আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রাণীজ আমিষের শতকরা ৫৮ ভাগ আসে মাছ থেকে। মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ও খনিজ। মাছ শুধু রান্না করেই খাওয়া হয় না শুটকি হিসেবেও আমরা মাছকে খাই। মাছের শুঁটকিতে আছে ভিটামিন -ডি ও আমিষ।
আমাদের টাংগাইল জেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত নদ-নদী,খাল-বিল,হাওড়-বাওড়, শাখানদী। জেলাটির পুরো পশ্চিম জুড়ে আছে যমুনা,ধলেশ্বরী, বৈরাং,লৌহজং,মরা আত্রাই,ঝিনাই নদী। এছাড়াও চারদিকে বয়ে চলেছে ব্রক্ষ্ণপুত্র, মেঘনা, গংগা নদী। নদীর পানিতে আছে হরেক রকমের মাছ। এই মাছ গুলো জেলার হাজার হাজার জেলের জীবিকার প্রধান উৎস।
জেলাটিতে সরকারি হিসেব অনুযায়ী ৭২ টি দীঘি আছে। সাগরদীঘি,চকরা, মাইজবাড়ি, ভাওয়াইয়া, ধোয়া, সন্তোষের দীঘি,উপেন্দ্র সরোবর সহ আরো অনেক দীঘি। এই দীঘিগুলো মধ্যে অনেক গুলোতে এখন বাণিজ্যিক ভাবে মাছ চাষ করা হয়। মূলত রুই,কাতল, বোয়াল, মৃগেল,আইর,চিতল,শৈল,পাবদা, পাংগাস সহ বিভিন্ন বড় আকারের মাছ চাষ করা হয়ে থাকে। স্থানীয় লোকদের উদ্যোগে দীঘি গুলোকে ঘিরে গড়ে ওঠেছে এই সকল মৎস উৎপাদন কেন্দ্র। যার ফলে কিছু সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
প্রাকৃতিক ভাবে বিলগুলো থেকে বর্ষা মৌসুমে পাওয়া যায় ছোট বড় নানা ধরনের মাছ। আমার নানু বাড়ি কালিহাতি উপজেলার কামান্না নামক গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি বর্ষায় সাতবিলের জেলেদের উপচে পড়া ভীড়। বিলটির পরিসীমা অনেক বড় এবং এখানে বর্ষা মৌসুমে দেখা যায় শত শত মানুষ বেড়জাল, ফাঁসজাল,কারেন্ট জাল, বড়শি নিয়ে মাছ ধরছে। শুধুমাত্র যে স্থানীয় মানুষজন এখানে মাছ ধরতে আসে তা কিন্তু নয়। বরং দূরদূরান্ত থেকে দুইদিন সময় নিয়ে শত শত মানুষ একযোগে মাছ ধরতে আসে। সারারাত চলে মাছ ধরার ধুম। যে যেভাবে পারে মাছ ধরে। এটা একটা আনন্দ উৎসবের মতো বললে ভুল হবে না। বিলের যে দিকেই চোখ যায় সেখানেই দেখা মেলে শিব জালের। জাল গুলো স্রোতযুক্ত পানির কাছাকাছি পাতা হয়। যখন জাল পানিতে ফেলে দেয়া হয় তখন তার উপর মাছের চলাফেরা দেখে জাল উঠিয়ে নিতে হয়। শিব জালের কাছে ছোট বড়, বুড়ো-জোয়ান অনেক ধরনের মানুষ বসে থাকে। মাছ ধরার এই আমেজটা এখনও গ্রাম বাংলায় বিরাজমান।
জেলার অভ্যন্তরে এছাড়াও আছে বাঘমারা বিল, চাপড়ি বিল, গৌরিশ্বর বিল, কাঠালিয়া বিল, নিকলা বিল, ডুবাইল বিল, কারাইল বিল,পোয়াতি বিল, বড় শোলাদহ,তেরিল্যা বিল, আমুলা বিল, গৌরিবর বিল সহ প্রভৃতি বিল। বিল গুলোর মাছের স্বাদ সবসময়ই অতুলনীয় হয়। বিলের মাছ ধরার পদ্ধতি গুলোর মধ্যে ঝাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরা দেখতে খুব ভালো লাগে আমার। জেলে যখন জাল নিজের হাতের শক্তি বলে পানিতে ছড়িয়ে দেয় সেটি চমৎকার এক দৃশ্য।
লিখতে গিয়ে বার বার ঐ দৃশ্যটা চোখে ভেসে আসছে। বাবাকে দেখেছি এভাবে মাছ ধরতে।বাবার খুব শখ মাছ ধরার। বাবা মাছ ধরায় খুব পারদর্শী।অফিসের ফাঁকে সময় পেলেই বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে চলে যায়। এজন্য বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই মাছ ধরার নানান সরঞ্জামাদি দেখেছি। বড়শি দিয়ে সপ্তাহে একবার হলেও মাছ ধরতে তার যেতেই হবে। যমুনা থেকে শুরু করে জেলার যত নদী আছে আমার মনে হয় এই দুইযুগে সব জায়গাই গেছে বাবা।এর সুবাদে আমি নদীর টাটকা মাছ খেয়েই বড় হয়েছি। যখন ছোট ছিলাম মাঝে মাঝে বাবা মাছ ধরে এনে আগে বলতো তোমার থেকেও মাছ আকারে অনেক বড়। এখন অবশ্য যতবড় মাছই ধরুক না কেন সাইজে আমার থেকে বড় হয় না। মাছ নিয়ে লিখতে লিখতে কেমন যেন ভাবুক হয়ে গেলাম মনে হচ্ছে।
এবার বলি এই বিলের মাছগুলোর বাজারজাত নিয়ে। বিলের মাছ গুলো স্থানীয় বাজারগুলোতে ভোরে থেকেই পাওয়া যায়। মাছগুলো খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ক্রেতার সংখ্যা বেশি। ফলে বাজারে আনার আধঘণ্টা কিনবা একঘণ্টার মধ্যেই সব মাছ বিক্রি হয়ে যায়। মাছের বাজারের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ভূঞাপুরে। এখানে সকাল ৮ টার আগেই হাজার হাজার টন মাছ বিক্রি হয়ে যায়। দূর দূরান্ত থেকে মাছ কিনতে আসে পাইকাররা।
টাংগাইল জেলার বিশাল অংশ জুড়ে প্রবাহমান যমুনা নদী। এখানে রয়েছে হরেক রকম মাছ। মাছগুলো প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে ওঠে। খেতে সুস্বাদু হওয়ায় যমুনার মাছের চাহিদাও তুলনামূলকভাবে বেশি। ৭০-৭৫ টি শ্যালো মেশিন যোগে দিনে দুইবার করে মাছ ধরা হয়। আড়াই শতাধিক জেলে মাছ ধরার মৌসুমে বেড়জাল, কারেন্ট জাল,ঘাইলা জাল,মই জাল,নাগিনী জাল,ফাঁস জাল সহ বিভিন্ন জালের সাহায্য মাছ ধরে থাকে।যমুনার পানিতে পাবদা, ইলিশ, বোয়াল,শোল,আইড়,রুই,কাতল,চিতল,কাইয়াকাটা,বাঘাইড় সহ বিভিন্ন মাছ পাওয়া যায়।বিকেল চারটায় সময় জেলেরা মাছ ধরতে নদীতে নামেন। সেই মাছ গুলো জেলেরা সকাল বেলা কাজীপুর উপজেলার মেঘাই খেয়াঘাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসে। মাছ বিক্রির সময় কিন্তু মাপঝোঁক করা হয় না। চোখের আন্দাজে বিক্রি করা হয় মাছ। বিভিন্ন পাত্রে রাখা মাছ গুলো দেখে সর্বোচ্চ দরদাতারা তাদের পছন্দের মাছ কিনে নিয়ে যায়।দেখা যায় সকাল ছয়টা নাগাদ সব মাছ বিক্রি মোটামুটি প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এরপর আবারো জেলেরা নদীতে নামে মাছ ধরার জন্য। দুপুর দুইটা নাগাদ মাছ ধরার পর আবারো একই স্থানে এসে মাছ গুলো বিক্রি করেন। মাছগুলো কিনতে সিরাজগঞ্জ, শেরপুর,বগুড়া থেকেও পাইকাররা আসেন। দামে খানিকটা বেশি হলেও স্বাদে যমুনার মাছ সুস্বাদু । টাংগাইল সদরের পার্কের বাজার, বটতলা, ছয়আনী বাজারেও যমুনা নদীর মাছ পাওয়া যায়।
মাছ চাষে ভূঞাপুরের দুই ভাইয়ের স্বাবলম্বী উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্পঃ
আমরা সচরাচর পুকুরে বা ডোবায় মাছ চাষ করে থাকি। টাংগাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার কয়েড়া গ্রামে ইমন আর সুমন নামে দুইভাই বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে সফল হয়েছেন।
বায়োফ্লক মাছ চাষের একটি আধুনিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে অল্প পুঁজি, স্বল্পস্থানে, কম সময়ে অধিক পরিমাণে মাছ উৎপাদন করা যায়।এই পদ্ধতিতে একদম ঘোরায়া পদ্ধতিতে বাড়ির পরিত্যাক্ত জায়গায় ট্যাংক স্থাপন করে বাণিজ্যিক ভাবে মাছ চাষ করা যায়। বায়োফ্লক এমন একটি এ্যাকুয়াকালচার সিস্টেম যেখানে পানিতে বিদ্যমান অক্সিজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও হাইড্রোজেন এর সাম্যাবস্থা নিশ্চিত করে পানির গুণাগুণ ঠিক রাখা যায়। ক্ষতিকর রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু যাতে আক্রমণ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়।এটি পরিবেশ বান্ধব মাছ চাষের এক প্রকার বিকল্প প্রযুক্তি।
প্রথম প্রথম উদ্যোক্তা ইমন ও সুমনের এই কার্যকলাপ দেখে এলাকাবাসী ভাবে এভাবে মাছ চাষ করে লাভবান হওয়া যাবে না। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরাও এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মাছ চাষে ভূঞাপুরের এই তরুণ উদ্যোক্তারা লাভবান হতে থাকেন। ইমন জানান, প্রথমে ষাট হাজার টাকা খরচ করে দশ হাজার লিটার পানি ধারণ ক্ষমতার দুটি ট্যাংকে বিশ হাজার মাছের পোনা চাষ দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে তারা শিং, পাবদা, টেংরা পোনা দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে আরো মাছের পোনা সহ বড় আকারে তাদের এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ইমন জানান, ৩ মাসে যাবতীয় খরচ বাদে তাদের লাভের পরিমাণ আড়াই লাখ টাকা। তাদের এই সফলতা দেখে আশেপাশে অনেকেই এখন বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।উপজেলা মৎস কর্মকর্তা ড.মো.হাফিজুর রহমান বলেন- অল্প বিনিয়োগ, স্বল্প জায়গা,কম খরচে বেশি লাভবান মাছ চাষের এই আধুনিক প্রযুক্তি এলাকাটিতে সম্ভাবনার ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে সক্ষম। এতে একদিকে যেমন আমিষের ঘাটতি পূরণ হবে তেমনি বেকার সমস্যা দূরকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মৎস অফিস থেকে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, আর্থিক সহায়তা সহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
জেলার বিভিন্ন জায়গায় হ্যাচারি, নিজস্ব পুকুরে মাছ চাষ করা উদ্যোক্তার সংখ্যা কম নয়। তবে বাণিজ্যিক ভাবে এভাবে মাছ চাষ হলেও ই-কমার্সে এর প্রচারণা নেই বললেই চলে। ই-কমার্সে উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবিমাত্র। যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন যমুনা সেতুর কারণে আগের থেকে অনেক উন্নত হয়েছে। কেউ চাইলেই ই-কমার্সে এই সেক্টরে কাজ করে টাটকা মাছ সারাদেশে সরবরাহ করতে পারবে। ট্রাকযোগে সহজেই মাছ প্রতিটি জেলায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব। মাছ যেহেতু আমাদের নিত্য পণ্য সেহেতু এর চাহিদা দেশে ও বিদেশে সবসময়ই। মাছকে কৌটাজাত,রেডি টু কুক, শুটকির মাধ্যমে সারাদেশে সরবরাহ করা এবং বাহিরের দেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে চাইলেই উদ্যোক্তারা এ সেক্টরে সফলতার সাথে কাজ করতে পারবে।
ইসরাত জাহান জীম
স্বপ্নডিঙ্গা