মা-বাবার ব্যস্ততা, সঙ্গে ডিজিটাল যুগের হাওয়ায় শিশু-কিশোররা মোবাইল, কম্পিউটার, টিভি নিয়েই সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করে। যে বয়সে ছুটোছুটি করে খেলার কথা, সে সময়ে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ থাকে ভার্চুয়াল জগতে। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, শিশুদের দিনে ১ ঘণ্টার বেশি কোনোভাবেই টেলিভিশন, ভিডিও অথবা কম্পিউটার গেমের সংস্পর্শে থাকা ঠিক নয়। আর এক বছরের কম বয়সী শিশুদের এ ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিন একেবারেই নিষিদ্ধ।
সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা ডব্লিউএইচও প্রথমবারের মতো শিশু-কিশোরদের স্ক্রিন টাইম নিয়ে কোনো নির্দেশনা প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের নিচে থাকা শিশুদের শারীরিকভাবে অনেক বেশি সক্রিয় থাকতে হবে। অর্থাৎ খেলাধুলা এবং সৃজনশীল কাজের দিকে মনোযোগী করে তুলতে হবে এসব শিশুকে। সেসঙ্গে পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। এ ধরনের চর্চার মধ্যে থাকা শিশুরা জীবনভর ভালো অভ্যাসের মধ্যে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি পরবর্তী জীবনে স্থূলতা ও নানা ধরনের অসুখ-বিসুখ প্রতিরোধ করতে পারে।
ডব্লিউএইচওর নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এক থেকে তিন বছর বয়সী শিশুদের দিনে কমপক্ষে ৩ ঘণ্টা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কার্যক্রমে ব্যস্ত রাখতে হবে। আর এক বছরের কম বয়সী শিশুদের ঘরের মেঝের মধ্যেই নানা ধরনের খেলাধুলা করাতে হবে এবং তাদেরকে কোনোভাবেই ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিনের সংস্পর্শে আনা যাবে না।
প্রয়োজন অনুযায়ী সক্রিয় না থাকার ফলাফলস্বরূপ পুরো বিশ্বেই স্থূল অথবা মাত্রাতিরিক্ত ওজনের মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত ওজনধারীরা হূদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সারের মতো রোগে ভুগে; যার পরিণাম অকাল মৃত্যু।
ডব্লিউএইচওর বিশেষজ্ঞ ডা. ফিয়োনা বুল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্ক্রিনের সঙ্গে আপনার শিশুর মাত্রাতিরিক্ত সময় কাটানো নিয়ে আমরা সতর্ক করছি। অকালমৃত্যু প্রতিরোধ করতে হলে শিশুকাল থেকেই এর চর্চা করতে হবে।’
তিনি জানান, তিনজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন স্থূলতা অথবা অতিরিক্ত ওজনের সমস্যায় ভুগছেন এবং চারজন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন প্রয়োজন অনুযায়ী শারীরিক কসরত করছেন না।
ফিয়েনা বুল জানিয়েছেন, বর্তমানে বিশ্বে পাঁচ বছর বয়সের ঘরে থাকা চার কোটি শিশু অতিরিক্ত ওজন নিয়ে বড় হচ্ছে। অর্থাৎ বিশ্বের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর ওজন অতিরিক্ত। এদের মধ্যে ৫০ শতাংশ আফ্রিকা এবং বাকি অংশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার।
ডব্লিউএইচওর নির্দেশনাবলিতে শৈশবের শুরুটা মূলত ব্যাপক হারে শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের সময়। এ সময়ই মূলত একটি শিশুর মধ্যে পারিবারিক জীবনযাপনের জন্য বিভিন্ন অভ্যাস গড়ে ওঠে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পরিচালিত শত শত গবেষণায় এ ধরনের প্রমাণ মিলেছে।
ভাবলেশহীন আচরণ, হাঁটাহাঁটি অথবা সাইকেল চালানোর চেয়ে যানবাহনে চড়ে যাতায়াত, স্কুলের ডেস্কের ওপর বসে থাকা, টিভি দেখা অথবা সক্রিয় নয়, এমন স্ক্রিনভিত্তিক খেলাধুলায় বেশি আগ্রহের মতো বিষয়গুলো ক্রমে ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী হয়ে পড়ছে। এছাড়া একটি শিশু দিনের পর দিন অপর্যাপ্ত ঘুমালে তার শরীরে অতিরিক্ত চর্বি জমে যায়। বডি ম্যাস ইনডেক্সে এমনটাই বলা রয়েছে। কম সময় ঘুমালে টিভি দেখা ও কম্পিউটারে গেম খেলার প্রবণতাও বেড়ে যায় বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। দুই বছর বয়সী শিশুদের দিনে ১ ঘণ্টার বেশি মোবাইল, টিভি অথবা কম্পিউটারে সময় কাটাতে দেয়া ঠিক হবে না। স্ক্রিন টাইম এর চেয়ে কম হলে আরো ভালো। এর পরিবর্তে শিশুদের পড়া ও গল্প বলায় উৎসাহী করে তুলতে হবে।
দুই বছর বয়সী শিশুদের দৈনিক ১১ থেকে ১৪ ঘণ্টা ভালোভাবে ঘুমাতে হবে। অন্যদিকে চার থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের কমপক্ষে ১৮০ মিনিট বা ৩ ঘণ্টা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। স্ক্রিন টাইম ১ ঘণ্টার বেশি নয় এবং ঘুমাতে হবে ১০ থেকে ১৩ ঘণ্টা।