হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক আমাদের বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জ জেলা। এই জেলায় রয়েছে প্রাচীন বাংলার অনেক নিদর্শন। এই নিদর্শনের একটি হলো মৃৎশিল্প।
মাটি দিয়ে তৈরি শিল্পকর্মকে মৃৎশিল্প বলে এবং যাদের সুনিপুন হাতে এই শিল্পকর্ম পায় নিজস্ব স্বকীয়তা, তাদেরকে বলা হয় কুমার।
প্রাচীনকাল থেকে মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার পাল বংশীয় পরিবারের লোকেরা বংশ পরম্পরায় তাদের যত্নশীলতা দিয়ে কাজ করছেন মৃৎশিল্প নিয়ে। এক সময় মাটির হাড়ি -পাতিল, বাসন, তৈজসপত্র, পিঠার হাড়ি, খই/মুড়ি ভাজার হাড়ি, কলসি, সরা, ফুলের টব,খেলনা ইত্যাদি বিভিন্ন পন্য বানিয়ে তারা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো।
বৈশাখি মেলায় গিয়ে মাটির পুতুল কেনার অভিজ্ঞতা সবার জীবনেই আছে।বছর জুড়ে বিভিন্ন পূজা পার্বনে দেখা যায় এই সকল পন্যের উপস্থিতি।
এই সকল পন্য বানাতে প্রধান উপাদান হলো স্বচ্ছ এটেল মাটি। এই মাটি দিয়েই নিপুন হাতে বানানো হয় প্রতিটি পন্য। তারপর সেগুলোকে প্রথমে রোদে শুকিয়ে পরে স্তুপ আকারে রেখে আগুনে পোড়ানো হয়। সাধারণত খের বা নাড়া দিয়েই পোড়ানো হয়ে থাকে।
এতে পন্য কঠিন আর মজবুত হয়।
বিশেষভাবে মহিষের চামড়া দিয়ে পুড়ানো হলে সেগুলো একেবারে লালচে বর্ন ধারন করে। এগুলোকে টেরাকুটা বলে।
সব শেষে মনের সব কল্পনা নিয়ে সাজানো হয় বিভিন্ন রঙে। এই রঙ করার কাজটাও তারা নিজের হাতে করে থাকেন।
পরিবারের যুবক, বৃদ্ধ, বনিতা সবাই এই কাজে অংশ নিয়ে থাকেন স্বানন্দে। কেউ মাটি আনে,কেউ সেই মাটিতে পানি মিশিয়ে ডো তৈরি করে,কেউ একজন পন্য বানালে অন্য একজন হয়তো সেটা রং করে ফেলে নিজের ইচ্ছে মত।
এটা তারা বংশ পরম্পরায় করে আসছেন শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে। এই কাজে তাদের লাগে না কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তারা তাদের শৈল্পিক মনের সবটুকু দিয়ে অতি যত্নে বানিয়ে থাকেন পরিবেশ বান্ধব এ সকল মাটির পন্য।
আধুনিকতার ছোয়ায় সিরামিক,ম্যালামাইন,প্লাস্টিক সহ বিভিন্ন ধাতব পন্যের সহজলভ্যতার কারনে এই শিল্পে ভাটা পড়ে গেছে অনেকটা। কুমারেরা তাদের পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে দিয়ে বিকল্প পেশার কথা ভাবছেন।
তাদের এই পরিবেশবান্ধব শিল্পকর্ম এখন সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে বাৎসরিক কিছু পূজা-পার্বন ও মেলার মধ্যে।
তবে আশার কথা হলো,এখনো জেলার সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়া ইউনিয়নের বড় আখরা পালপাড়া গ্রাম, বাসাইল,রাংগামালিয়া,শেখেরনগর, আবিরপাড়া, দানিয়াপাড়া পালপাড়া গ্রাম, শ্রীনগর উপজেলার হাসারা গ্রাম ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৬ শতাধিক পরিবার টিকে আছেন তাদের এই শিল্পকর্ম নিয়ে। তবে সময়ের সাথে সাথে বদল হয়েছে পন্যের চাহিদার।
আধুনিকতা নিয়ে তৈরি হচ্ছে নান্দনিক শিল্পকর্ম।চাহিদা বাড়ছে মাটির তৈরি সৌখিন পন্যের। যার মধ্যে রয়েছে ফুলদানি, শো পিস, ডিনার সেট, প্রদীপ, ওয়ালম্যাট, বিভিন্ন গহনা ইত্যাদি। তাদের বানানো এই সব পন্য শোভা পাচ্ছে রাজধানিসহ বিভিন্ন জেলা শহরের শোরুম গুলোতে।
এই সুন্দর শিল্পকর্ম আপনার আমার ড্রয়িং রুমের শোভাবর্ধন করলেও পিছিয়ে যাচ্ছে এই শিল্পের সাথে জড়িত হাজারো মানুষের জীবন।
এবারে এই শিল্পের প্রচার ও প্রসার ঘটাতে এগিয়ে আসতে হবে ই কমার্স উদ্যোক্তাদের। জেলার ভিতরেই সোর্সিং থাকায় এই পন্য নিয়ে কাজ করে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। মুন্সিগঞ্জ জেলায় যারা এখনো উদ্যোগ শুরু করার কথা ভাবছেন তাদের জন্য এটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব পন্য উঠে আসছে ই কমার্সের কারনে। শিক্ষিত জনসমাজ কাজ করছে এই সকল প্রায় বিলুপ্তের পথে এগিয়ে যাওয়া পন্য নিয়ে। তাই মুন্সিগঞ্জের উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে আবারো বাজার তৈরি হবে এই পন্যগুলোর।
এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ও সময় উপযোগী পদক্ষপ নেয়ার জন্য যথাযথ কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
তবে সরকারি, বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রচারনা চালাতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে এই শিল্পের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে। নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের অতীত ঐতিহ্যকে তুলে ধরা আমাদের কর্তব্য।
সকলের অংশগ্রহনে মুন্সিগঞ্জের মৃৎশিল্প দেশের চাহিদা মিটিয়ে একদিন সমাদৃত হোক বিশ্বময়।
শামীমা নাসরিন শাম্মী
স্বত্তাধিকারিঃ Shamme’s Dream.