ভাতের মোচা নাম শুনেই অবাক তাই না??অবাক হওয়ার কিছু নেই আসুন বিস্তারিত জেনে নিই ভাতের মোচার ইতিবৃত্ত – ভাতের মোচার বিষয়টি চট্টগ্রামের আদি এবং অকৃত্রিম খাদ্য-সংস্কৃতির অন্যতম।অসুস্থ রোগী সুস্থ হলে,কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময়,পরিবারে নতুন সদস্যের আগমন, শিশুর দাঁত গজানো কিংবা নাতির খতনা অথবা কারও আকিকার সময় এই ‘ভাতের মোচা’ নিয়ে কতো কদর। আমিও চট্টগ্রাম অঞ্চলেরই মানুষ।
এই ভাতের মোচা সংস্কৃতি ছোটবেলায় আমিও নিবিড়ভাবে দেখেছি এবং উপভোগ করেছি এবং এখন ও চল আছে।আমার মা এখনো পাটায় আমার জন্য এবং আমার মামা/খালা/আত্মীয় স্বজনরা একে অপরকে বলে মোচা নিয়ে দেখতে আসো।
শুধু পরিবারে নতুন অতিথিকে কেন্দ্র করেই যে এই ভাতের মোচার দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়, তা কিন্তু নয়। আত্মীয়-পরিজন কিংবা পরিচিত কোনো অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়ার সময়ও নিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি ছিল এবং আছে চট্টগ্রামে।
ভাতের মোচা তৈরির প্রক্রিয়াটি কিন্তু বেশ অভিনব। এই মোচার প্রধান উপাদান কলাপাতা। মূলত ভাত-মাছ-মাংস ও অন্য সবকিছু একটি কলাপাতার পুটলিতে (মোচায়) বেঁধে উপস্থাপনের নামই ‘ভাতের মোচা’।
শুধু কিছু ভাত-মাছ কলাপাতায় পুঁটলি বেঁধে দিলেই এর মূল আবেদনটি কিন্তু অনুচ্চারিত থেকে যায়। আসলে ভাতের মোচার ভেতরে, খাবারের পরতে পরতে রয়েছে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক লোকাচার, প্রয়োজনের তাগিদ, ভালোবাসা ও মূল্যবোধের আকর।
ভাতের মোচাটি একদিকে যেমন পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতা প্রকাশের মাধ্যম; অন্যদিকে এই মোচা ছিল আমাদের অসচ্ছল জনগোষ্ঠীর ভ্রমণকালের অন্যতম নিরাপদ এবং স্বল্পমূল্যের খাবার। ওসব নিয়ে এই লেখার শেষ দিকে আসব।
এখন মোচা তৈরিতে ফিরে যাই। মোচায় ব্যবহারের আগে কলাপাতা ভালোভাবে ধুয়ে-মুছে, চুলার আগুনের আঁচে সেঁকে নেওয়া হয়। ফলে কলাপাতা ব্যাকটেরিয়ামুক্ত হয়ে যায়। পাশাপাশি কলাপাতাটি একটু নরম হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যায়ে এটাকে মোচড়ালেও সহজে ছিঁড়ে যায় না। সুতরাং ‘প্যাকেট’ হিসেবে এটা যেমন মজবুত ও টেকসই; অন্যদিকে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত।
কলাপাতাটি একটি বড় আকারের থালায় বিছিয়ে পাতার ওপর লবণের হালকা একটি প্রলেপ দেওয়া হয়। এরপর দেওয়া হয় সুগন্ধি আতপ কিংবা বিন্নি চাল অথবা পোলাও চালের ভাত। ভাতের ঠিক মাঝখানে গুঁজে দেওয়া হয় আস্ত একটি মুরগি- চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় যার নাম ‘দুরুস কুরা’ (আস্ত মুরগির রোস্ট)।
দুরুস কুরার চারপাশে সাজিয়ে দেওয়া হয় ডজনখানেক সিদ্ধ মুরগির ডিম। এরপর মধ্যমণি দুরুস কুরা এবং ডিমের মাঝখানের খালি জায়গাটিতে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের বিখ্যাত গরুর মাংসের রসালো ভুনা। এর ফাঁকে ফাঁকে ঠেসে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের লইট্যা আর ছুরি শুঁটকির ভর্তা। তারপর দুরুসের দুই পাশে টিলার মতো উঁচু করে সাজিয়ে দেওয়া হয় মাছের বড় টুকরাগুলো। সবশেষে দেওয়া হয় ঝাল কাঁচামরিচের (ধাইন্যা কিংবা বোম্বাইয়া মরিচ) ভর্তা।
এবার মোচাটি বন্ধ করার পালা। কলাপাতার চারটি কোনা টেনে এক জায়গায় এনে গিঁট দেওয়া হয়- কলাগাছের ছাল থেকে তৈরি এক ধরনের দড়ি (কেলার ছাউট্টা) দিয়ে। এবার মোচার চারপাশে দুই হাতে মৃদু চাপ দিতে দিতে চারদিকে ঘোরাতে থাকে আয়োজক। মোচার ভেতরের খাবারগুলো এতে ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সঙ্গে লেগে যায়। ফলে মোচার ভেতরে থাকা খাবারগুলো প্রায় ৫-৭ ঘণ্টা গরম থাকে।
ওপরের প্রক্রিয়াটি আসলে চট্টগ্রামের অবস্থাপন্ন মানুষের চ্যাপ্টার। যাতে থাকে বড় মাছ-মাংস কিংবা অন্যান্য দামি খাবারের আধিক্য। আবার এটার ব্যবহারেও থাকে অনেক আনুষ্ঠানিকতা আর আদিখ্যেতা (কদাচিৎ)। কিন্তু এর অন্য একটি চ্যাপ্টার আছে, যা চট্টগ্রামের সাধারণ নিম্নবিত্ত মানুষের রেসিপি ও পরিবেশনা।
এ সম্পর্কে যতটা জানি তা হলো, এই ভাতের মোচার ব্যাপারটির উদ্ভাবন হয়েছিল নেহাত ‘প্রয়োজন’ এবং ‘আর্থিক সীমাবদ্ধতা’কে কেন্দ্র করে।এক সময় গ্রামীণ জীবনের লড়াকু মানুষগুলোকে হেঁটেই মাইলের পর মাইল যাতায়াত করতে হতো।
ধরুন,লোহাগাড়া থেকে চট্টগ্রাম শহর এসব স্থানে যেতে হলে হেঁটেই এই দূরত্ব অতিক্রম করতে হতো সেই সময় । পথিমধ্যে কিছু কিনে খাবার মতো অর্থ কিংবা মানসিকতা আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের আগ্রহ ও সামর্থ্যের বাইরে ছিল। অবশ্য সে সময়ে এত বেশি দোকানপাট এসব এলাকায় ছিলও না। ফলে দূরপাল্লার যাত্রায় এই ভাতের মোচাই ছিল তাদের ক্ষুধা নিবারণের অন্যতম অবলম্বন।
অসচ্ছল পরিবারে মোচা তৈরি হয় একটু ভিন্নভাবে। কলাপাতাটি একটু সেঁকে নিয়ে তাতে হালকা লবণের প্রলেপ দিয়ে, তার ওপরে দেওয়া হয় মোটা চালের ভাত, মাংস (কদাচিৎ), ছোট মাছ আর মরিচের ভর্তা। মোচার বাইরে গামছা পেঁচিয়ে দেওয়া হতো একটি ছোট্ট শসা, সঙ্গে দুটি লেবুর টুকরা। উলেল্গখ্য, কলাপাতার মোচাটির বাইরে একটি জল-গামছা পেঁচিয়ে দেওয়া হতো অসচ্ছল পরিবারে।
দীর্ঘ পথযাত্রায় মানুষের ঘাম নির্গত হওয়ায় শরীরে যে পরিমাণ লবণ আর পানিশূন্যতা দেখা দেয়, কলাপাতায় লবণের প্রলেপ আর শসা সেটাকে পুষিয়ে দিত। গামছাটি ব্যবহূত হতো পথিকের হাত-মুখ মোছার কাজে।
অবস্থাপন্ন মানুষের ভাতের মোচায় যে আনুষ্ঠানিকতা আর উপভোগের উত্তাপ অনুভূত হয়।
পক্ষান্তরে অসচ্ছল মানুষের ভাতের মোচার তাপমাত্রা কিন্তু একেবারেই বিপরীতমুখী। এদের মোচাজুড়ে থাকত তাদের সাধ-সাধ্যের ব্যবধানের অনুচ্চারিত কথন; সঙ্গে তাদের মা কিংবা বোন অথবা স্ত্রীর মায়া-মমতা আর ভালোবাসার পরশ।কালের বিবর্তনে এখনো ঠিকে আছে এই মোচা এবং আমাদের খুব প্রিয়। বাড়ীতে থেকে কেউ আসবে বললেই আমার ছেলেরা বায়না ধরে নানুকে বলেন মোচা দিতে।আমার মেয়ের শখ বড় হলে মোচার বাধ শিখবে।
রাহাত সোলতানা
স্বত্বাধিকারী-অভিরুচি বুটিকস