বাংলাদেশে ই-কমার্সের শুরুটা অনেক আগে হলেও মূলত তা ছিল ঢাকা কেন্দ্রিক। সেই ১৯৯৯ সাল থেকে সীমিত আকারে ই-কমার্সের সেবা চালু হয় এবং তা সরকারি স্বীকৃতি পেতে বা সরকারী আইনগত স্বীকৃতি পেতে আরও ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়। আর ই-কমার্সের বছর হিসেবে বলা যায় ২০১৫ সালকে যখন ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) সরকারী বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের স্বীকৃতি পায় ট্রেড এ্যাসোসিয়েশন বা বানিজ্য সংগঠন হিসেবে। ২০১৫ সাল থেকে ই-ক্যাবের নেতৃত্বে ই-কমার্সকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেবার জন্য নানান ভাবে চেষ্টা করা হয়। তবে সত্যিকারের পরিবর্তন আসে ২০২০ সালে করোনার মধ্যে।
তবে এখনো ঢাকার বাইরে বিশেষ করে ছোট ছোট জেলা শহরগুলোতে ই-কমার্স উদ্যোক্তার সংখ্যা অনেক কম এবং ই-কমার্সের কাস্টমারও কম। তবে সুন্দরবন, এসএ পরিবহন সহ বেশ কয়েকটি কুরিয়ার সার্ভিস জেলা শহরের পাশাপাশি উপজেলা শহরগুলোতেও তাদের শাখা অফিস খোলাতে ডেলিভারি সুবিধা এখন অনেক বেড়েছে। তবে এখনো উপজেলা পর্যায়ের ই-কমার্স নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তা করছি না।
এ নিয়ে এখন থেকেই শুধু চিন্তাভাবনা না, কাজ শুরু করতে হবে। ই-ক্যাবের সাবেক এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ ২০২০ সালের শেষের দিকে জেলাভিত্তিক ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলেন যে, ই-কমার্সের ব্যাপারে প্রতিটি জেলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং এক্ষেত্রে জেলা পণ্যকে তুলে আনতে হলে জেলা পর্যায়ের ই-কমার্সকে গুরুত্ব দিতে হবে। তবে ২০২১ সাল ধরে আরিফা মডেল দিয়ে জেলা পর্যায়ের ই-কমার্স ও দেশি পণ্যকে তুলে আনার চেষ্টা করলেও এটি খুব বেশি সাফল্যের মুখ দেখে নি। আবার অন্যদিক দিয়ে চিন্তা করলে এটি অনেক গুরুত্বপূর্ন একটি পদক্ষেপ ছিল। কারন এর মাধ্যমে জেলা পর্যায়ের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির ভীত তৈরীর কাজ শুরু হয়ে গেছে এবং এটি নিয়ে এখন অনেকেই চিন্তা ভাবনা করছেন।
জেলা পর্যায়ে যদি ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি ভালমত প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে তা ক্রমান্বয়ে উপজেলা পর্যায়ে ছড়িয়ে পরবে। উপজেলা পর্যায়ে কাজ করার বেশ কিছু অসুবিধাও রয়েছে। যেমন- ময়মনসিংহ জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলা রয়েছে এবং সেই উপজেলাগুলোতে বিভিন্ন রকমের পণ্য উৎপাদিত হয়। হালুয়াঘাটে এক সময় বেশ সচল এবং সমৃদ্ধ তাঁতশিল্প ছিল, কিন্তু তা এখন অনেকাংশে ঝিমিয়ে পরেছে। এখন এই উপজেলা পর্যায়ে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে আনতে হলে প্রথমে প্রতিটি উপজেলার পণ্যগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং সেগুলোর প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। হালুয়াঘাটের তাঁতশিল্পের প্রচারের ব্যাপারে এগিয়ে আসেন ময়মনসিংহের আরিফা খাতুন, খাতুনে জান্নাত আশা, ফারজিনা আক্তার রুমা, মোছা. রোখসানা সুলতানা, সালমা আক্তার শিল্পী প্রমুখ দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তারা।
কিন্তু এ ধরণের প্রচেষ্টা আরও বেশি সফল হবে যখন ময়মনসিংহ জেলা থেকে নয়, বরং হালুয়াঘাটের মতো উপজেলা পর্যায়ের উদ্যোক্তারা তাদের নিজের উপজেলার পণ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করবেন এবং সোর্সিং করে বিক্রি করার চেষ্টা করবেন ফেইসবুক বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। এটি হয়ত অনেকের কাছে এখন অবিশ্বাস্য স্বপ্ন বা আকাশ-কুসুম কল্পনা বলে মনে হতে পারে। কিন্তু এক বা দুই বছর পরে এটিই বাস্তবতা হয়ে যাবে।
ই-কমার্সে দুই ধরণের লোক থাকে। প্রথমত হচ্ছে উদ্যোক্তা, দ্বিতীয়ত কাস্টমার। উপজেলা পর্যায়ে কাস্টমারের সংখ্যা বৃদ্ধিতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তারা আসলে সবচেয়ে বেশি চায় সহজে ডেলিভারি এবং হোম ডেলিভারি। তাই যদি কোনো উপজেলা শহরে প্রোডাক্ট অর্ডার বৃদ্ধি পায়, তাহলে কুরিয়ার সার্ভিসগুলো হোম ডেলিভারি দিতে আগ্রহী হবে। আর তা না হলে তাদের এখনো কুরিয়ার অফিসে এসে ডেলিভারি নিতে হবে, এই পদ্ধতিতেই কুরিয়ারগুলো কাজ করতে থাকবে নিজেদের সার্ভিস আর আপডেট করার চিন্তা না করে। আর উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে বলতে হয় যে, উপজেলা পর্যায়ে যেসব পণ্যের জনপ্রিয়তা বা সম্ভাবনা রয়েছে সেগুলো নিয়ে যদি তারা কাজ করে , তাহলে সেই সব পণ্যগুলোকে সারাদেশে তুলে ধরা খুব সহজ হবে। আর প্রতিটি উপজেলায় হয়ত নানা ধরণের খাবার মিষ্টি আইটেম এগুলো রয়েছে। তবে রসালো মিষ্টি কুরিয়ারের মাধ্যমে দূরে পাঠানো অসম্ভব। সেক্ষেত্রে শুকনো মিষ্টি অথবা অন্যান্য শুকনো খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যদি কাজ করা হয়, তাহলে তা অনেক বেশি সহজ হবে।
ফেইসবুকের যুগে ফেইসবুকে একটি পেইজ খুলতে কোন টাকা লাগে না এবং দেশি পণ্যের এখন অনেক গ্রুপ রয়েছে যেগুলোতে তারা বিনামূল্যেই প্রোডাক্টের ছবিসহ পোস্ট করতে পারে, প্রোডাক্ট নিয়ে নিয়মিত লিখতে পারে। তাই এ ধরণের গ্রুপগুলোতে কিছুদিন আগে সময় দিয়ে পরিচিত হলে, পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং গড়ে তুলতে পারলে তারপরে কাজ করাটা অনেক বেশি সুবিধাজনক হবে। একজন উদ্যোক্তা তার নিজেকেও পরিচিত করবেন, পাশাপাশি পণ্য নিয়েও পোস্ট দিয়ে মানুষকে সেই পণ্য সম্পর্কে আগ্রহী করে তুলবেন।
আর ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকেই ই-ক্যাবের সাবেক ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাজিব আহমেদ বলে এসেছেন, নিজের প্রোফাইলে দেশি পণ্য নিয়ে পোস্ট দেয়ার জন্য। প্রতিদিন ছবিসহ ৫-৬ লাইনের একটি পোস্ট লিখতে ১০ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা না। তাই উপজেলা পর্যায়ের উদ্যোক্তারা যদি নিজেদের প্রোফাইলে যে পণ্য নিয়ে কাজ করছেন তা নিয়ে প্রতিদিন পোস্ট দেন তাহলে তা তাদের পরিচিতি বৃদ্ধিতে অনেক বেশি সাহায্য করবে এবং তাদের ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা সবার মাথায় অন্তত তার পণ্যের নাম গেঁথে যাবে।
প্রধানত যে কারণে শুধু উপজেলা পর্যায়ের না সারাদেশের দেশীয় পণ্যের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিই পিছিয়ে আছে বলা যায় তা হল, দেশীয় পণ্যগুলো নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ কন্টেন্টের ঘাটতি। আর এই ঘাটতি দূর না হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ, ই-কমার্স সেক্টরে কাজ করতে আসা বেশির ভাগ মানুষের পড়ালেখার প্রতি অনাগ্রহ। অথচ এই ইন্ডাস্ট্রিটাই হল দক্ষ লোকদের কাজের জায়গা। বেশির ভাগ উদ্যোক্তারা নিজেদের পণ্য নিয়ে পড়ালেখা করাকেও লস মনে করে। কিন্তু নিজের পণ্য নিয়ে জানলে, নিজ জেলা উপজেলার পণ্যগুলো নিয়ে জেনে সেগুলো নিয়ে নিয়মিত লিখলে বরং মানুষের আগ্রহ এবং ভরসা সেই সব উদ্যোক্তার প্রতি বাড়বে। মানুষ বুঝতে পারবে এই উদ্যোক্তা তার পণ্য সম্পর্কে ভালো জানে, তার থেকে পণ্য সম্পর্কিত যে কোনো সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে।
আর জেলা উপজেলা ভিত্তিক পণ্যগুলো নিয়ে ইন্টারনেটে তথ্যবহুল কন্টেন্ট যত বাড়বে, সেই পণ্যগুলো তত বেশি মানুষের কাছে পরিচিত হবে, সোর্সিং করা সহজ হবে। আর কন্টেন্টের মাধ্যমে পণ্য সম্পর্কিত সব সমস্যা সম্ভাবনাগুলো উঠে আসার মাধ্যমে সরকারী বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সহযোগিতা পাওয়ার সুযোগ তৈরী হবে। তাই অনলাইনে কাজ করা দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তাদের উচিত সবার আগে পড়াশোনায় এবং স্কিল ডেভেলপমেন্টে সময় দেয়া। তাহলেই স্টোরি টেলিং এর মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক পণ্য নিয়ে আকর্ষনীয় কন্টেন্ট তৈরী করে দেশি পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারবে।
সবচেয়ে ভালো হত প্রতিটি উপজেলা থেকে কয়েকজন সিরিয়াস উদ্যোক্তা পাওয়া গেলে, যারা একসাথে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করা এবং লেখাপড়া করায় আগ্রহী। একসাথে কয়েকজন মিলে কাজ করলে যে কোন কাজ অনেকাংশে সহজ হয়ে যায়। হালুয়াঘাটের তাঁতশিল্প যেমন পরিচিতি পেয়েছে ময়মনসিংহের কয়েকজন একসাথে মিলে কাজ করেছে, লেখালেখি করেছি, বর্তমানের বাস্তবচিত্রটা লেখার মাধ্যমে তুলে ধরেছে বলে। ঠিক এমনভাবেই প্রত্যেকটা উপজেলার বিশেষ শিল্প বা পণ্যকে কয়েকজন মিলে তুলে ধরতে পারে, সারাদেশেই নিজ এলাকার পণ্যকে জনপ্রিয় করতে পারে এবং একদম রুট লেভেলের পণ্যগুলো সংগ্রহ করে সারাদেশে সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারে।
লেখকঃ রাজিব আহমেদ, প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং খাতুনে জান্নাত আশা, প্রতিনিধি, টেকজুম ডট টিভি