সৃষ্টির শুরু থেকেই আমরা খাদ্য ও চিকিৎসা তে উদ্ভিদ এর উপর নির্ভরশীল। চিকিৎসার ক্ষেত্রটাতে ভেষজ উদ্ভিদ সবথেকে এগিয়ে। ফলিত ও প্রযুক্তি বিজ্ঞান অনেক বেশি উন্নত এখন এটায় যেমন দ্বিমত নেই তেমনি নতুন আবিষ্কার এর সাথে ভেষজ ওষুধ ও প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে তাতেও কোন সন্দেহ বা বিতর্কের অবকাশ নেই। পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ ভেষজ ওষুধের উপর নির্ভর করে তাদের চিকিৎসা করে থাকেন। অসংখ্য মানুষ তাদের সুস্থতার জন্য ডিপেন্ড করে ভেষজ ওষুধ এর উপর৷ এর ই সত্যতার উপর ভিত্তি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভেষজ ওষুধের ব্যবহার করার সুপারিশ করেন৷ যার রেশ ধরে বহুদেশ এ এখন ভেষজ উদ্ভিদ চাষ এর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে৷ বংলাদেশেও এখন ঔষুধি গুণ সম্পন্ন অনেক উদ্ভিদ চাষ করা হয়৷ তেমনি একটি উদ্ভিদ হলো সুইট ফ্ল্যাগ। যা চাষে মধুপুর এর চাষীরা পাচ্ছেন সাফল্য৷
আমাদের দেশের জন্য একদম ই নতুন একটি উদ্ভিদ ভেষজ গুণসম্পন্ন এই উদ্ভিদ টি আবাদ এর প্রচলন শুরু হয়েছে দেশের বিশেষ কিছু জায়গায়। টাঙ্গাইল এর মধুপুর এ কয়েকজন চাষী এই উদ্ভিদ চাষে খুব ই সন্তুষ্ট হচ্ছেন এবং বাণিজ্যিক ভাবেই চাষ করছেন।।
উদ্ভিদটি প্রায় ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের ও আগে দেখা যায় মিশরে৷ ইজিপশিয়ান রা এটা কে মেডিসিনাল প্ল্যান্ট এর আওতায় ফেলেন। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশেও এর দেখা মেলে। ১৬ শতাব্দীর দিকে আনুমানিক ১৫৯৬ সালে ব্রিটেন এ এটির দেখা মেলে। এরপর আস্যে আস্তে তা ইউরোপিয়ান দেশ গুলোতে বিস্তার লাভ করে। এখন এটি ভারত, সেন্ট্রাল এশিয়া, দক্ষিণ রাশিয়া, সাইবেরিয়া, নর্থ আমেরিকা, নেপাল, চীন তে বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করা হয় এর ভেষজ গুণের জন্য।
এর আরো কিছু কমন নাম আছে৷ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্নভাবে পরিচিত। যেমন সুইট সোয়ে (sweet sway), মুস্করাট রুট (muskrat root), ফ্লাগ রুট, গ্ল্যাডন, সুইট ক্যান (sweet cane), সুইট রুট (sweet root), সুইট রাশ ( sweet rush), পাইন রুট (pine root), সুইট গ্রাশ ইত্যাদি।।
প্রায় ২ মিটার লম্বা এ গাছটি কিছুটা আমাদের দেশের হলুদ এর পাতার মত ই পাতা। এর পাতা থেতানো হলে ঝাঝালো সুগন্ধ পাওয়া যায়। দারুচিনির মত ও কিছুটা বলে একে মিষ্টি দারুচিনি ও বলা হয়। এর যেমন ভেষজ গুণ আছে তেমনি খুব ই সুন্দর ফুল ও ফোটে। সবুজাভ হলুদ রং এর ফুল দেয় গরমের শুরুতে বা বসন্তের শেষে।
সুইট ফ্লাগ এর আছে বিশেষ কিছু ব্যবহার। আসলে বহু যুগ থেকেই এই গোত্রের উদ্ভিদ ব্যবহার করা হয় এবং বাণিজ্যিক ভাবে এর ব্যবহার অনেক বেশি হয়৷ যেমনঃ
☞ বিভিন্ন রোগ এর জন্য যেমন ব্যবহার করা হতো তেমনি ব্যবহার করা হয় সুগন্ধি প্রসাধনীর জন্যও৷ ইউরোপে এটি খাবারের ফ্লেভার এ ব্যবহার করা হয়, এলকোহল হিসেবে৷ ইভেন এটি এক সময় ক্যান্ডি তৈরিতে ও ব্যবহার করা হতো৷ ৩০ সে.মি. অর্থাৎ কান্ড যখন বেশি পরিপক্ব নাহয়, তখন এটি খাওয়া যায়৷ এএ শিকড় ধুয়ে, পিষে, জ্বাল দিয়ে সিরাপ তৈরি করা যায় যা ক্যান্ডি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়৷ এর সুন্দর গন্ধের জন্য খাওয়া হলেও নির্দিষ্ট মাত্রায় সেবন করতে হয়ে অবশ্যই৷
☞এছাড়াও চীন, ভারত, নেপাল এ এর বহুল ব্যবহার আছে ওষুধ হিসেবে৷ পাতা, কন্ড, শিকড় সব কিছুই প্রক্রিয়াধীন করে ব্যবহার করা হয়৷
☞এটি কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
☞এছাড়া এর দ্বারা তৈরি ওষুধ জ্বর, ব্যথা, মাথা ব্যাথা, গ্যাস্ট্রিক, এজমা, দাঁত এর চিকিৎসায়, ব্রংকাইটিস, ডায়বেটিস চিকিৎসা তে ব্যবহার করা হয়৷
☞পেট এর সমস্যায় এর শিকড় টুকরো করে চিবিয়ে খেলে বা জ্যুস করে খেলে খুব দ্রুত রিকভার হয়৷
☞এর দ্বারা উৎপাদিত চা ঘাঁ, পুঁজ, পোড়া, আলসার এসনের জন্য খুব ই উপকারী৷
এত এত ভেষজ গুণসম্পন্ন এ উদ্ভিদ চাষের জন্য ও তেমন এক্সট্রা যত্নের প্রয়োজন হয়না৷ নীচু জমি বা কর্দমাক্ত জমি কিংবা বন্যায় যেখানে ধান নষ্ট হয়ে যায়, পুকুর বা নদীর পাড়ে এমন জায়গাতেই অনায়াসে এটি চাষ হয়ে যায়৷ এর জমিতে পানি জমে থাকে, সেই পানিতে মাছ ও চাষ করা সম্ভব, অনেকেই তাই করছে। এছাড়াও এই গাছ পরিবেশবান্ধব তাই মাটি ক্ষয়রোধ করে।
টাঙ্গাইল এর মধুপুর উপজেলার ০৯ নং ওয়ার্ড এর হবিপুর গ্রামের মহিউদ্দিন সুইট ফ্লাগ চাষ করে হয়েছেন স্বাবলম্বী এবং তার এ সাফল্য থেকে এ উপজেলার আরো অনেকেই সুইট ফ্লাগ চাষ শুরু করেছেন৷ বন্যা বা পানিতে নষ্ট হওয়ার ভয় নেই জন্য ধান চাষের বিপরীতে অনেকেই এই চাষ শুরু করেছেন৷
মহিউদ্দিন এর পূর্বপুরুষ সবাই কবিরাজ চিকিৎসার সাথে জড়িত৷ আর এর রেশ ধরেই অনেক ঔষধি গাছ ও তিনি সংগ্রহ করেন৷ কিন্তু সুইট ফ্লাগ এর মত বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করতেন না কিছুই৷ তবে ২০১২ সালে তিনি ভারত থেকে প্রথম কিছু চারা আনেন এবং চাষাবাদ শুরু করেন। এরপর এক বছরেই তিনি এক একর থেকে ৩০ মন ফলন পান৷ একই জমিতে দুই বছর রাখলে ফলন বেড়ে হয় ৬০ মন। এভাবে আস্তে আস্তে তিনি জমির পরিমাণ ও বাড়াতে থাকেন। এখন ১০ বিঘার বেশি জমিতে তিনি এর চাষ করছেন এবং এ কয় বছরে ৫০ লাখ টাকার মত তিনি এটি বিক্রি করেছেন।
চকবাজারে ঔষধি গাছের আছে বিশাল খোলাবাজার৷ প্রায় ১০০ টির বেশি দোকান আছে এখানে৷ ট্রাক এ ট্রাক এ পণ্য নিয়ে যায় অনেক ব্যবসায়ী মনপ্রতি ৮০০০ টাকা৷ শুকনা মৌসুমে চারা কাটিং এর মাধ্যমে গাছ উৎপন্ন করা হয় এবং শুকনা মৌসুমে তা সংরক্ষণ ও করা হয়৷ তার এই চারা থেকে তিনি এলাকার অনেককেই স্বল্পমূল্যে চারা দিয়েছেন এবং অনেকেই হয়েছে স্বাবলম্বী৷
দেশে উৎপাদিত বার্ষিক মোট ভেষজ উদ্ভিদ এর পরিমাণ এখনো অজানা। তবে আমাদের দেশে বর্তমানে প্রায় ৩ শতাধিক ইউনানী ও ২ শতাধিক আয়ুর্বেদিক ঔষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ২০ হাজার টনের ও বেশি ভেষজ কাঁচামাল এর চাহিদা রয়েছে৷ এছাড়াও বাংলাদেশে প্রতি বছর সাড়ে ৩০০ থেকে পৌনে ৪০০ কোটি টাকার ভেষজ সামগ্রী আমদানি করা হয়। এ থেকেই সহজেই অনুমেয় যে কি পরিমাণ চাহিদা ভেষজ উদ্ভিদ এর।
ওষুধের আদি ও মূলভিত্তি হলো ভেষজ উদ্ভিদ। এখনো অসংখ্য আধুনিক এলোপ্যাথি ওষুধ তৈরি হয় সরাসরি উদ্ভিজ্জ দ্রব্য এবং সেগুলোর নিষ্কাশিত রাসায়নিক উপাদান দিয়ে। তেমনি একটি ভেষজ উদ্ভিদ সুইট ফ্লাগ একেবারেই নতুন আমাদের দেশের জন্য, এরপর ও বছরে এর চাহিদা ১০০০ টন এর উপর৷ যার ফলে যে কজন ই এটা চাষ করছেন তারা খুব বেশি ব্যবসাসফল হচ্ছেন, অত্যধিক চাহিদার কারণে বাজারমূল্য বেশি, উৎপাদন খরচ কম তাই সবাই সাফল্য ও পাচ্ছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকেও এখানে সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছেন৷ যেহেতু খুব ই প্রয়োজনীয় এবং উৎপাদন কম, তাই বিক্রিয়মূল্য ও বেশি৷ অবশ্যই এর চাষে স্বচ্ছলতা ফিরবে বলেই ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এর ফলন সম্পর্কে চাষীরা তখন ই আগ্রহী হবে যখন জানবেন। উদ্যোক্তা রা তখন ই উদ্যোগ নিবে যখন এর প্রচার বেশি হবে এবং তখন তারা এর ব্যবহার সম্পর্কে জানবে ও জানাবে এরফলে নতুন বহুল ব্যবহার্য এ পণ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়বে৷ নতুন উদ্যোগ মানেই নতুন কর্মসংস্থান। ই-কমার্স উদ্যোক্তা রা এদিকে এগিয়ে এলে নিজেদের ও যেমন কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা হবে তেমনি এর সাথে আরো অনেকের কর্মসংস্থান হবে৷ তাই নতুন এ ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে অবশ্যই অনেক প্রচারণা দরকার যা ইন্টারনেট এর মাধ্যমে খুব সহজেই হতে পারে৷