যত দিন যাচ্ছে কর্মমুখর যান্ত্রিক জীবনে মানুষ একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পরছে। বেশির ভাগ পরিবারেই এখন স্বামী-স্ত্রী দুজনই পেশাজীবী হওয়ার কারণে প্রতিদিন বাসায় রান্না করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। আবার প্রতিদিন রেস্টুরেন্টের খাবার খাওয়াও খুব বেশি স্বাস্থ্যকর না বলে তা নিয়ে এক ধরণের অতৃপ্তি অস্বস্তিবোধ কাজ করে মনে। এই সমস্যার সমাধান হিসেবেই বর্তমানে অনলাইনে বাড়ছে হোমমেইড খাবারের জনপ্রিয়তা, ফেইসবুককে কেন্দ্র করে তৈরী হচ্ছে অসংখ্য হোমমেইড খাবারের পেইজ এবং গ্রুপ।
মানুষ এখন আগের থেকে বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। পরিচ্ছন্ন পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের আগ্রহ বাড়ছে সবার মাঝে। তাই দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এবং তাদের কর্পোরেট প্রোগ্রামগুলোতে রেস্টুরেন্টের খাবারের চেয়ে হোমমেইড খাবারকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। কারণ হোমমেইড ফুড সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে সঠিকভাবে হাইজিন মেইনটেইন করেই তৈরী করা হয়। হোমমেইড খাবারের চাহিদা যেমন বাড়ছে, তেমনি একে কেন্দ্র করে বাড়ছে উদ্যোক্তা, গড়ে উঠছে একটা নতুন ইন্ডাস্ট্রি। প্রতিটি সেক্টরেই কিছু না কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। তাই এই হোমমেইড খাবারের ইন্ডাস্ট্রিতেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ক্রেতা বিক্রেতা উভয়কেই ফেইস করতে হয়।
এই ইন্ডাস্ট্রির ক্রেতাদের ক্ষেত্রে প্রধান অভিযোগ থাকে খাবারের দাম নিয়ে, কারণ সবাই রেস্টুরেন্টের খাবারের দামের সাথে হোমমেইড খাবারের দামের তুলনা করে থাকেন। ক্রেতাদের এই ধারণাটা দূর করতে হবে,তাদের সচেতন করতে হবে, পার্থক্যটা বোঝাতে হবে। যেহেতু তারা রেস্টুরেন্টের বিকল্প হিসেবে ভালো মানের খাবারটা চাচ্ছেন, যাতে সঠিক পুষ্টি থাকবে, পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নভাবে তৈরী হবে, পছন্দ মতো আইটেম কাস্টমাইজ করে নেয়া যাবে এবং বাসায় বসেই যাতায়াতের কষ্ট এবং খরচ বাঁচিয়ে খাবারটা খেতে পারছেন, সেহেতু খাবারের দামটা রেস্টুরেন্টের চেয়ে বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। আরেকটা ব্যাপার হল- রেস্টুরেন্টে অনেক খাবার একসাথে তৈরী করা হয়, তাই তারা পাইকারি দামে খাবারের সব উপকরণগুলো কিনতে পারেন। অন্যদিকে হোমমেইড খাবারের উদ্যোক্তারা স্বল্পপরিমাণে কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী খাবার তৈরী করে দেন বলে, তাদের উপকরণগুলো খুচরাভাবেই কিনতে হয় বেশি দামে। আর সেরা খাবারটা তৈরী করতে চুলার পাশে আগুনের তাপে ঘাম ঝরানো কষ্ট তো অমূল্য। ক্রেতারা যখন বুঝবে তারা সেরা খাবারটা কতটা আরামে ঘরে বসে খেতে পারছে, তখন আর খাবারের মূল্য বিবেচনায় আসবে না, বরং মূল্য যাই থাকুক সেই খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলবে।
পরামর্শঃ
- ক্রেতারা আপনার রান্না করা খাবারের বিশেষত্বটা বুঝবে কি করে, যদি আপনি সেটাকে প্রেজেন্ট না করেন! তাই খাবারের উদ্যোক্তাদেরকে নিয়মিত নিজের প্রোফাইলে, পেইজে এবং খাবারের গ্রুপগুলোতে লিখতে হবে। তবে অবশ্যই আমার রান্না খুব ভালো, সুস্বাদু ইত্যাদি না বলে গল্প আকারে কন্টেন্ট লিখতে হবে বিভিন্ন বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে এবং গল্পের প্রধান চরিত্র অবশ্যই হবে কাস্টমার। যারা নতুন উদ্যোক্তা, কাস্টমার পান নি এখনো তারা নিজেদের প্রথম রান্না শেখার অভিজ্ঞতা, খাবারের উদ্যোক্তা হিসেবে জার্নি শুরুর অভিজ্ঞতা, আপনার রান্না নিয়ে এবং এর স্বাদ নিয়ে মজার কোনো ঘটনা ইত্যাদি নিয়ে লিখতে পারেন ছোট ছোট কন্টেন্ট, যা মানুষকে আগ্রহী করে তুলবে।
- কাস্টমারদের সাথে যথাসম্ভব আন্তরিক এবং সহজ স্বাভাবিক ব্যবহার করতে হবে। তাঁরা যেন ফিল করতে পারে আপনার কাছে তাঁরা অনেক বেশি মূল্যবান, তাই আপনি তাদের জন্য খুব যত্ন নিয়ে রান্না করেন। খাবার অর্ডার করার সময় জেনে নিতে হবে তাদের পছন্দ, কাস্টমার যেন নির্ধিদ্বায় নিঃসঙ্কোচে যে কোনো আবদার আপনার কাছে করতে পারে। যেমন- তাঁরা খাবারে কেমন ঝাল বা মিষ্টি পছন্দ করে অথবা তাদের স্পেসিফিক কোন পছন্দ অপছন্দ আছে কিনা তেল মসলার ব্যাপারে ইত্যাদি।
- ক্রেতা রিভিউ হল যে কোনো অনলাইন বিজনেসের বিশ্বস্ততা বাড়ানোর এবং ব্র্যান্ডিং করার মূল হাতিয়ার। রিভিউ পেতে হলে ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করা জরুরী। আর অনলাইনে ক্রেতাদের খুশি করার জন্য সবচেয়ে বেশি কার্যকরি উপায় হচ্ছে ডেলিভারি চার্জ ফ্রি করে দেয়া। এটা নিয়েই উদ্যোক্তারা যত কার্পণ্য করে থাকে এই বলে যে, ৫০০টাকার চেয়েও কম মূল্যের অর্ডারে ১০০ টাকা ডেলিভারি চার্জ ফ্রি দিলে তাদের লাভ কি থাকল। কিন্তু এটা বিবেচনায় নিতে চায় না কেউ যে, উদ্যোগের শুরুতে অন্তত প্রথম ১০০ অর্ডারের ডেলিভারি চার্জ ফ্রি করে দিলে ১০ হাজার টাকার মতো লস হলেও অসংখ্য রিভিউ তাদের বিজনেসের ভ্যালু এড করে দিবে, অনেক রিপিট ক্রেতা এর মাধ্যমে তৈরী হয়ে যাবে। এটাকে মার্কেটিং ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে ধরতে পারলে তাদের বিজনেস এতেই অনেকাংশে এগিয়ে যাবে, দীর্ঘ সময়ের জন্য শক্তিশালী ভিত তৈরী হয়ে যাবে।
- এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করেও খাবারের উদ্যোক্তারা ডেলিভারি চার্জ ফ্রি করে দিতে পারে, যেমন- রোজা, পূজা, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি উপলক্ষ্যে। এটা ক্রেতা বৃদ্ধিতে এবং রিপিট ক্রেতা তৈরীতে বেশ ভালো ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
- উদ্যোক্তাদের সিজনাল বিভিন্ন খাবার আইটেমের কথা মাথায় রেখে সেগুলোর প্রচার করতে হবে সময়োপযোগী কন্টেন্ট তৈরীর মাধ্যমে। যেমন- শীতকাল আসার আগে থেকেই পিঠা নিয়ে লিখতে শুরু করতে হবে, আবার রোজা আসার আগে থেকে ইফতার আইটেম নিয়ে লিখা যেতে পারে।
- প্রত্যেকের রান্নার একটা বিশেষত্ব থাকে, নিজস্ব রেসিপি থাকে। হোমমেইড খাবারের উদ্যোক্তাদের জন্য প্রধান সম্পদ হল, তাদের রেসিপিগুলো। তাই ভুল করেও কারো সাথে রেসিপি শেয়ার করা যাবে না। কেউ রেসিপি জানতে চাইলে সম্পর্ক যত ভালোই হোক না কেনো তা শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে, রান্নার স্বকীয়তা ধরে রাখার জন্য।
- ঢাকার অনেক খাবারের উদ্যোক্তা আছেন, যাদের সুস্বাদু রান্নার সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে গিয়েছে। ঢাকার বাইরের অনেকেই তাদের তৈরী করা খাবার খেতে আগ্রহী। তাই দূরের আগ্রহী ক্রেতাদের কথা বিবেচনায় রেখে শুকনো খাবার আইটেমও রাখতে পারেন উদ্দ্যোক্তারা, যেগুলো খুব অল্প সময়ে পচনশীল না এবং দূরেও ডেলিভারিযোগ্য। যেমন- শুকনো পিঠা, শুকনো মিষ্টি, চকলেট, আচার ইত্যাদি।
আবার দূরের ক্রেতারা তাদের ঢাকায় থাকা আত্মীয়দের জন্যও চাইলে খাবার অর্ডার করে সারপ্রাইজ দিতে পারেন এই ব্যাপারেও আগ্রহ তৈরী করা যেতে পারে।
অনলাইনে খাবারের বাজার বিশাল এবং আমাদের দেশে এখনো তা ঠিক মত শুরুই হয় নি বলা চলে। বাংলাদেশে এর বাজার অনেক বড় এবং হোম মেইড ফুডের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা ডেলিভারি- তা সমাধান করা গেলে এর বাজার রাতারাতি কয়েকগুন বড় হয়ে যাবে।
তবে যারা এদিকে উদ্যোক্তা তাদের আরো বেশি প্রফেশনাল হতে হবে। হোম মেইড ফুডের স্বাদ, হাইজিন আর গুনগত মান নিয়ে তেমন প্রশ্ন বা সন্দেহ নেই। প্রচারের দরকার বিশেষ করে এলাকাভিত্তিক প্রচার। প্রথমে হয়তো ঢাকার মিরপুর আর উত্তরাতে এমন প্রচার শুরু করা যেতে পারে।
মিরপুর ও উত্তরাতে অনেক লোক বাস করে এবং ই-কমার্সের অনেক কাস্টমার রয়েছে। এদিকে যারা কাস্টমার তারা যদি নিজ এলাকার উদ্যোক্তাদের সম্পর্কে জানতে পারেন তাহলে অর্ডার করলে অনেক দ্রুত সার্ভিস বা ডেলিভারি পেতে পারেন। বিশেষ করে দুপুরের লাঞ্চ সবাই গরম গরম পেতে ও খেতে পছন্দ করেন।
বাংলাদেশে অনলাইনে হোম মেইড ফুড নিয়ে তেমন কোন ওয়েবসাইট নিয়ে। ফুড পান্ডার মত ডেলিভারি কোম্পানি গুলো আসলে রেস্টুরেন্ট ফুড নিয়ে কাজ করতে বেশি আগ্রহী। তাছাড়া এ নিয়ে কোন রকম গবেষণা, রিপোর্ট এসব কিছুও হয় নি। এগুলো করার দরকার যত দ্রুত সম্ভব।
লেখকঃ রাজিব আহমেদ, প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং খাতুনে জান্নাত আশা, প্রতিনিধি, টেকজুম ডট টিভি