চলমান মহামারিতে অর্থের প্রবাহ সচল রাখাই ছিল দেশের ব্যাংক খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ। সরকার ঘোষিত লকডাউন-পরবর্তী সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে প্রায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে গ্রাহকসেবা প্রদান। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তির ব্যবহার বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় ব্যাংকগুলো। ঘরে বসে অ্যাকাউন্ট খোলা, ভিসা কার্ডে রেমিট্যান্স পাওয়া কিংবা বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে নগদহীন লেনদেনসহ হাতের মুঠোয় বিভিন্ন ডিজিটাল ব্যাংকিং সুবিধা। ব্যাংকারদের মতে, করোনাকালীন এসব সেবা অন্তর্ভুক্তিতে গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধিসহ উলেস্নখযোগ্য হারে বেড়েছে ডিজিটাল লেনদেনও, যা বিদায়ী বছরে এ মহামারিতেও চাঙ্গা রেখেছে ব্যাংকিং খাতকে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে, আর্থিক খাতে ডিজিটাল পরিষেবা ধীরে ধীরে প্রসারিত করা হচ্ছিল। তবে করোনা মহামারির প্রকোপে এ প্রক্রিয়ায় বেশ গতি এনে দিয়েছে। বিদায়ী বছরে ব্যাংকগুলোর ডিজিটাল পরিষেবা কতটা সম্প্রসারিত হয়েছে, সে সম্পর্কে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড, ইন্টারনেট এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেনের কিছু পরিসংখ্যান রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে দেখা যায়, করোনাকালে সবচেয়ে সফল মোবাইল ব্যাংকিং সেবা। বছরের প্রথম প্রান্তিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২৩ হাজার ২২১ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে এটি কিছুটা হ্রাস পেয়ে এক হাজার ১ লাখ ২১ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা হয়েছে এবং তৃতীয় প্রান্তিকে ৩২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫২৪ কোটি টাকায় ছাড়িয়ে যায়। করোনাকালীন সিটি ব্যাংক একটি অ্যাপের মাধ্যমে বাড়িতে অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধা চালু করে। যার মাধ্যমে এ ব্যাংকের অ্যাপস ডাউনলোড ও একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে মুহূর্তে একটি অ্যাকাউন্ট খোলার সুবিধা চালু হয়। একই সুবিধা দিয়েছে ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড (ইবিএল) সহ আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংক।
এছাড়া একটি ইলেকট্রনিক (ই-কেওয়াইসি) সিস্টেম প্রবর্তনের মাধ্যমে অনলাইনে ব্যাংকিং সুবিধা নিতে পারবেন। গত জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখাতে ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসেবে, প্রতিটি ব্যাংককে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি ই-কেওয়াইসি সিস্টেম চালু করার নির্দেশও প্রদান করে। সূত্র জানিয়েছে, প্রতি মাসে যদি কেউ এক লাখ টাকা বা তার চেয়ে কম পরিমাণে লেনদেন করে সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে ব্যাংকে না গিয়ে ই-কেওয়াইসির মাধ্যমে বাড়িতেই অ্যাকাউন্ট খোলা ও লেনদেন করতে পারবেন। তবে এক লাখ টাকার বেশি লেনদেনের ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যাংকে যেতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) যা হ্রাস পেয়ে ২ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা হয়েছে। তৃতীয় প্রান্তিকে দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট), দ্বিতীয় প্রান্তিকের প্রায় একই রয়েছে। জুলাই ও আগস্টের দুই মাসে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন হয়েছে ২ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা।
এদিকে ডেবিট কার্ডে বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ প্রত্যাহার এবং ক্রয় হ্রাস পেয়েছে। তৃতীয় প্রান্তিকে জুলাই-আগস্ট সময়কালে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকের হিসাবে প্রায় একই পরিমাণে লেনদেন হয়েছিল। প্রথম প্রান্তিকে টার্নওভার ছিল ৪৫ হাজার ১৮২ কোটি টাকা, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ছিল ৩২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। তৃতীয় প্রান্তিকে জুলাই-আগস্টে লেনদেন হয়েছে ৩১ হাজার ৩২৫ কোটি টাকা। বছরের প্রথম প্রান্তিকে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। দ্বিতীয় প্রান্তিকে তা কমে হয়েছে ১৭ হজার ৬১৭ কোটি টাকা। জুলাই-আগস্টের তৃতীয় প্রান্তিকে ১ হাজার ৩৫৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, করোনা মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন ডিজিটাল পরিষেবা অন্তর্ভুক্তি চ্যালেঞ্জ অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। আর্থিক খাতে ডিজিটাল পরিষেবায় দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো এগিয়ে থাকলেও অনেকটা পিছিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো। সীমিত আকারে মোবাইল ব্যাংকিং এবং এটিএম পরিষেবা ছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলোতে ডিজিটাল পরিষেবা খুব কমই রয়েছে।
মহামারি চলাকালে ভিসা কার্ডের মাধ্যমে রেমিট্যান্স উত্তোলনের সুবিধা চালু হয়েছিল। ব্র্যাক ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড এ পরিষেবার সবচেয়ে এগিয়েছিল। ব্যাংকে না গিয়েও গ্রাহকদের রেমিট্যান্সের অর্থ উত্তোলনের সুবিধা চালু করে এই ব্যাংক দুটি। এক্ষেত্রে ব্যাংকে না গিয়ে একটি ভিসা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে যেকোনো ব্যাংকের বুথ থেকে সহজেই টাকা উত্তোলন করতে পারবে গ্রাহক। এছাড়া এ পরিষেবার জন্য কোনো অতিরিক্ত চার্জ প্রযোজ্য নয়। তবে প্রাথমিকভাবে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং জাপান থেকে প্রেরিত রেমিট্যান্স এ কার্ডের মাধ্যমে উত্তোলনের বাধ্যবাধকতা ছিল।
এছাড়া কোভিড-১৯ সময় চালু হওয়া আরেকটি ডিজিটাল পরিষেবা হলো কিউআর কোড। এ কোডটি সহজেই পেমেন্ট করতে প্রয়োজন শুধু স্ক্যান করা। সর্বপ্রথম ইস্টার্ন ব্যাংক এ সেবা চালু করেছিল। পরে সিটি ব্যাংক এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি)ও পরিষেবাটি চালু করে। কিউআর কোড সম্পর্কে জানতে চাইলে, ইবিএল কার্ড ও ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রধান আহসান উলস্নাহ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে প্রাথমিকভাবে রাজধানীর বেশকিছু সুপারশপে এ সুবিধা চালু হয়েছে, তবে ভবিষ্যতে এ সেবা খুচরা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি বলেন, যে গ্রাহকরা করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে বেশ সচেতন, তারা এসব ডিজিটাল পরিষেবাগুলোতে উপকৃত হচ্ছেন। এছাড়া টাকার মাধ্যমে জীবাণু ছড়ায়, তাই বাসায় বসে লেনদেন সেবায় গ্রাহকদের ব্যাপক সাড়া রয়েছে। শুধু ২০২০ সাল কিংবা মহামারি চলাকালেই নয়, আর্থিক খাতে ডিজিটাল পরিষেবা গ্রহণের প্রবণতা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা। ডিজিটাল পরিষেবা সম্প্রসারণের বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রধান সিরাজ সিদ্দিকী যায়যায়দিনকে বলেন, ডিজিটাল ব্যাংকিংই হবে এ সেবার আগামীর চিত্র। শুধু করোনাকালেই নয়, গ্রাহকসেবা প্রদানে যেসব ব্যাংক যত বেশি ডিজিটালাইজড হতে পারবে তারা তত বেশি এগিয়ে থাকবে।