“বাসা থেকে অফিস, অফিস থেকে বাসা” – ব্যস্ততাময় শহরে চাকরিজীবি মানুষগুলোর রেগুলার রুটিন অনেকটাই এরকম। মাঝে মাঝে সময় পেলে কিংবা অফিস থেকে একটু আগে বের হতে পারলে সংসারী মানুষগুলো ভিড় জমান শহরের বড় বড় কাঁচা বাজারগুলোতে। আর সাপ্তাহিক ছুটিগুলোও বাদ পরে না এই বাজারের রুটিন থেকে। এই ব্যস্ততার ভিড়ে শরীরের যত্ন নিতে ভুলেই যান শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ, শতকরা ১০ ভাগ মানুষ প্রযাপ্ত জায়গার অভাবে শরীরচর্চা হতে বিরত থাকেন, বাকি ১০ ভাগ মানুষ হয় বাসার ছাঁদ কিংবা রাস্তার ফুটপাতকে বেছে নেন করেন ব্যায়াম বা শরীরচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে। আর এই মানুষগুলোর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে চট্টগ্রামের একসময়কার পরিত্যাক্ত মাঠ ‘জাম্বুরী ফিল্ড’ বা ‘জাম্বুরী মাঠ’।
জাম্বুরী মাঠ চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় মাঠ হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৯ সালে ১ লা জানুয়ারী চট্টগ্রামে পাকিস্তান ন্যাশনাল স্কোয়াট জাম্বুরী হয়েছিল। তখন আগ্রাবাদের ডাকাইত্যা বিল ভরাট করে এক বিশালাকার মাঠ তৈরি করা হয়। সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান বিভাগের তৎকালীন জিওসি আইয়ূব খান জাম্বুরীর উদ্বোধন করেন। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান স্কাউটরা এতে অংশ নেয়। এ কারণে পরবর্তীতে মাঠটি জাম্বুরী মাঠ নামে পরিচিতি পায়।
আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের সামনাসামনি এই মাঠটি দিনের বেলা টুকটাক শিশু কিশোরদের খেলায় মেতে থাকলেও বিকেল পার হয়ে সন্ধ্যা নামতেই জায়গাটি পরিণত হতো ছিনতাইকারীদের স্বর্গরাজ্যে। গা ছমছম করতো মাঠটির পাশ দিয়ে যাতায়াত করতে। ফলে দীর্ঘ দিন পরিত্যক্ত ছিল প্রায় ১৬ একরের এই মাঠটির ১০ একর জায়গা। ঝোপ ঝাড়, জঙ্গল, মশা, সাপ-বিচ্ছুর অবাধ বিচরণ ছিল এতে। বাকী ৬ একর জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটি শিশুপার্ক। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ঐ সময়কার জরাজীর্ণ ও পরিত্যক্ত ওই ১০ একরের মাঠটি এখন পরিণত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন এক পার্কে। মাঠের সাথে মিল রেখেই নামকরণ করা হয়েছে পার্কের। নাম তার জাম্বুরী পার্ক।
এখন সেই মাঠ জুড়ে নিয়নের আলোর খেলা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরেই উদ্ভোদন করা হয় পার্কটির। সুদৃশ্য এই পার্কটিতে রয়েছে জগিং করার জন্য দুটি ওয়াকওকে, পার্কটিতে রয়েছে তিন ফুট গভীর ২টি কৃত্রিম লেক ও ২ টি পানির ফোয়ারা। আরো রয়েছে ৬ টি গেইট সহ ৪ টি গণশৌচাগার। এছাড়াও রয়েছে নানান বাহারী ফুলের সৌরভ। সন্ধ্যা হতে না হতেই ওয়াকওয়ের পাশ ধরেই জ্বলে উঠে ৫০০ এলইডি লাইট। প্রতি সেকেন্ডে বদলানো ফোয়ার বর্ণিল রং যেন দূর দূরান্ত থেকে আকৃষ্ট করে পথচারীদের।
পার্কটিতে রোপন করা হয়েছে ৬৫ প্রজাতির ১০ হাজার গাছের চারা। আছে পাঁচ শতাধিক দেশি-বিদেশি উদ্ভিদ। নিরাপত্তার জন্য বসানো হয়েছে ১৪টি ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা। মাঠজুড়ে ছোট ছোট সবুজের ঝোঁপ। মাঝখানে দুটি ছাউনি। মাঠের প্রান্তে বিশ্রামের জন্য স্থায়ী বেঞ্চ। কৃত্রিম লেকগুলোর কিনারায় রয়েছে বসার জন্য দুই ধাপের তিনটি গ্যালারি। এমনকি লেকগুলোতে রয়েছে নানান প্রজাতির মাছ। আশেপাশের উঁচু ভবন থেকে পার্কটিকে চমৎকার দেখায়। লেকগুলোকে ভবনগুলোর উপর থেকে দেখলে মনে হয় একটি মানুষ যেন হাত -পা ছড়িয়ে নাঁচছে।
জাম্বুরি পার্কে শরীরচর্চার জন্য প্রশস্ত ও দীর্ঘ দুটি জগিং ট্র্যাক থাকায় এটি যেমন শরীরচর্চাকারীদের কাছে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, একইসঙ্গে এটি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে প্রশান্তির এক উন্মুক্ত উদ্যান।
ছুটির দিনসহ প্রতিদিন বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণিপেশার কৌতূহলী মানুষ বেড়াতে আসছেন জাম্বুরি পার্কে। ছুটির দিনগুলোতে থাকে উপচে পরা ভিড়। শিশু কিশোরদের লাফালাফি আর ছবি তোলার হিড়িক চলতে থাকার পাশাপাশি দেখা যায় ঘাসের উপর বসে আড্ডা দেয়া বন্ধুমহল, কপোত কপোতিদের হাত ধরে হাঁটাহাঁটি কিংবা স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার-পরিজন নিয়ে আলোআঁধারির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে আসা দলে দলে মানুষের ভিড়।
এই সবের মাঝখানে চলে শরীর ফিট রাখার খসরত। একদল মানুষ যেন নেমে পরেন সুস্বাস্থ্য ধরে রাখার প্রতিযোগিতায়। এমনকি সকাল বেলায় পুরো পার্ক থাকে শরীরচর্চাকারীদের দখলে। যেহেতু এই এলাকার আশেপাশে শরীরচর্চার জন্য তেমন কোনো খোলা মেলা স্থান নেই, তাই এই পার্কটি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠে শরীরচর্চাকারীদের কাছে। জগিং করতে করতে সবাই দলে দলে এসে যোগ দেন পার্কে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো এই পার্কটিতে প্রবেশের জন্য কোনো ফি লাগে না, যার ফলে এটি সর্বসাধারণের কাছে বেশ দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
আগ্রাবাদ সরকারী বহুতলা কলোনি, সিডিএ আবাসিক এলাকা, ব্যাংক কলোনি, টিঅ্যান্ডটি কলোনি, পোস্ট অফিস কলোনিসহ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার পাশে এমন একটি খোলামেলা পার্ক সত্যিই সকলের জন্য একটি প্রশান্তির জায়গা। নির্মল পরিবেশে বসে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দেওয়ার মত এমন জায়গা নগরীতে দ্বিতীয়টি আর নেই।
জুলিয়া আফরোজ
সত্ত্বাধিকারী – বর্ণিল রঙ্গন