২৯ ফেব্রুয়ারি দিনটায় আর কেউ জন্মাবেন না! হবে না কারও মৃত্যু, দুর্ঘটনাও। গৃহপ্রবেশ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বা কোনও উৎসব, পার্বণ কিছুই হবে না এই দিনে। কেনা যাবে না জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটও। কারণ, পৃথিবী থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি দিনটাই উবে যাবে কর্পূরের মতো।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, পৃথিবীর নিজের অক্ষের চার দিকে ঘূর্ণনের গতি উত্তরোত্তর কমে আসছে। চাঁদ আমাদের ছেড়ে একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে বলে। তার ফলে, আমাদের উপর চাঁদের টান (‘টাইডাল ফ্রিকশন’) কমে যাচ্ছে। তাই একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে দিনের আয়ু। প্রতি শতাব্দীতে ১৪ মিলিসেকেন্ড করে।
মুছে যাওয়া দিন কি পিছু ডাকবে?
যার অনিবার্য পরিণতি, পৃথিবী থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি দিনটির বিলুপ্তি। আমাদের উপর চাঁদের ‘মায়া’ কমে যাওয়ার ফলেই পার্থিব বছর থেকে আস্ত একটা ২৪ ঘণ্টার দিন হারিয়ে যাবে। চিরতরে।
নাসার গর্ডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের গবেষণা জানাচ্ছে, ৪০ লক্ষ বছর পরে ২৯ ফেব্রুয়ারি দিনটা আর থাকবে না পৃথিবীতে। থাকবে না চার বছর পর পর তার ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা।
কী ভাবে এসেছিল ২৯ ফেব্রুয়ারি?
সে আজ থেকে ২ হাজার ৬৬ বছর আগেকার কথা। খ্রিস্টের জন্মের ৪৬ বছর আগে (৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)। পৃথিবীর বছরের হিসাব তখন অন্য ভাবে করা হত। ভাবা হত, একটা বছর শেষ হতে লাগে ৩৬৫ দিন।
কিন্তু তাতে কোথাও যেন একটা ভুল থেকে যাচ্ছে, প্রথম আন্দাজ করা গেল রোমের তদানীন্তন সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সময়। গলদটা সম্রাটকে ধরিয়ে দিলেন এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী। সসিজেনিস।
ভাবনা জুলিয়াস সিজারের। সেই সুপ্রাচীন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার।
সিজার বুঝলেন, তড়িঘড়ি বানাতে হবে নতুন ক্যালেন্ডার। আর সেটা কার্যকর হতে হবে পরের বছর (৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকেই। সেই ক্যালেন্ডারের নামকরণ করা হল সম্রাট জুলিয়াস সিজারের নামেই। ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’।
কলকাতার ‘পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারে’র (পিএসি) অধিকর্তা সঞ্জীব সেন জানাচ্ছেন, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে বছরের হিসাবটা করা হল, অন্য ভাবে। দেখা গেল, একটা পার্থিব বছর শেষ হতে সময় লাগে ৩৬৫ দিনের কিছু বেশি। সঠিক ভাবে বলা হলে, ৩৬৫.২৪২১৯ গড় সৌর দিবস (‘মিন সোলার ডে’)। তাই ৩৬৫ দিনের পার্থিব বছরের নিরিখে বানানো ক্যালেন্ডার চালু থাকলে চার বছর অন্তর পার্থিব বছরের আয়ু একটা দিন বেশি হয়।
হিসেব কষে দেখা গেল, পার্থিব বছরের সময়ের সেই ক্ষয়ক্ষতির প্রায় পুরোটাই পুষিয়ে দেওয়া যায় চার বছর অন্তর ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গে একটা দিন জুড়লে। জন্ম হল ২৯ ফেব্রুয়ারির। যার নাম- ‘লিপ ডে’। সেই দিনটা যে বছরে ফেব্রুয়ারিতে জুড়বে, সেই বছরটার নাম হল ‘লিপ ইয়ার’। দেখা গেল, যে বছরগুলিকে ৪ দিয়ে ভাগ করলে কোনও ভাগশেষ থাকে না, সেই বছরগুলিই ‘লিপ ইয়ার’ হয়।
দীর্ঘতম পার্থিব বছরে ছিল ৪৪৪টি দিন
তা অন্তর্ভুক্ত হল জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে। আর সেটা তড়িঘড়ি ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে করতে গিয়েই রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সাম্রাজ্যে ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দটি হয়ে পড়ল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দিনের বছর। ৪৪৪ দিনের।
লিপ ইয়ার: ৪ এবং ৪০০-র হিসাব
তার পর কেটে গেল আরও প্রায় ১৬০০ বছর। সেটা ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ। তদানীন্তন পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি চার বছর অন্তর ‘লিপ ডে’গুলিকে আরও নিখুঁত ভাবে সাজাতে চাইলেন।
৪৪৮ বছর আগে। চালু হল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার।
সঞ্জীবের কথায়, ‘‘হিসেব কষে দেখানো হল, পার্থিব বছরের আয়ু ৩৬৫.২৪২১৯ গড় সৌর দিবস বলে প্রতি ৪০০ বছরে ৯৭টি দিন বেশি হয়। সেই দিনগুলিকে পার্থিব বছরের হিসেবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হলে কোনও শতাব্দীর যে বছরগুলির শেষে রয়েছে দু’টি শূন্য (০), তাকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করতে হবে। তাতে ভাগশেষ থাকলে সেই বছরগুলি আর লিপ ইয়ার হবে না। না থাকলে, সেগুলি লিপ ইয়ার হবে। তাই ২০০০ সাল লিপ ইয়ার হলেও, ২১০০, ২২০০ এবং ২৩০০ সাল তিনটি লিপ ইয়ার হবে না।’’
শতাব্দীর বাকি বছরগুলিকে আগের মতোই ৪ দিয়ে ভাগ করা যাবে। তাতে ভাগশেষ থাকলে সেগুলি লিপ ইয়ার হবে না। যেগুলিতে ভাগশেষ থাকবে না, সেগুলি হবে লিপ ইয়ার।
পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির আমল থেকেই আরও নিখুঁত ক্যালেন্ডার বানানো হল। যার নাম- ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’। এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারই এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেনে চলা হয়।