বম হচ্ছে বান্দরবানের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী,ইংরেজিতে বলে : Bawm.বম’ শব্দের অর্থ হলো বন্ধন।পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নাম। বম জাতি মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর লোক।বর্তমানে বম জাতি বান্দরবান জেলার রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি ও সদর থানা এবং রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানায় মোট ৭০টি গ্রাম জুড়ে বম জাতির বসবাস।
বম আদিবাসী কুকি-চিন ভাষাভাষী মঙ্গোলীয় গােষ্ঠীভুক্ত। ‘বম’ শব্দের অর্থ বন্ধন, মিলন, পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত, একত্রীভুক্ত, এক করা বা হওয়া। আদিম প্রথার জীবনপ্রণালি, যেমন : বন্যপ্রাণী শিকারের জন্য একস্থান হতে অন্যস্থানে পরিভ্রমণ, গোত্রীয় প্রাধান্যের লড়াই, উপগােত্রীয় দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ প্রভৃতির কারণে তারা বিভিন্নকালে দলচ্যুত বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গহীন অরণ্যে আর দুর্গম পাহাড়-পর্বতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়েছে।
জীবনের যাবতীয় কর্ম, শিকার পর্ব, নৃত্যগীত, পানাহার, দেবতার উদ্দেশে যজ্ঞ নিবেদন সবকিছুই একত্র হয়ে সম্মিলিতভাবে সম্পাদন করার রীতি থেকে ‘বম‘ বা ‘বন্ধন’-এর ধারণাটি এসেছে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্তির ফলে তারা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাই ক্রমে ক্রমে দুর্বল ও সংখ্যায় কমতে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলকে একত্রীভুক্ত করা বা সংযুক্ত করণের ফলে ‘বম’ শব্দের প্রচলন হয়েছিল।
বমদের সঙ্গে বাংলাদেশের মূলস্রোতের মানুষের যোগাযোগ ও জানাশোনা অতি সামান্যই। বান্দরবান পার্বত্য জেলার মারমা ও রাখাইনরা বমদের লাঙ্গি বা লাঙ্গে বলে অভিহিত করে।ভিন্ন ভাষাভাষী আদিবাসী জনগােষ্ঠীর মধ্যে বম জনগােষ্ঠী অন্যতম।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং মায়ানমারের চীন প্রদেশে বম জনগােষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল রাজ্যগুলাের মধ্যে বম জনগােষ্ঠীর বসবাস রয়েছে মণিপুর ও মিজোরাম রাজ্যে।
সরকারি পরিসংখ্যানে বম জনগােষ্ঠীর পূর্ণাঙ্গ কোন তথ্য পাওয়া যায় না।১৯৯১ সালের আদমশুমারিতে বম জনগােষ্ঠীর মােট জনসংখ্যা ৬,৯৭৮ জন বলে উল্লেখ রয়েছে।২০০৩ সালে বম সােশাল কাউন্সিল বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত জরিপ অনুসারে বম আদিবাসী জনসংখ্যা ৯,৫০০।
দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারী এই অরণ্যচারী বম জনগােষ্ঠী তুলনামূলকভাবে এখনাে অনেক পেছনে। ভৌগােলিক অবস্থান ও দূরত্বের জন্য এরা উন্নয়নের সুযােগ হতে বঞ্চিত। বছরের অধিকাংশ সময় গভীর অরণ্যে শিকারে এদের সময় কাটে। শিকারি স্বভাবজাত গহীন অরণ্য এবং পাহাড়ি ঝরনার পানি প্রভৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া প্রকৃতি প্রেমিক এ জনগােষ্ঠী।
আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি, আহার-পানীয়, সঙ্গীত-নৃত্য ও পূজা-পার্বণ ইত্যাদি প্রায়ই একরূপ। সেই গােত্র বা গােষ্ঠী অখণ্ডভাবে বা একটি সমষ্টিগতভাবে একক রূপে নিজেদের আখ্যায়িত করার ফলে বম’ শব্দের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়।
বম শব্দের উৎপত্তি এবং অর্থ নিয়ে নানান মত বিদ্যমান। জির কুং সাহু এবং এস এল পারদো বম শব্দগত অর্থ এবং তার সম্ভাব্য প্রয়ােগ এভাবে দিয়েছেন,অতীতে বম জনগোষ্ঠীর লোকজন নদী থেকে দূরে দুর্গম পর্বত শিখরে তাদের গ্রামগুলি নির্মাণ করত। গ্রামগুলির চারপাশে শক্ত গাছের খুঁটি পুঁতে বেষ্টনী তৈরি করা হতো। বমরা মাটিতে খুঁটি পুঁতে উঁচু পাহাড়ের উপর প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে তাতে বাড়িঘর নির্মাণ করে। তাদের ঘরকে মাচাং বলা হয়।
মাচাং বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। সামাজিক আচার-আচরণ, বিচার সালিশ এবং বিবাদ মীমাংসার জন্য এদের নিজস্ব সামাজিক অবকাঠামো আছে। এই কাঠামো সামগ্রিকভাবে সামাজিক আচার-ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
বম সমাজের কেউ এ যাবৎ নিজেদের মধ্যে সংঘটিত কোন বিবাদ মীমাংসার জন্য আদালত বা অন্যকোন সরকারি সংস্থার শরণাপন্ন হয়েছে বলে জানা যায় না। আজও বমরা তাদের জীবন পরিচালনা করে বম কাস্টমারি ল’ গ্রন্থের নির্দেশিকা অনুযায়ী। বমদের বাঁশনৃত্য তাদের জীবনেরই অপরিহার্য অংশ। এটি পরিবেশ থেকে নেওয়া নৃত্যানুষ্ঠান।
বমদের চেরাউ নৃত্য ও সঙ্গীত আসলে কোন আনন্দের বা উৎসবের নৃত্য বা গান নয়। এ নৃত্য ও গান পরিবেশিত হয় বম পরিবারের দুঃখ ও শোকের দিনে। বিশেষ করে পরিবারের কারও অকাল বা অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে এই গান করা হয়। শোকের সময় মানুষকে সান্ত্বনা ও সাহস দেওয়ার এটাই বমদের রীতি।
বম জাতির ব্যাপারে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না।এরা সাধারণত এদের বৃত্তের বাইরে আসতে পছন্দ করে না তাই তাদের ব্যাপারে বেশি তথ্য সংগ্রহ করাও কষ্টসাধ্য একটা কাজ।
রাহাত সোলতানা
স্বত্বাধিকারী-অভিরুচি বুটিকস