ভিডিও শেয়ারিং এ্যাপ টিকটকের অবাধ ব্যবহারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মুন্সিগঞ্জের কিশোর-তরুণরা। লাইক, শেয়ার আর ভাইরাল হওয়ার নেশায় অস্ত্র-মাদক প্রদর্শন, ককটেল তৈরি থেকে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভিডিও আপলোডের নিষিদ্ধ কর্মকান্ডে জড়াচ্ছে অনেকে। বাদ যাচ্ছেনা অশ্লীল ও বিকৃত অঙ্গভঙ্গির সাথে উগ্রসংলাপের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এসব ভিডিও ভীতি সঞ্চার ঘটাচ্ছে স্থানীয়দের মাঝে। সামাজিক শৃংখলা, সংস্কৃতি উপেক্ষা করে অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠছে অনেকে। এখনই প্রতিরোধ করা না গেলে এর ভয়াবহ নীতিবাচর প্রভাব সবার উপরেই, মনে করছে শিক্ষাবিদ-সুশিল সমাজ।
গত ১সপ্তাহে অনলাইন প্লাটফ্রম টিকটকে ঘেটে দেখা যায় ,বিনোদনের কনটেন্ট ছাপিয়ে উশৃংখল নৃত্য থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ কর্মকান্ডের অসংখ্য ভিডিও আপলোড করছে মুন্সিগঞ্জে কিশোর তরুনরা। অপরাধমূলক কয়েক ডজন ভিডিও আমার বিক্রমপুর সংগ্রহ করেছে প্ল্যাটফর্মটি থেকে। নিষিদ্ধ বিস্ফোরক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অবাধে তার ভিডিও শেয়ার করা হচ্ছে। বিস্ফোরক তৈরি, অস্ত্র ও মাদক সংগ্রহের ভিভিও প্রকাশ করছে কেউ কেই। একজনকে দেখে উৎসাহিত হচ্ছে অন্যরা। টিকটক ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই ১৫ থেকে ২৬বছরের মধ্যে । যাদের বড় অংশ স্কুল ও কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থী।
সামাজিক অবক্ষয় ও অপসংস্কৃতির বিকাশের প্রতিফলন এমন ভিডিও। আপলোডকারী অনেকেই অপরাধ সন্ত্রাসী প্রবণ হয়ে উঠার আশংকা জেলার সুশীল সুমাজের প্রতিনিধিদের। এখনই পদক্ষেপ গ্রহণের সময় বলে মনে করেন তারা।
সরকারি হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক আব্দুল হাই তালুকদার বলেন, নিজেদেরকে প্রচার করবার জাহির করার একটা প্রতিযোগিতা কৃষকদের মাঝে বর্তমানে বিরাজ করছে। এ শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা বুঝে হোক না বুঝে হোক একটা কাজ করার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যান্য প্ল্যাটফর্মের মতো তারা টিকটকের ভিডিও আপলোড করছে শেয়ার করছে এবং লাইক দিও নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ভালোকে পরিহার করে খারাপ বিষয়গুলোকেই আসলে বেশি চর্চা করছে কিশোররা। এর একটি প্রতিফলনই টিকটকে অসামাজিক এবং অপরাধপ্রবণ ভিডিও আপলোড করা। পর্যায়ক্রমে দুঃসাহসী কাজ করতেও কিশোর-যুবকরা পিছপা হচ্ছেনা, দ্বিধা করছে না। নানা রকমের অনৈতিক কাজ অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা ব্ল্যাকমেলিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে ঝড়াচ্ছে। এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে। এগুলো যদি আমরা প্রতিরোধ করতে পারি প্রতিহত করতে না পারি তাহলে এর চরম একটি প্রভাব সমাজের সবার উপরে পড়বে। সমাজের সবাই কিন্তু এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবো।
মুন্সিগঞ্জ প্রেসক্লাব সভাপতি শহীদ-ই-হাসান তুহিন বলেন, আমাদের মুন্সিগঞ্জের অনেক উঠতি তরুণরা টিকটকর সাথে জড়িয়ে পড়ছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আমাদের তরুণ এবং যুব সমাজকে নিয়ে যাচ্ছেন রাতের দিকে । খারাপ বিষয়গুলো কখনো ভালো দিকে সমাজকে প্রবাহিত করতে পারে না। টিকটকের মাধ্যমে যে বিকৃত অঙ্গভঙ্গি, ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। যা কিন্ত আছে সামাজিক অধঃপতনের প্রতিফলন। নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশী,বাহবা পাওয়ার জন্য আসলে তরুণরা বুঝে, না বুঝে এসবে আগাচ্ছে। তবে আমাদের রাষ্ট্রের উচিত এসব প্রতিহত করা প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রয়োজনে বন্ধ করে দেওয়াটাই আমি উচিত বলে মনে করি।
তিনি আরো বলেন, এসব টিকটক ভিডিও আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির কোন অংশ নয় এগুলো অপসংস্কৃতি ছড়াচ্ছে ঘটছে। এরমাধ্যমে দেশীয় সংস্কৃতির ধ্বংস এবং দেশের মধ্যে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। অতএব যারা এসব কাজ করছে তারা একে তো অপরাধপ্রবণ দ্বিতীয়ত সংস্কৃতি বিরোধী একই সাথে বিপদগামী।
শিক্ষক ও সামাজিক সংগঠক খালেদা খানম বলেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে এর অবাধ গতি রুখতে হবে। তাহলেই সমাজ থেকে এসব অপসংস্কৃতি দূর করা সম্ভব। কোন বাঁধা না থাকায় কিশোররা একটি কম্পিটিশনে চলে গেছে, কে কত অপরাধ করতে পারে। এতে সমাজে সহিংস ম্যাসেজ যাচ্ছে। কিশোররা দেশের ভবিষ্যৎ, তা যদি বিপথে চলে যায় তাহলে দেশের মঙ্গল কিছুই হবে না। অনলাইন প্লাটফর্মের অবাঁধ ব্যবহার বন্ধ করে যেটুকু না করলেই না সেটুকু ব্যবহার রাখতে হবে।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সুজন হায়দার জনি বলেন, বর্তমান সময়টা যেহেতু অনলাইন সোশ্যাল মিডিয়ার সময় তাই সোশ্যাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করা আমাদের প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রযুক্তির উপর আমাদের এখন নির্ভরতা বাড়ছে। কৌতূহলী তরুনরা প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে। তবে সব বিষয়েরই সুফল ও কুফল আছে। আমি আশা করবো ভালো দিকটাই যেনো কিশোররা অনুসরণ করে, খারাপ বিষয় গুলো পরিহার করে। উশৃংখল অপসংস্কৃতির ভিডিও তৈরি করে ভাইরাল হওয়ার যে প্রবণতা কিশোরদের মধ্যে আরো বেশি ছড়িয়ে পরবে। যাতে তাদের ব্যাক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে, শিক্ষা জীবনে হুমকি হয়ে দাড়াবে।
এদিকে অনলাইন প্লাটফর্ম গুলো মনিটরিং করা হচ্ছে, সন্তান যেনো বিপথগামী না হয় পরিবার ও সর্বমহলের সোচ্চার ভূমিকা রাখার আহ্বান জেলা পুলিশের।
মুন্সিগঞ্জ পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন বলেন, অনলাইন প্লাটফর্ম গুলো ব্যবহার করে অনেকেই নেতিবাচক দিকে ঝুঁকছে। যেগুলোতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়, অপরাধ প্রবণতায় জড়ায় এসব মনিটরিং করা হচ্ছে। মুন্সিগঞ্জে যদি কেউ এসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকে যা আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকিস্বরুপ অথবা পরিবার ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক তাদেরকে সনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পুলিশ সুপার আরো বলেন, যারা অভিভাবক আছেন, শিক্ষক আছেন, সমাজের অন্য যারা আছে তাদের সন্তানের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। তার সন্তান কোথায় যাচ্ছে কার সাথে মিশছে এবং তাদের চলাফেরায় কোন পরিবর্তন আসছে কিনা এসব বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। কোন রকমের কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় সেক্ষেত্রে অভিভাবকেরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হতে পারে এক্ষেত্রে আমরা কিশোরদেরকে কাউন্সিলিং করব কিংবা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।