মানুষ নিজেদের মতো বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজে রয়েছে শত শত বছর ধরে। অন্য কোনো গ্রহে আর কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী রয়েছে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়রান হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এখন এই সন্ধানের পথে এক আলোর দিশা পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গাতেই রয়েছে আমাদের মতো অনেকগুলো সভ্যতার অস্তিত্ব, যাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারি। অনেকগুলো মানে কতগুলো? বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ছায়াপথে ভিনগ্রহবাসী প্রাণীর তৈরি এমন অন্তত ৩৬টি সভ্যতা রয়েছে।
ফোর্বস–এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের সৌরজগতের বাড়ি যে মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা ছায়াপথে, সেখানে ১০ হাজার কোটি থেকে ৪০ হাজার কোটি নক্ষত্র থাকতে পারে এবং নক্ষত্র প্রতি একটি করে এক্সোপ্ল্যানেট বা পৃথিবীসদৃশ গ্রহ থাকতে পারে। আমাদের সৌরজগতের সব গ্রহ সূর্যের চারপাশের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। অন্যান্য নক্ষত্রের চারপাশে প্রদক্ষিণ করা এ রকম গ্রহগুলোকে এক্সোপ্ল্যানেট বলা হয়।
এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা নিবন্ধ দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত হয়েছে। নতুন গবেষণা নিবন্ধে মিল্কিওয়েতে কমিউনিকেটিং এক্সট্রা-টেরিস্ট্রিয়াল ইন্টেলিজেন্ট (সিইটিআই) সভ্যতার সংখ্যার কথা বলা হয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না, থাকলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা সম্ভব কি না—দীর্ঘদিনের এসব প্রশ্নের একটা দিশা মিলল এই গবেষণায়। তাঁরা অনুমান করছেন, অন্যান্য গ্রহে যেমন বুদ্ধিমান জীবনের উদ্ভব হয়েছিল, ঠিক তেমনই আমাদের গ্রহেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল। পৃথিবীতে যেমন বুদ্ধিমান জীবন গঠনে প্রায় পাঁচ শ কোটি বছর সময় লেগেছিল, অন্যান্য গ্রহেও তেমনই সময় লেগেছিল। এ ছাড়া হিসাব করে দেখা গেছে, আমাদের পৃথিবীর মতোই একটি প্রযুক্তিগত সভ্যতা কমপক্ষে ১০০ বছর স্থায়ী হয়। সর্বোপরি পৃথিবীতে প্রযুক্তিগত সভ্যতার উত্থানের আগে বিবর্তনের জন্য ৪৫০ কোটি বছর লেগেছিল এবং এরপর যোগাযোগ করতে সক্ষমতা দেখা দিয়েছিল। অন্যান্য সভ্যতার ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটতে পারে। উন্নত সভ্যতার অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে যোগাযোগ সক্ষমতাকে ধরে নেওয়া হয়।
সহযোগী গবেষক ব্রিটেনের নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটির জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার কনসেলিস বলেছেন, ‘মহাবিশ্বে মানুষ ছাড়া বুদ্ধিমান প্রাণীর উন্নত সভ্যতা আর কতটি রয়েছে, তার একটা আন্দাজ এই প্রথম পাওয়া গেল।’
১৯৬১ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্র্যাঙ্ক ড্রেক এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। দিয়েছিলেন বিখ্যাত সমীকরণ ‘ড্রেক ইকুয়েশন’। এই সমীকরণের সমাধানের জন্য সাতটি মাত্রা বেছে নিয়েছিলেন ড্রেক। তাদের মধ্যে অন্যতম কোনো গ্যালাক্সি বা ছায়াপথে বছরে গড়ে কতগুলো নতুন নক্ষত্র জন্মাচ্ছে, একটি সভ্যতার অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সংকেত তৈরির দক্ষতা অর্জনে প্রয়োজনীয় সময় কিংবা কোনো সময়সীমার মধ্যে ভিনগ্রহীদের পাঠানো সংকেত আমাদের কাছে এসে পৌঁছতে পারে। ড্রেক কথিত এই সাতটি বিষয়ের মধ্যে খুব কম বিষয়ই রয়েছে, যেগুলো গণনাযোগ্য।
গবেষকেরা নির্দিষ্ট ছায়াপথে যোগাযোগে সক্ষম বুদ্ধিমান প্রাণীর সভ্যতার সন্ধান পাওয়ার জন্য যে গণনাপদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, তা ‘অ্যাস্ট্রোবায়োলজিক্যাল কোপারনিকান লিমিট’ নামে পরিচিত। নিবন্ধের লেখক ও নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটির প্রকৌশল অনুষদের সহকারী অধ্যাপক টম ওয়েস্টবি বলেছেন, ‘বুদ্ধিমান সভ্যতার সংখ্যা নির্ধারণের সর্বোত্তম পদ্ধতিটি জীবন–সম্পর্কিত মূল্যবোধের অনুমানের ওপর নির্ভর করে। তবে এই জাতীয় মতামত নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে।’
এ ধরনের গবেষণায় যোগাযোগে সক্ষম সভ্যতার সংখ্যা এযাবৎকালে অনেক বেশি এসেছে। কিন্তু এ গবেষণায় এ সংখ্যা মাত্র ৩৬টি বলা হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, অনেকগুলো বিষয়েই গবেষকেরা রক্ষণশীল অবস্থান নিয়েছেন। যেমন, উন্নত প্রযুক্তির সভ্যতা মাত্র ১০০ বছর টিকবে বলে যে অনুসিদ্ধান্ত টানা হয়েছে, তা অতি সাধারণীকরণ বলা যায়। গবেষকেরা মনে করেন, একেকটি সভ্যতার মধ্যে গড় দূরত্ব প্রায় ১৭ হাজার আলোক বছর। তাই তাদের শনাক্তকরণ এবং যোগাযোগ বর্তমানে অসম্ভব।
বুদ্ধিমান সভ্যতা কত দিন টিকে থাকতে পারে? গবেষণার নেতৃত্বদানকারী নটিংহ্যাম ইউনিভার্সিটির অ্যাস্ট্রোফিজিকসের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার কনসেলিস বলছেন, বুদ্ধিমান সভ্যতার অনুসন্ধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর মাধ্যমে প্রাণ কীভাবে সৃষ্টি হয়, তার উত্তরের পাশাপাশি আমাদের আজকের এই সভ্যতা কত দিন টিকতে পারে, তার ইঙ্গিতও পাওয়া যেতে পারে। যদি দেখা যায়, বুদ্ধিমান প্রাণী আশপাশেই আছে, তাহলে আমাদের এ সভ্যতা কয়েক শ বছরেরও বেশি সময় টিকে থাকবে বলে ধারণা করা যায়। আর যদি আমাদের গ্যালাক্সিতে কোনো সক্রিয় সভ্যতা না থাকে, তবে এটি আমাদের সভ্যতার অস্তিত্বের জন্য এটি খারাপ লক্ষণ।’
ক্রিস্টোফার কনসেলিস বলেন, ‘গবেষণার শুরুতেই আমরা ধরে নিয়েছি যে পৃথিবীর মতো কোনো গ্রহে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর জন্ম কয়েক শ বছরের মধ্যেই হতে পারে। রাসায়নিক সব অনুপাত অনুকূলে থাকলে প্রাকৃতিক পন্থাতেই সময়ের সঙ্গে প্রাণের জন্ম ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে একপর্যায়ে বুদ্ধিমান প্রাণে গিয়ে তা ঠেকবে। আর এই প্রাণীদের তৈরি করা সভ্যতার আজকের মানুষের তৈরি সভ্যতার কাছকাছি পৌঁছাতে কত সময় লাগতে পারে, তার একটি অনুমান নিয়ে আমরা কাজ করেছি। ভিনগ্রহের প্রাণী আমাদের মতোই হবে এমন কিছু বলাটা এর উদ্দেশ্য নয়। বরং ভিনগ্রহের প্রাণী যদি সামনে এসেই দাঁড়ায়, তবে আমাদের খুব বিস্মিত হওয়া উচিত হবে না—এ কথাই আমরা বলতে চাই।’
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের সভ্যতার সংখ্যা ৪ থেকে ২১১টি পর্যন্ত হতে পারে। কনসেলিস ও তাঁর দল অবশ্য ৩৬ সংখ্যাটিতেই আস্থা রাখতে চান। যেহেতু এই গবেষণায় অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগের লক্ষ্যে মহাশূন্যে বিশেষ সংকেত পাঠাতে পারাটাকে একটি ভিত্তি ধরা হয়েছে।
সে যা–ই হোক, আকাশের দিকে তাকানো যাক। দূরে ছড়ানো নক্ষত্রবিথির দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেওয়া যাক। এই করোনাকালে নিজেদের এই দুর্যোগের দিনে, অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীরা যেন ভালো থাকে, এমন সুপ্রত্যাশা ছড়িয়ে দেওয়া যাক। কিংবা ‘কেমন আছ’—নিছক এই প্রশ্নটিই সংকেত আকারে পাঠিয়ে দেওয়া যাক। উত্তর পেতে কত দিন লাগবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, দ্বিমুখী যোগাযোগ সফল হতে হলে মানুষকে টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে। পাল্টা সংকেতটি পাঠ করার জন্য, মানুষকে অন্তত ৬ হাজার ১২০ বছর টিকে থাকতে হবে।