অতিথিপরায়ন এবং ভোজনরসিক খ্যাত একটি জেলা হচ্ছে মুন্সিগঞ্জ জেলা। এ জেলার একদিকে যেমন রয়েছে অংসখ্য ঐতিহ্যবাহী খাবার আবার অন্যদিকে রয়েছে পিঠাপুলির জমজমাট সমাহার।শীতকালকে সামনে রেখে এই জমজমাট যেনো আরো দ্বীগুন হয়ে যায়।
মুন্সিগঞ্জ জেলায় বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী এবং আঞ্চলিক পিঠা রয়েছে। যার সাথে জড়িয়ে আছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, জেলার সুনাম।
আমাদের আজকের আয়োজন সে সমস্ত পিঠাপুলির বিস্তারিত নিয়ে____
১।মোরগ সংসা পিঠা / মাংস পিঠা
মুন্সিগঞ্জ জেলার একটি পিঠা যার আঞ্চলিক নাম মোরগ সংসা পিঠা,তবে অনেকে একে মাংস পিঠা নামেও চিনে। কথিত আছে,অতীতে বাড়িতে নতুন জামাই আসলে,জামাই আদর করে গৃহপালিত মোরগ এর মাংস দিয়ে তৈরি করা হতো এই পিঠা। যার জন্য এটার নাম হয়ে যায় মোরগ সংসা পিঠা । যদিও যে কোন মাংস দিয়েই তৈরি করা যায় মাংস পিঠা।
২।কাটা পিঠাঃ
মুন্সিগঞ্জ জেলার আরেকটি ঐতিহ্যবাহী ও আঞ্চলিক পিঠার নাম কাটা পিঠা। এই পিঠার ভেতরে নারকেল এর পুর দেয়া হয়।এই পিঠার পুর টা নারিকেল কুচি,তিল গুড় অথবা চিনি দিয়ে তৈরি করা হয়।
কাটাপিঠা নামকরনের কারন, বাঁশ অথবা টিন কাটার দিয়ে কেটে নেয়া হয় বলে একে কাটা পিঠা বলে সাধারণত শরৎ কালে এই পিঠা তৈরির ধুম পরে যায় ঘরে ঘরে। তবে চাইলে সারাবছরই বানিয়ে খাওয়া যায়।
৩। বিবিখানা পিঠা
মুন্সিগঞ্জ জেলার বিখ্যাত পিঠা বিবিখানা পিঠা।
প্রাচীনকাল থেকেই এর জনপ্রিয়তা অনেক বেশি । সাহেব ও রাজ পরিবারে প্রথম এ পিঠার প্রচলন হয়। রাজ পরিবারের মেয়েরা তৈরি করতো এই পিঠা । যার কারনে বিবিখানা পিঠা নামে এটি প্রচলিত হয়।একটা সময় ব্যায়বহুল এই পিঠা তৈরি করা সব শ্রেনীর মানুষের সম্ভব হতো না। শুধু রাজপরিবারে ও উচ্চ বিত্তরাই এই পিঠার স্বাদ গ্রহন করতে পারতো।
৪।ছেই পিঠাঃ
পিঠার নাম অদ্ভুত হলেও খেতে অসাধারণ একটি পিঠা যার নাম ছেই পিঠা। এটা মুলত নারিকেল দিয়ে তৈরি । নারেকল পুর চিনি/ গুড় দিয়ে ভালো করে পাক দিয়ে বা তাল বেধে তৈরি করতে হয়। তার পর পুরটা ছোট ছোট আকারে লম্বা করে বানিয়ে নিতে হয়। সেই পুরটা আতপ চালের আটার পাতলা রুটির ভিতর দিয়ে ছেইয়ের মতো বানিয়ে তেলে ভাজতে হয়। এই পিঠা বানাতে প্রচুর সময় লাগে। এই পিঠা প্রায় অনেক মাস সংরক্ষণ করা যায়। ফলে জেলার প্রবাসীরা বিদেশে যাওয়ার সময় সাথে করে এই পিঠা নিয়ে যায়।
৫। মুখশলা পিঠাঃ
মুখশলা পিঠা মানে হলো একটু বেশি আদুরে আর যত্নে গড়া পিঠা৷ এই পিঠ বানাতে হয় খুবই সাবধানতার সাথে। এটি জামাই আদর পিঠা বলেও পরিচিত।
এই পিঠা বানাতে ঘন দুরের ক্ষিরসা প্রয়োজন। অনেকে জেলা বিখ্যাত সিরাজদিখানের পাতক্ষির দিয়েও বানিয়ে থাকেন।
৬। খেজুর মানতাশা পিঠাঃ
পিঠার নাম শুনলেই খেতে ইচ্ছে হয় এমন একটি পিঠা খেজুর মানতাশা পিঠা । চালের আটার সাথে খেজুর গুড় মিশিয়ে খামির তৈরি করা হয় বলে এটির নাম খেজুর মানতাশা পিঠা ।খামির তৈরি করে, কলার ডাল সুন্দর করে দু ভাগ করে কেটে নিতে হয়। সেই দুভাগ কলা গাছের ডালের মাঝে আটার খামিরটাকে দলা বলের মতো করে নিয়ে চাপ দিতে হয়। ব্যাস গোল বিস্কুটের মতো খেজুর মানতাশা পিঠা রেডি। এই পিঠা গুলো তেলে ভেজে খেতে অসাধারণ । এই পিঠাকে আবার অনেকে বিস্কুট পিঠাও বলে থাকে।
৭।দৌলা পিঠা।
মুন্সিগঞ্জের আরেকটি পিঠা মজাদার পিঠা হচ্ছে দৌলা পিঠা।মূলত দলা থেকে দৌলা পিঠা নামকরন হয়েছে। সিদ্ধ চালের আটার দলা নিয়ে গোল বল তৈরি করা হয়। সেই বলের মাঝে ফাপা করে নিয়ে সেখানে ঘন দুধ, নারিকেল ও গুড় দিয়ে বানানো ক্ষির দেয়া হয়। তারপর দলা বা বলটি আটকে দিয়ে ভাপে সিদ্ধ করা হয়। যা খেতে সত্যিই অসাধারণ ।
৮।সিকি পিঠা/পয়সা পিঠা
পয়সা পিঠা, কেউ কেউ আবার সিকি পিঠা নামেই অভিহিত করে এই পিঠাকে,যা মুন্সিগঞ্জ জেলার আঞ্চলিক একটি পিঠা। বর্তমানে অনেকে রাইস চিপস নামেও চিনে থাকে একে।পূর্বের আমলে পয়সা কে সিকি বলা হতো৷ আর এই পিঠাগুলো পয়সা / সিকির মতো সাইজ বলে এই নামে ডাকা হয়।
চালের গুড়ো দিয়ে তৈরি করা হয় পয়সা পিঠা । এগুলো তৈরির উপযুক্ত সময় শীতকাল। তবে চাইলে সারা বছরই তৈরি করা যায়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায় এ পিঠা গুলো৷ শুকনো পিঠা তেলে ভেজে পরিবেশেন করতে হয়।
চায়ের সাথে হালকা নাস্তায় দারুন লাগে পয়সা পিঠা খেতে। যে কোন মিষ্টি খাবারের সাথেও দারুন যায় এ পিঠা গুলো৷ পায়েস ও সেমাইয়ের উপর ছড়িয়ে খেলে মুচমুচে দারুন একটা টেস্ট আসে।
সব চেয়ে ভালো দিক হলো বাচ্চাদের এটা খুব পছন্দ, তাদেরকে চিপস হিসেবে দেয়া যায় এই পিঠাগুলো। এতে বাইরের ক্ষতিকর চিপস থেকে রেহাই পাবে তারা। যদিও সব বয়সের মানুষ এগুলো পছন্দ করে থাকে।
মুন্সিগঞ্জ জেলা পিঠার জন্য বিখ্যাত।এখানে কেবল কয়েক রকমের পিঠাই পাওয়া যায় তা নয়।বলা যায়,এই জেলার পিঠার ঝুলি মেলা ভার।তার একটা বিশেষ কারন হচ্ছে,মুন্সিগঞ্জ জেলার মানুষ সব সময়ই ভোজনবিলাসী। নানা রকমের নানা স্বাদের পিঠা এ জেলার মেয়েরা তৈরি করে থাকে। তবে এগুলো ছাড়াও অনেক রকম পিঠা এ জেলায় বানানো হয়।
যেমন :ক্ষির পাটিসাপটা, সেমাই পিঠা, দুধ পুলি পিঠা, দুধ চিতই পিঠা/ ভিজা পিঠা, ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, ঝিনুক পিঠা , তেল চিতই পিঠা , তালের পিঠা, বরা পিঠা, চাপটি পিঠা, লুকোচুরি পিঠা, পাতা পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, হাতপুলি পিঠা, ডিম চিতই পিঠা , খাজতা পিঠা, সিকি পিঠা, বাঁশপাতা পিঠা, জাল সাজ পিঠা, কাপ পিঠা, ভাপা পুলি পিঠা ইত্যাদি।
আঞ্চলিক এবং ঐতিহ্যবাহী পিঠা পুলি কিংবা খাবারগুলো সব সময়েই যে কোন জেলার জন্য গর্ব ও অনুভুতির একটা স্থান দখল করে থাকে। ঠিক তেমনি মুন্সিগঞ্জ জেলার ও আবেগের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে নানা রকম ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলি।
সোনিয়া দেওয়ান
ওনার অফ সেজদাহ ফুড
মুন্সিগঞ্জ জেলা