টেনে ধরা হচ্ছে দেশের কুরিয়ার সার্ভিসের লাগাম। কিছু কুরিয়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে অবৈধ মালপত্র পরিবহন করা ও অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠে সরকারের বিভিন্ন মহলে। সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে দেওয়া হয় এমন তথ্য।
কুরিয়ার সার্ভিসের কারণে প্রাচীন আমলের ডাক সার্ভিস হিমশিম খাচ্ছে প্রতিযোগিতায়। এখন কুরিয়ার সার্ভিসের কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনতে চাইছে সরকার। এ জন্য একটি লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির চেয়ারম্যান থাকবে। কেউ কুরিয়ার সার্ভিস চালু করতে চাইলে অবশ্যই আবেদন করতে হবে কর্তৃপক্ষের কাছে। আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে তিন মাসের মধ্যে সংশ্নিষ্টকে লাইসেন্স প্রদান করা হবে। এ জন্য নতুনভাবে ডাক আইন প্রণয়ন করছে সরকার। ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তুত করেছে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেওয়া হচ্ছে। শিগগির আইনটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হতে পারে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্স কর্তৃপক্ষ জানান, দেশে বর্তমান ১১শ’ কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে ১২৮টি প্রতিষ্ঠানের। লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২৬টি পরিচালনা হচ্ছে পণ্য আদান-প্রদানে এবং ৮টি আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান। তিনি অবৈধ কুরিয়া সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করতে বলেন।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, লাইসেন্স ফি, চার্জ ও কমিশন নির্ধারণ করবে সরকার। এই আইনের অধীনে প্রণীত বিধিমালা অমান্য করলে মেইলিং অপারেটর বা কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের দণ্ড ও শাস্তির বিধান থাকবে। সরকার একটি জাতীয় কুরিয়ার সার্ভিস নীতি তৈরি করবে। রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো দ্রব্যাদি গ্রহণ, পরিবহন, বিতরণ করলে ওই মেইলিং অপারেটর বা কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শুল্ক্ক কর্তৃপক্ষ, লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে কুরিয়ার দ্রব্যাদি বহনকারী যানবাহনের গতিরোধ করতে পারবে। যারা এই আইন ও বিধির শর্ত মেনে আবেদন করবেন না, কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স পাবেন না তারা। তবে আবেদনকারীকে ৩০ দিনের মধ্যে লাইসেন্স না দেওয়ার কারণ লিখিত আকারে জানানো হবে। শর্ত ভঙ্গ করলে লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ কুরিয়ার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে। তবে ১৫ দিন সময় দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে শুনানির যুক্তিযুক্ত সুযোগ দেওয়া হবে। আরও বলা হয়, দেশের যেসব স্থানে ডাকসেবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেইসব স্থানে ডাকসেবা প্রদানের জন্য কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী
প্রাপকের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান বা সুবিধা গ্রহণ ছাড়া সেবা প্রদান করবেন। জল, স্থল ও আকাশপথে প্রাপকের কাছে ডাক পৌঁছানো হবে। অন্ধ, বধির, প্রতিবন্ধী, অটিস্টিকসহ বিশেষায়িত চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ প্রকৃতির শিক্ষাসামগ্রী ডাক অধিদপ্তর বিনামূল্যে গ্রহণ, পরিবহন ও বিতরণ করবে। এ-সংক্রান্ত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে সরকার।
ডাক গ্রহণকালে গ্রহণকারীর সামনেই মোড়কীকরণ করে প্রেরককে ঘোষণাপত্র দিতে হবে- এতে আইনে নিষিদ্ধ কোনো পণ্য নেই। মেইলিং অপারেটর বা কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণের জন্য গঠিত লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রশাসনিক আওতাধীন একটি পৃথক সংস্থা হিসেবে গঠিত হবে। এই সংস্থার কার্যক্রম কর্মপরিধি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। সরকার এই আইনের আওতায় মেইলিং অপারেটর বা কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানের মেইলিং সেবা ব্যবসা পরিচালনার শর্তবলি আরোপ করবে।
আইনে আরও বলা হয়, নতুন ব্যবসায়িক প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে পোস্টশপ, ই-কমার্স, অ্যাড্রেস ডাটাবেজসহ অন্য কোনো ডাটাবেজ চালু, বাণিজ্যিক সুবিধার্থে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেন বিনিময় ও আন্তঃবিনিময় করতে পারবে। রেমিট্যান্স ট্রান্সফার সেবা, ব্যাংকিং সেবা, ডাক জীবন বীমা এককভাবে প্রদান করতে পারবে।
ডাক দ্রব্যাদি বলতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে ডাকযোগে পাঠানো বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক ডাক দ্রব্যাদি অর্থাৎ পোস্ট কার্ড, মুদ্রিত কোনো বার্তা, পাণ্ডুলিপি, ব্যক্তিগত বা দাপ্তরিক বা অন্য যে কোনো ধরনের মোড়ক, সাধারণ চিঠিপত্র, রেজিস্টার্ড চিঠিপত্র, নিউজ পেপার, অভ্যরীণ ও আন্তর্জাতিক পার্সেল, বীমা সার্ভিস, ভ্যালু পেয়েবল সার্ভিসেস, মানি অর্ডার, জিইপি, ইএমএস, লজিস্টিকস সেবা, ডকুমেন্টস সার্ভিস, পার্সেল সার্ভিস, ডেলিভারি সার্ভিস, এক্সপ্রেস সার্ভিস, বিশেষায়িত ও প্রিমিয়ার পোস্ট সার্ভিস এবং সরকার ঘোষিত ডাক বোঝানো হয়েছে।
আর কুরিয়ার সার্ভিসের লেনদেনের বিষয়ে ডাক বিভাগের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক যৌথভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তে আরও বলা হয়, লাইসেন্স কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত কুরিয়ার সার্ভিসের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। পাশাপাশি অনুমোদনবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবিলম্বে বন্ধ করার নির্দেশনা দেয়া হয় ওই বৈঠক থেকে।
সেখানে আরও বলা হয়, এখন থেকে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা-২০১১ অনুসরণ করতে হবে। জানা গেছে, অনুমোদনহীন কুরিয়ার সার্ভিসগুলো অবৈধভাবে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠানের ডাক ও দ্রব্যাদি আদান-প্রদানের মাধ্যমে টাকা হস্তান্তর ও স্থানান্তর করছে। এতে সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।