তাদের জন্য খাবারের পর খালি এক মুঠো গুড় খুব বেশি উপকারী।
☞শরীরের এনার্জি বাড়াতে সহায়তা করে।
আঁখ এর গুড় যেমন উপকারী আমরা কম বেশি সবাই জানি এর রস কতটা উপকারী। এর রসে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানীজ, আয়রন, জিংক, থিয়ামিন, রাইবোফ্ল্যাভিন এত উপকারি উপাদান থাকে যে শরীর এর স্ট্রেস কমায় ম্যাজিক এর মত৷ তাছড়া প্রেগন্যান্সিবতে, কনস্টিপেশন এ, কিডনি ভালো রাখতে এর ভূমিকা অনেক বেশি। আঁখ চিবিয়ে খাওয়ার ফলে দাঁত এর মাড়িও শক্ত হয় অনেক বেশি।
আঁখ এর গুড় এর উপকারীতা, আঁখ এর রস এর উপকারীতা এবং চিনি সব মিলিয়ে ই আঁখবচাষে চাষীদের আগ্রহ দিনদিন এখন বাড়ছে। যদিও মাঝখানে শংকাজনক হারেই কমেছিলো চিনির দাপটে৷ তবে এখন বিভিন্ন জেলায় তৈরি হচ্ছে ব্রাউন সুগার যা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক বেশি ভালো।
এসবের পাশাপাশি আঁখ থেকে তৈরি হয় মদ, এলকোহল, জ্বালানি, আখের ছোবড়া এবং গবাদি পশুর খাবার এর জন্য ও এই সিজনে আঁখ ভরসা হয়ে দাঁড়ায়৷ এর পাশাপাশি পরিত্যক্ত অংশ দিয়ে কিন্তু কাগজ ও তৈরি হয়৷ এক সময় টাঙ্গাইল এ দেলদুয়ারে ছিলো কাগজের মিল যা এখন আর নেই।
আঁখ থেকে পাওয়া যায় এত পণ্য পাশাপাশি আঁখ এর সাথে সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন ধরণের সবজি যেমন বোনা কপি, বাঁধা কপি, মিষ্টি লাউ, শাক এসব ফসল আবাদ করছে চাষীরা। যার ফলে আঁখ এখন চাষীদের কাছে অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। চলতি বছর সাড়ে সাত হাজার এর ও বেশি চাষী যুক্ত আছেন এই আঁখ ব্যবসায়। এটি অনেক বড় সম্ভাবনা আমাদের জন্য৷
সারাবছরের প্রয়োজনীয় মিষ্টান্ন গুড় নিয়ে ই-কমার্স এ কিন্তু রয়েছে বেশ সম্ভাবনা। তাছাড়া আঁখ এর মৌসুমে আঁখ ও সম্ভাবনাময়৷ গত বছর করোনার পর থেকে ই বেড়ে ই চলেছে ই-কমার্স এ নিত্য নৈমিত্তিক পণ্যের ব্যবহার। সম্ভাবনা রয়েছে খুব বেশি শুধু প্রচারণা দরকার। প্রচার হলে ই হবে প্রসার এবং এই সেক্টর এ তৈরি হবে উদ্যোক্তা।
ই-কমার্স এ প্রয়োজন সুন্দর কন্টেন্ট এর। আমরা গুঁড় এর ব্যবহার, উপকারীতা, প্রস্তুতত প্রণালী, বিভিন্ন রেসিপি এসব শেয়ার করতে পারি, ফুটিয়ে তুলতে পারি কন্টেন্ট এর মাধ্যমে। তাহলে ই এই সেক্টর ও নজড়ে আসবে৷ এগিয়ে যাবে ই-কমার্স এর হাত ধরে। আমরা যত বেশি লেখালেখির মাধ্যমে এ সেক্টর কে তুলে ধরার চেষ্টা করবো তত বেশি এগিয়ে যাবে এইসব পণ্যগুলো মার্কেট সাইজ বড় হবে। ক্রেতা বিক্রেতা উভয়পক্ষই আগ্রহী হবে৷ তাই প্রসারের জন্য ও আমাদের প্রচারে মনোযোগী হতে হবে তবেই দেশ স্বাবলম্বী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়বে অবশ্যই।