আইটি সেক্টর থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। বর্তমানে ১.৪ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন টেকনোগ্রামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী ও বেসিসের পরিচালক আহমেদুল ইসলাম বাবু। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মিরাজুল ইসলাম।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই
আহমেদুল ইসলাম বাবু :বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইটি একমাত্র ক্ষেত্র, যেখানে আমাদের কাজ করার অফুরান সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা আগামীতে দেশকে আইটিতে লিডিং পজিশনে নিয়ে যেতে পারবো। সে সক্ষমতা আমাদের আছে। ইতোমধ্যেই আমাদের সে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন যদি সঠিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা অনুসারে আমরা আগাতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য খুব ভালো ফল অপেক্ষা করছে। গার্মেন্টসের পর দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সেক্টর হলো আইটি। আইটিকে নিয়ে সরকারের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ রয়েছে। সরকার আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে আইটি সেক্টর থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। আমরা এখন ১.৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে আছি। এটাকে ৫ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকার, বেসিসসহ সদস্য কোম্পানিগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। যেভাবে সবাই কাজ করছে, আমার বিশ্বাস ২০২৫ সালের মধ্যে আমরা ৫ বিলিয়ন ডলার অর্জন করতে পারবো। এর বাইরে আমরা চাচ্ছি এই ৫ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রায় যেন সীমাবদ্ধ না থাকি। আমরা যদি এটাকে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারের দিকে নিয়ে যেতে পারি, তাহলে এই সেক্টরকে একটা রিয়েল ইন্ডাস্ট্রি আকারে দাঁড় করানো যাবে। আমি মনে করি এটা করা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশি সফটওয়্যার খাতকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আহমেদুল ইসলাম বাবু : বাংলাদেশের সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত। এই সেক্টরে আমরা পৃথিবীর সাথে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছি। আইটি ইন্ডাস্ট্রিতে যখনই কোনো নতুন টেকনোলজি আসে, তখনই আমাদের ছেলে-মেয়েরা সেগুলোর সাথে নিজেদের আপডেট করে নিচ্ছে। সফটওয়্যার তৈরির বিষয়ে যদি একদম কোর জিনিসের কথা বলেন, সেখানে হয়তো পশ্চিমা বিশ্ব কিছুটা এগিয়ে আছে; কিন্তু ওই টেকনোলজিকে ব্যবহার করে আমরা যে অ্যাপ্লিকেশনগুলো তৈরি করছি, সেখানে আমাদের পিছিয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। সেগুলো বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়েও ভালো এবং গুণগতমানসম্পন্ন। যেমন, বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বাইরের কয়েকটি উন্নত দেশেও ৪র্থ শিল্প-বিপ্লবের সাথে সংশ্লিষ্ট সল্যুশন তৈরি করে তা রপ্তানি করে যাচ্ছে। তবে একটা বিষয়ে নজর দিলে আরো ভালো করার সম্ভাবনা রয়েছে সেটা হলো, আমাদের টেকনোলজি ইনোভেশনে আরো বেশি জোর দেয়া দরকার। তাহলে দেশের মার্কেটে আরো মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি করা সম্ভব।
দেশীয় বড় কোম্পানিগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদেশ থেকে সফটওয়্যার আমদানি করে কেন?
আহমেদুল ইসলাম বাবু : আমাদের দেশে আইটিশিল্পটা খুব বেশি দিনের না। আমাদের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ক্যাপাসিটি সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। আমরা যে দেশেই বিশ্বমানের সফটওয়্যার তৈরির মতো ক্যাপাসিটি তৈরি করে ফেলছি, এটা অনেকের কাছেই অজানা। আমাদের তৈরি কোড, সফটওয়্যার সল্যুশনগুলো বিশ্বমানের, অথবা এর চেয়েও ভালো। বিষয়টা অনেক জায়গায় জানানো সম্ভব হয়নি। আর দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি সফটওয়্যারের যে গ্রহণযোগ্যতা, সেটা আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে। এটা আমাদের জানার ও সচেতনতার অভাব। অন্যদিকে আমাদের মানসিকতাও একটা বিষয়। বিদেশি পণ্যই ভালো, দেশীয় পণ্য তত বেশি ভালো না। আন্তর্জাতিক ব্র্র্যান্ডের জিনিসের প্রতি মানুষের একটা অন্ধ বিশ্বাস রয়েছে। অথচ আমাদের দেশেও অসংখ্য বিশ্বমানের সফটওয়্যার কোম্পানি আছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক গুণগতমনসম্পন্ন সফটওয়্যার তৈরি করছে। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় দেশের সাথে সফলভাবে ব্যবসা করে আসছে, এই বিষয়গুলো সবাই জানেন না। এসব সফলতার গল্পগুলো জানলে দেশি বড় বড় কোম্পানিগুলো তাদের কোম্পানির অটোমেশনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লোকাল সফটওয়্যার নিবে। এই জায়গাটাতে কাজ করতে হলে আমাদের ব্র্যান্ডিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। লোকাল সফটওয়্যার সম্পর্কে তাদের স্বচ্ছ ধারণা দিতে হবে।
দেশের সফটওয়্যার শিল্প বিকাশে কোন দিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন?
আহমেদুল ইসলাম বাবু : দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছি। কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলব, যে কোনো ইন্ডাস্ট্রি বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে দক্ষ মানবসম্পদ। এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের অনেক মেধাবী তরুণ রয়েছে। তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। সেই সাথে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য ব্র্যান্ডিং প্রয়োজন। কেননা প্রচারেই প্রসার। অন্য যে বিষয়টাতে বিশেষ নজর দিতে হবে সেটি হলো, নতুন নতুন মার্কেট তৈরি করা। আমাদের অধিকাংশ রেভিনিউ আসে আমেরিকা, ইউরোপ থেকে। এশিয়ার মধ্যে আসে জাপান থেকে। এখন আমরা যদি নতুন নতুন মার্কেট তৈরি করতে পারি, তাহলে মার্কেটের আকার বড় হবে। মার্কেট বড় হওয়া মানে ব্যবসা বড় হওয়া। তার মানে ইন্ডাস্ট্রি বড় হওয়া।
লোকাল মার্কেটে কোর সফটওয়্যার ব্যবসায়ীরা ব্যর্থ হন কেন? আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
আহমেদুল ইসলাম বাবু : সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন, তারা অনেক যুদ্ধ করে বিশ্বের আইটি বাজারে নিজেদের একটা অবস্থান তৈরি করেছেন। এটা একটা চলমান যুদ্ধ। কেউ কেউ এই যুদ্ধ মোকাবেলা করতে গিয়ে হেরে যান। তখন হতাশ হন। আবার চেষ্টা করেন। যারা অধ্যবসায়ী তারা সামনে এগিয়ে যান। মূলত, সফটওয়্যার ব্যবসাটা নির্ভর করে একজন ব্যবসায়ীর ডেডিকেশন, কঠোর পরিশ্রম, মেধা, কৌশল ও যোগাযোগ দক্ষতার ওপর। যার যত ক্লায়েন্ট, তার ব্যবসাটাও তত ভালো। আমাদের মধ্যে কারো কারো কোনো প্রোডাক্টের অনেক ক্লায়েন্ট আছে। তাদের শুরুটাও দীর্ঘ সময় ধরে। তারা অনেক ভালো আছে। এখন কেউ লোকাল মার্কেটে ব্যবসা করতে চাইলে খুবই নিস একটা প্রোডাক্ট ঠিক করতে হবে। অনেক বড় বাজেট নিয়ে নামতে হবে। আর লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তাহলে একদিন সফল আসবেই। ব্যবসায় সফলতার জন্য প্রয়োজন অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রম আর লেগে থাকা। এর বিকল্প কোনো পথ নেই।
সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি দেখতে চান?
আহমেদুল ইসলাম বাবু : দেখুন, আমাদের দেশে অসংখ্য ভালো ও বিশ্বমানের সফটওয়্যার কোম্পানি আছে। এসব প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের সফটওয়্যার তৈরি করছে। দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় দেশের সাথে ব্যবসা করে আসছে। আবার অনেক কোম্পানি আছে যেগুলো ভালো মানের সফটওয়্যার তৈরি করছে, কিন্তু নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায় ভালো করতে পারছে না। সবাই যার যার জায়গা থেকে ব্যবসা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে এই যুদ্ধটা সম্মিলিতভাবে করা গেলে ইন্ডাস্ট্রির সবাই ভালো করতে পারবে। সবাই ভাল ব্যবসা করলে সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির ইমেজ আরো উজ্জ্বল হবে। এর পরিধি আরো বড় হবে। ইন্ডাস্ট্রি একটা ভালো অবস্থানে আছে। আমি মনে করি, সঠিক কর্মপরিকল্পনা এবং ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে পারলে আগামীতে আইটি তথা সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিই বাংলাদেশকে লিড করবে।