প্রথমেই জানি সিল্ক আসলে কি? সিল্ক হল প্রকৃতি থেকে পাওয়া যায় এমন একধরনের তন্তু। প্রকৃতি থেকে যেসব তন্তু পাওয়া যায় সেগুলো হল তুলা, লিলেন, হেম্প, উল, পাটের তন্তু কিন্তু এগুলো থেকে যে তন্তু পাওয়া যায় সেগুলো সিল্কের মত দীর্ঘ না আর সিল্কের মত চকচকে না, সিল্কের চাকচিক্যই সিল্ককে অন্য সকল তন্তু থেকে আলাদা করে দেয়। সিল্ক পাওয়া যায় রেশম কীট থেকে।
সিল্কের উৎপত্তি কোথায়?
সিল্কের উৎপত্তিস্থল হল চায়না খৃষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের ঘটনা ধারণা করা হয়।চীনের মাটি থেকে সিল্কের অনেক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে চীন । সেগুলোর মধ্যে একটা সিল্কের কাপড় পাওয়ার যায় যা দিয়ে বাচ্চাকে জড়িয়ে রাখা হত। সিল্কের ইতিহাস নিয়ে মজার একটি কাহিনী ও রয়েছে। চীনের সম্রাট হুয়াং তাই এর আমলে উনার স্ত্রী সাই লিং শি একদিন তাদের বাগানে তুত গাছের নিচে বসে চা পান করছিলেন এমন সময় উপর থেকে একটা রেশমের কোকুন সম্রাজ্ঞীর চায়ের কাপে পড়ে আর সে অবাক হয়ে যায় দেখে যে ককুন গরম চায়ে পড়ে তা থেকে সুতার মত পদার্থ বের হচ্ছে যা অনেক চকচক করছিল। পরে সম্রাজ্ঞী তুতগাছে রেশম পোকা ধরে থাকা দেখেন এবং এভাবেই সম্রাজ্ঞীর অজান্তেই যে সিল্ক আবিষ্কার হয় তা মানুষের মুখে প্রচলিত কিন্তু এই গল্পের সত্যতা প্রমাণিত না হলেও চীন ই সিল্কের উৎপত্তিস্থল এতে কোন সন্দেহ নেই।এমনকি তারা বহুকাল ধরে এটা বিশ্বের কাছে লুকিয়ে রেখে একাই সিল্কের ব্যবসা করত।
যেহেতু সিল্ক চীনা সম্রাজ্ঞী দ্বারা আবিষ্কার হয়েছিল তাই প্রথম দিকে এটা শুধু রাজবংশীয় লোকেরা ব্যবহার করত। সিল্ক মানেই এক অন্যরকম আভিজাত্য। রাজবংশীয় পুরুষেরা সাদা রঙের কাপড় পড়তেন আর মহিলারা এবং তাদের সন্তানেরা হলুদ রঙের পোষাক পড়তেন। তারা প্রায় ৩০০০ বছর এই সিল্ক এবং এর চাষ পদ্ধতিকে নিজেদের মধ্যে গোপন রেখেছিলেন।সিল্কের কাপড়, কোকুৃন, রেশমকীট যেন বনিকেরা পাচার বা রপ্তানি না করে সেদিকে কড়া পাহারা দেয়া হত। সিল্ক সেসময় সোনার চেয়েও মুল্যবান ছিল। কেউ যদি কোকুন, রেশমকীট পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ত তাকে বিনা মাফে মৃত্যুর আদেশ দেয়া হত। শাস্তির ভয়ে তাই কেউ পাচার করতে যেত না।
সিল্ককে রাজবংশের লোকেরা এত বেশী গোপনীয়তার সাথে রাখলেও এটা চীন থেকে বেরিয়ে পড়ার পেছনেও রাজবংশের মানুষের ই হাত ছিল। কোন এক রাজকন্যা সেসময় খোটান রাজ্যের রাজকুমারের সাথে বিয়ে করে আর যাওয়ার সময় সে তার প্রিয় সিল্কের পোষাক গুলো সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য বায়না করে ফলে তার মাধ্যমে সিল্ক অন্য দেশে চলে যায় তবে অন্য দেশে গেলেও এরপর ও অনেক বছর তারা সিল্ক চাষের গোপনীয়তা রক্ষা করে রেখেছিলেন। এরপর ধিরে ধিরে সিল্ক রাজবংশের গন্ডি পেড়িয়ে সাধারণ মানুষের নাগালে আসে মানুষ পড়ার পাশাপাশি রপ্তানি করার সুযোগ পায় তারো অনেক পরে চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বাইরের দেশের মানুষ জানতে পারে। বিভিন্ন দেশে ধিরে ধিরে সিল্ক ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হয়৷
প্রাচীনকালের অনেক বড় একটি বানিজ্যিক রাস্তা ছিল এই সিল্ক রোড।
সিল্ক রপ্তানি শুরু হল ইউরোপে কিন্তু সেসময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার মত ছিল না। বনিকেরা পাড়ি দিত সুদীর্ঘ পথ উটে কিংবা ঘোড়ায় চড়ে। চীন থেকে ইউরোপ যাওয়া চাট্টিখানি কথা ছিলনা। চীন পাড় হয়ে গোবি মরুভূমি পাড় হতে হত যা চীন মঙোলিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল, মরুভূমি পাড় হয়ে ইরান, তুর্কী হয়ে ইউরোপ যেতে হইত, লেগে যেত বহুদিন।সিল্ক রোডের মূল পন্য ই ছিল রেশম তবে রেশম ছাড়াও আরো বিভিন্ন পন্য রপ্তানি করা হত। অত্যন্ত ভয়ংকর রোমাঞ্চকর ছিল এই রাস্তা কারণ ধু ধু মরুভূমিতে পানি পাওয়া যেত না দূর দূরান্তে আবার ডাকাতের ভয় ছিল অনেক। তবে ইউরোপে গিয়ে পন্যের জন্য পাওয়া যেত চড়া দাম যা পুরো রাস্তার কষ্টকে ভুলিয়ে দিত বনিকদের। এই রাস্তা মোটেও সোজা সহজ কোন রাস্তা ছিল না, অনেকগুলো রাস্তা মিলে একটা নেটওয়ার্ক এর মত ছিল এই রাস্তা। ১৩০ খৃষ্টাব্দ থেকে হান রাজবংশ ইউরোপে বানিজ্য রপ্তানি শুরু করেছিল ধারণা করা হয় তখন থেকেই এই রাস্তার উদ্ভব।
এই রাস্তা ছিল অনেক পুরাতন কিন্তু এই রাস্তার নাম সিল্ক রোড অনেক পরে রাখা হয়েছিল আর রেখেছেন ১৮৭৭ সালে জার্মান ভূগোলবিদ ও ইতিহাসবিদ ফার্ডিন্যান্ড ভন রিকথোফেন।তবে ১৪৫৩ সালে এই রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয় কারন অটোমান সাম্রাজ্য কনস্ট্যান্টিনপল জয় করে সকল ব্যাবসায়িক সম্পর্ক বন্ধ করে দিয়েছিল ইউরোপের সাথে।
চীন হাজার হাজার বছর ধরে সিল্ককে পুরো পৃথিবীর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল সিল্ক রোড উন্মুক্ত হওয়ার পর বানিজ্যিক ভাবে পুরো পৃথিবী ধিরে ধিরে সিল্ক সম্পর্কে জানল কিন্তু সিল্কের চাষাবাদ পুরো পৃথিবীতে ছড়াতে আরো অনেক সময় লেগেছিল।ষোড়শ সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে ভারত উপমহাদেশে ও রেশমের বিস্তার লাভ করেছিল। ভারতের মালদাহ ও মুরশিদাবাদে রেশম উতপাদনের কেন্দ্রস্থল তৈরি হয়েছিল এবং নাম পড়েছিল বেঙ্গল সিল্ক। সে আমলের সম্রাটের তত্বাবধানে রেশম চাষ ভাল মত শুরু হয় বাংলার মাটিতে। মুরশিদাবাদের প্রশাসনিক গুরুত্ব দিন দিন বাড়তে থাকে রেশমের জন্য। ১৬৬০ এর দিকে কাশিমবাজারে ইউরোপীয়রা কুঠিও স্থাপন করেছিল। বেঙল সিল্কের খ্যাতি পুরো ভারতেই শোনা যেতে লাগলো আর বিভিন্ন রাজ্যের রাজারা বাংলায় তাদের লোকদের পাঠাতেন হাতে কলমে রেশম চাষের শিক্ষা লাভের জন্য। এমনকি এটাও বলা হয় টিপু সুলতান ও তার তাতীদের পাঠিয়েছিলেন বাংলায় রেশমের দীক্ষা লাভের জন্য। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ভারতে এসেছিল এই বেঙল সিল্কের টানেই। ভারত চীন থেকেও সিল্ক আনতো আবার বেঙল সিল্ক ও উতপাদন করত। দুদিকেই বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। কিন্তু চীনের সিল্ক আর বেঙ্গল সিল্কের মধ্যে পার্থক্য ছিল। চীনের সিল্ক ছিল তুত সিল্ক আর বেঙ্গল সিল্ক ছিল অতুত সিল্ক।
রাজশাহীতে সিল্কের সূচনা
দেশ ভাগের আগে পুরোটাই ভারতবর্ষ ছিল। ধারণা করা হয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই ভারতবর্ষে সিল্কের সূচনা হয়। শুধুমাত্র তিন জায়গায় সবচেয়ে বেশি রেশম উতপাদন হত মালদহ, মুরশিদাবাদ আর রাজশাহীতে। এই তিন জায়গার সিল্ককেই বেঙ্গল সিল্ক বলা হত। রাজশাহীতেও এত বেশি রেশম উৎপাদিত হত যে সেটা বিদেশে রপ্তানি করা হত। পদ্মার তীরে অবস্থিত বোয়ালিয়া ছিল উত্তরবঙ্গের একমাত্র বানিজ্যিক বন্দর, যা রেশমের জন্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে রেশম চাষের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠেছিল। ওলন্দাজরা বোয়ালিয়াতে কুঠি স্থাপন করেছিল। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর রাজশাহীতে সিল্কের উৎপাদনে ভাটা পড়ল। দেশ ভাগের কারনে বেঙ্গল সিল্ক এভাবেই রাজশাহী সিল্কের নামে রুপান্তরিত হল।
দীর্ঘ একটি সময় সিল্ককে অন্ধকারে পড়ে থাকতে হয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে কিছু উদ্যোক্তারা চেষ্টা করেছিল সিল্ক কে বাচিয়ে রাখতে কিন্তু গুনতে হয়েছিল লোকসানের পরিমাণ। পরে
১৯৫২ সালে সেসময়ের পাকিস্তান সরকার আবার রাজশাহী সিল্ক উতপাদনের ব্যাপারে উৎসাহিত হন। ধিরে ধিরে রাজশাহী সিল্ক পুনরায় উজ্জীবিত হতে শুরু করে। ১৯৬১ সালে প্রথম রাজশাহী সিল্কের ফ্যাক্টরি তৈরি হয়। এরপর ধিরে ধিরে রাজশাহী সিল্কের কদর দেশ বিদেশে ছড়াতে শুরু করে। কিন্তু প্রচারণার অভাবে এখনো রাজশাহী সিল্ক সেভাবে বিশ্ব দরবারে জায়গা করে নিতে পারেনি।
২০২১ সালে রাজশাহী সিল্ক বাংলাদেশের জিআই পন্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত হয়েছে। এখনি সময় সিল্কের সোনালী সময় ফিরিয়ে আনার।
লেখক: খুরশিদা ইসলাম রুকু
স্বত্বাধিকারীঃ ঘরকুনো সিনজিনি
দিনাজপুর