চাঁদে পদার্পণে প্রথম হওয়ার পর চাঁদে ঘুমানো প্রথম মানুষ হবারও সুযোগ ছিল তাদের। কিন্তু একজন বড়জোর ঝিমিয়েছিলেন, অপরজন নির্ঘুম ছিলেন। নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিনের চাঁদঘুমের গল্প।
চাঁদে অবতরণের পর কিছু ‘বৈজ্ঞানিক হাঁটাহাঁটি’ সেরে আবার পরিভ্রমণযান ইগলে ঢুকে পড়লেন নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন। কয়েকঘণ্টা পর (২১ জুলাই ১৯৬৯) পৃথিবীতে ভোর নামলে, ‘জাগো, ওঠো, জাগো’ চন্দ্রচারীরা এই বলে গ্রহ থেকে বাজানো ‘ঘণ্টি’র সুর তাদের জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু জাগাবে কী করে, তারা তো ‘প্রায় জেগে’ই ছিলেন। না, তারাও ঘুমাতে পারেন নি, সেদিন চাঁদে। কেন তারা ঘুমাতে পারেননি? চাঁদে প্রথম পা রাখা আর্মস্ট্রং ও ১৯ মিনিট পর তাকে অনুসরণ করা অলড্রিন।
এরা অভিযান চালিয়েছেন চাঁদের ‘প্রশান্তির সাগর’ (সি অব ট্রাংকুইলিটি) নামের অঞ্চলে। কিন্তু তাদের চন্দ্রচারী যন্ত্রযান ইগলকে এমন ভাবে বানানো হয়নি যাতে তারা ‘প্রশান্তির ঘুম’ সেখানে পাড়তে পারেন। ইগলের ভেতর জায়গা ছিল ১৬০ ঘনফুটের। কিন্তু এর ভেতর কোনো বিছানা ছিল না, ছিল না কোনো আসনও। আবার ওরা দুজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পোশাকে আচ্ছাদিত ছিলেন।
ইগলই বা তবে কেন বিছানা বা আসন ছাড়া নকশা করা হয়েছিল। এর কারণ হলো অতিরিক্ত ভারী না করা। এর ভেতর এমনিতেই ভারী ভারী যন্ত্রপাতি আর গিয়ারে ভরা ছিল। আরও বেশি ভারী হলে অবতরণ এবং বিশেষ করে চাঁদ থেকে আবার উড্ডয়ন করে কক্ষপথে ঘুরতে থাকা মাইকেল কলিন্সের অ্যাপোলো-১১ চন্দ্রযানে যুক্ত হওয়া ইগলের জন্য অগ্নিপরীক্ষা হয়ে উঠতে পারত।
চাঁদে পদার্পণে প্রথম হওয়ার পর চাঁদে ঘুমানো প্রথম মানুষ হওয়ার সুযোগ ছিল তাদের। কিন্তু দুজনেরই একজনও ঠিকঠাক ঘুমাতে পারলেন না। পৃথিবী থেকে নিয়ন্ত্রণকক্ষের বিজ্ঞানীরা যখন ওদের কাছে ‘জাগরণী ঘণ্টি’ বাজালেন, মানে ফোন করা হলো, অলড্রিন জানিয়েছিলেন, ‘নিল ইঞ্জিনের কাভারে শুয়ে ছিলেন। আর আমি মেঝেতে কোনো মতে কুঁকড়ে-মুকড়ে ছিলাম।’
ইগলের ওই ছোট্ট কেবিনটা একদিকে যেমন যন্ত্রপাতিতে ঠাঁসা ছিল। আবার জ্বলতে থাকা সতর্কবাতির কারণে আলোকোজ্জ্বলও ছিল। তার ওপর ছাউনি থাকা সত্ত্বেও ইগলের জানালা গলে সূর্যের প্রখর কিরণ ঢুকে পড়ছিল। আর্মস্ট্রং তো আরেকটি অসুবিধার কথা জানিয়েছিলেন। তার ভাষায়, ‘সবকিছু সেরে আমি যখন ঘুমাতে যাব, টের পেলাম, [আমাকে বিরক্ত করার জন্য] আরেকটা জিনিস আছে।’ কী সেটা? সেটা হলো পেরিস্কোপ ধাঁচের একটা অপটিকাল টেলিস্কোপ। আর্মস্ট্রংয়ের বর্ণনায়, ‘ওই টেলিস্কোপের মধ্য দিয়ে আমার চোখে জ্যোতির্ময় পৃথিবীর প্রতিচ্ছবি এসে পড়ছিল। যেন আলোর একটা বাতি।’
খানিকটা প্রশান্তি দিতে পারত তাদের পোশাক। কিন্তু এর হিমায়ন-ব্যবস্থা চাঁদের পৃষ্ঠের জন্য উপযোগী হলেও, ইগলের ভেতরে ঘুমানোর জন্য এটা যথেষ্টই শীতল ছিল।’
এসব কারণে অলড্রিন কোনো মতে ঘণ্টা দুয়েক ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে পার করলেন। আর আর্মস্ট্রং পুরোটা সময় জেগেই রইলেন।
মহাদুপুরে ভাতঘুম : জ্যঁ-ফ্রাঁসোয়া মিলেটের ‘সিয়েস্তা’ (স্প্যানিশ এই শব্দের অর্থ দিবাতন্দ্রা) অনুকরণে ১৮৯০ সালে এই মহাদুপুরের আলেখ্য রচনা করেন ভিনসেন্ট ভ্যান গগ। ডাচ এই শিল্পী এর কোনো নাম দেননি। অনেকে একে ‘দুপুরের বিশ্রাম’ (নুন রেস্ট ফ্রম ওয়ার্ক) বলে থাকে। আমরা একে ‘ভাতঘুম’ বলতে পারি।
পৃথিবীতে ভোর হলো। হাউস্টোন থেকে ফোন গেল, ‘ট্রাংকুইলিটি বেজ, ট্রাংকুইলিটি বেজ। হাউস্টোন। ওভার।’
চাঁদ থেকে আর্মস্ট্রংয়ের পাল্টাকণ্ঠ শোনা গেল, ‘গুড মর্নিং, হাউস্টোন। ট্রাংকুইলিটি বেজ। ওভার।’ দীর্ঘ একটা দিন শেষ হলো। এবার সময় হলো বাড়ি ফেরার। অন্তত এক রাত্র প্রশান্তির ঘুম পাড়তে পৃথিবীতে ফেরা চাই।
চাঁদের সবচেয়ে কাছের মোটেল তথা পর্যটন-হোটেলও (পৃথিবী) কম করে তিন লাখ ৮৪ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূরে। তাই ভবিষ্যতের চন্দ্রচারীদের ঘোরঘুমের জন্য চাঁদে বা কাছেধারে ঘুমঘরের ব্যবস্থা নিতে হবে আমাদের।