তাপমাত্রার সঙ্গে বিদ্যুৎ পরিবাহিতার এক অহি-নকুল সম্পর্ক রয়েছে। অনেকটা ওই আলাল-দুলালের মতো বিষয়। ওই যে ‘আলাল যদি ডাইনে যায়, দুলাল যায় বাঁয়ে।’ এ ক্ষেত্রে আলাল হচ্ছে তাপমাত্রা, আর তড়িৎ পরিবাহিতা হলো সেই দুলাল। অর্থাৎ তাপমাত্রা যত উচ্চ, তড়িৎ পরিবাহিতা তত কম। এই দশায় পড়ে ‘হাজি চাঁনের’ মতোই বহুদিন ধরে নাচার হয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। এবার বোধ হয় সে দশা কাটল। কারণ, অবশেষে এমন একটি পরিবাহী পাওয়া গেল, যার তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা তুলনামূলক উচ্চ তাপমাত্রায়ও অক্ষুণ্ন থাকে। আর এর মধ্য দিয়ে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মতো উচ্চ প্রযুক্তির গবেষণা এগিয়ে গেল আরেক ধাপ।
উচ্চ গতির সুপার কম্পিউটার কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মতো প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রথম ঝামেলায় পড়েন। তাঁরা এমন কোনো সুপার কন্ডাক্টরের হদিস পাচ্ছিলেন না, যা কোনো বিচ্যুতি ছাড়াই তড়িৎ পরিবহনে সক্ষম। কিন্তু এ ধরনের প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এটি খুব জরুরি। একেবারে পাওয়া যাচ্ছিল না, তা নয়। যাচ্ছিল, কিন্তু তা ছিল অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায়। কিন্তু বিজ্ঞানীদের দরকার ছিল এমন এক পরিবাহী, যা মোটামুটি কক্ষ তাপমাত্রায় কাজ করে। এবার তুলনামূলক অনেক কাছাকাছি পৌঁছেছেন তাঁরা। এমন এক পরিবাহীর সন্ধান তাঁরা পেয়েছেন, যা শূন্যের ২৩ ডিগ্রি (-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) নিচেও সুপারকন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করে। এখনো অনেক পথ যেতে হবে নিশ্চিত। কিন্তু বিরাট অর্জন নিঃসন্দেহে।
বিজ্ঞানীরা এর আগে সেলসিয়াস স্কেলে শূন্যের ২৪০ ডিগ্রি নিচের তাপমাত্রায় এমন সুপারকন্ডাক্টরের দেখা পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। সর্বশেষ অগ্রগতি হিসেবে মাইনাস ৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও এমন সুপারকন্ডাক্টরের দেখা মিলেছিল। কিন্তু এবার যেটি পাওয়া গেল, তা এ তুলনায় অনেক এগিয়ে। এক লাফে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বাধা পেরোনো মুখের কথা নয়। সুপার কন্ডাক্টরটি আর কিছু নয়, ল্যানথেনাম সুপারহাইড্রাইড। তবে এর দেখা পাওয়া মুখের কথা নয়। তাপমাত্রায় বিজ্ঞানীদের স্বস্তি দিলেও, তা চাপের মাপকাঠিতে ঠিক স্বস্তিকর নয়। কারণ এই সুপারকন্ডক্টরটি ১৫০-১৭০ গিগাপাসকেল চাপে স্থিতিশীল। এই চাপ আসলে কতটা? সমুদ্রপৃষ্ঠে বিদ্যমান চাপের ৫ লাখ গুণ বেশি! চোখ কপালে ওঠার মতোই বিষয়। অর্থাৎ তাপমাত্রার বিবেচনায় উচ্চব্যয় এড়ানো গেলেও, চাপের হিসাবে তা আবার বেড়ে যাচ্ছে। তারপরও এটি এক বড় অগ্রগতি হিসেবেই দেখছেন বিজ্ঞানীরা।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ও জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের পরিচালিত যৌথ গবেষণায় এ সুপারকন্ডাক্টরের সন্ধান মিলেছে। গবেষণাটি করা হয়েছে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আরগন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে। এ সম্পর্কিত গবেষণা নিবন্ধটি ২৩ মে গবেষণা পত্রিকা নেচার-এ প্রকাশিত হয়েছে। গবেষক দলের সদস্যরা হলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিটালি প্রকাপেঙ্কা ও গবেষক এরান গ্রিনবার্গ। তাঁরা উচ্চ চাপে ল্যানথেনাম সুপারহাইড্রাইডের মধ্যে সুপারকন্ডাক্টিভিটির বৈশিষ্ট্য দেখতে পান। সেলসিয়াস স্কেলে শূন্যের ২৩ ডিগ্রি নিচে এই যৌগ কোনো বিচ্যুতি ছাড়াই তড়িৎ পরিবহনে সক্ষম, যা এমনকি চুম্বক ক্ষেত্র দ্বারাও বিচ্যুত হয় না। তাঁরা শুধু এই বৈশিষ্ট্যকেই শনাক্ত করেননি, তাঁরা এর রাসায়নিক কাঠামোও আবিষ্কার করেন।
গবেষণা নিবন্ধের বরাত দিয়ে সায়েন্স ডেইলি জানায়, ল্যানথেনাম সুপারহাইড্রাইড উচ্চ চাপে সুপারকন্ডাক্টিভিটির চারটি বৈশিষ্ট্যের তিনটিই প্রদর্শন করছে। এর মধ্যে তড়িৎ পরিবহনে বাধা (রোধ) অত্যন্ত কম। চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যেও এর সন্ধি তাপমাত্রা (ক্রিটিক্যাল টেম্পারেচার) কমে যাচ্ছে। আবার কিছু আইসোটোপ সংযোজন করলে এর তাপমাত্রায় পরিবর্তন দেখা যায়। চতুর্থ যে বৈশিষ্ট্যটি রয়েছে, তা হলো মিসনার ইফেক্ট। এই বৈশিষ্ট্য থাকলে সংশ্লিষ্ট পদার্থ যেকোনো ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্রকে অগ্রাহ্য করতে পারে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দেখা মেলেনি ল্যানথেনাম সুপারহাইড্রাইডে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ করা বস্তুটি ছিল খুবই ছোট, যার ফলে এই বৈশিষ্ট্যটি রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
এই সুপারকন্ডাক্টর খুঁজে পেতে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন অ্যাডভান্সড ফোটন সোর্স, যা অত্যুজ্জ্বল উচ্চ শক্তির এক্স-রে রশ্মি ব্যবহার করেছেন। এই আবিষ্কারকে অনেক বড় অর্জন মানছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ বিশ্বে এমন বহু স্থান রয়েছে, যেখানে মাইনাস ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা স্বাভাবিক। তবে বিজ্ঞানীরা চান, এটিকে আরও এগিয়ে নিতে। অন্ততপক্ষে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসে সুপারকন্ডাক্টরের দেখা পেতে চান বিজ্ঞানীরা।
এর আগে যে সুপারকন্ডাক্টরগুলোর দেখা বিজ্ঞানীরা পেয়েছিলেন তাও ওই ল্যানথেনামের যৌগই। তবে সুপারহাইড্রাইড নয়, হাইড্রাইড। দ্য ওয়্যার জানাচ্ছে, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির দুটি পৃথক গবেষণায় এমন সুপারকন্ডাক্টরের দেখা মিলেছিল। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষক দল জানিয়েছিল, তাঁরা মাইনাস ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্কেলে সুপারকন্ডাক্টিভিটির দেখা পেয়েছেন ল্যানথেনাম হাইড্রাইডে। তবে এ জন্য ১৯০ গিগাপাসকেল চাপ তৈরি করতে হয়েছিল। অন্যদিকে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা ১৫০ গিগাপাসকেল চাপে একই যৌগে সুপারকন্ডাক্টিভিটির দেখা পান। তবে তা সেলসিয়াস স্কেলে শূন্যের ৫৮ দশমিক ১৫ ডিগ্রি নিচে।
সব মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা যে সুপারকন্ডাক্টরের খোঁজ পেলেন, সে পথে আরও এগিয়ে যদি সত্যিই স্বাভাবিক কক্ষ তাপমাত্রায় ও তুলনামূলক নিম্ন চাপে একটি সুপারকন্ডাক্টরের সন্ধান দিতে পারেন, তবে তা নিশ্চিতভাবে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এর সুফল ভোগ করবে ম্যাগনেটিক ট্রেন থেকে শুরু করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার পর্যন্ত প্রযুক্তিগুলো।