বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ঘোষণাপত্রটি ভুয়া বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নয় বলে সমকালকে জানিয়েছেন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘তবে সরকার পতনের এক দফার দাবি ঠিক আছে। শুধু ছড়িয়ে পড়া ঘোষণাপত্রটি আমাদের নয়।’
এর আগে, আজ শনিবার বিকেল তিনটায় ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলে সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা দেন আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। সে সময় অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখাও ঘোষণা করেন আসিফ মাহমুদ। এরপর পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘এক দফা’ এর ঘোষণাপত্রটি ছড়িয়ে পড়ে।
এতে উল্লেখ করা হয়, ১ দফা ঘোষণাপত্র—যেহেতু, বর্তমান সরকারের নির্দেশে নির্বিচারে ‘গণহত্যা’ সংঘটিত হয়েছে। নারী-শিশু-ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক কেউ এই ‘গণহত্যা’ থেকে রেহাই পাননি। যেহেতু, সরকার এই হত্যাযজ্ঞের বিচার করার পরিবর্তে নির্বিচারে ছাত্র-জনতাকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করছে। যেহেতু, সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মরণঘাতি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হত্যাযজ্ঞ সংঘটন করেছে।
এতে আরও বলা হয়, যেহেতু, ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিক-মজুরসহ আপামর জনগণ মনে করছেন এই সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ বিচার এবং তদন্ত সম্ভব নয়।সেহেতু, আমরা বর্তমান স্বৈরাচারী সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করছি।একই সঙ্গে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি গ্রহণযোগ্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে জানতে রাত পৌনে দশটার দিকে ছবিটি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘এটা সত্য নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে যেটা ছড়িয়ে পড়েছে সেটা আমাদের নয়।’
তবে বিকেল তিনটায় সারাদেশে ছাত্র-নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা করে খুনের প্রতিবাদ ও ৯ দফা দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। বিকেল পৌনে ছয়টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে এক দফা দাবি ঘোষণা করে প্রায় ১৩ মিনিট বক্তব্য দেন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা দেন।
ছাত্র-জনতার উদ্দেশে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা ও সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা এক দফা দাবির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এক দফাটি হলো- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এই সরকারের পতন ও ফ্যাসিবাদের বিলোপ।’
তিনি বলেন, ‘এতগুলো খুন হয়েছে লাশের হিসাব আমরা এখনও পাইনি। এই সরকার মানুষ খুন করেছে, এখন সে লাশও গুম করেছে। যারা খুন করেছে তারা খুনি, খুনের বিচার করবে? আমরা তাদের থেকে বিচার প্রত্যাশা করি না। একদিকে নির্যাতন-নিপীড়ন, অন্যদিকে সংলাপের আহ্বান জানানো হচ্ছে। আজ কুমিল্লাতে হামলা করা হয়েছে, আমার ভাই শহীদ হয়েছেন। আমরা শহীদ হইতে ভয় পাই না।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই সমন্বয়ক বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে আমরা খুব দ্রুতই ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থানের জন্য সর্বস্তরের নাগরিক, ছাত্র সংগঠন ও সব পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত মোর্চা ঘোষণা করব। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জাতীয় রূপরেখা আমরা সবার সামনে হাজির করব৷’
যে স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-নাগরিক অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে, তার সঙ্গে মানুষকে যোগ দেওয়া এবং পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান নাহিদ। তিনি কাল থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণাটিও তুলে ধরেন।
এরপর অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা করেন আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। সেগুলো হলো-
১। কেউ কোনো ধরনের ট্যাক্স বা খাজনা দেবেন না।
২। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিলসহ কোনো ধরনের বিল পরিশোধ করবেন না।
৩। সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত ও কল কারখানা বন্ধ থাকবে। আপনারা কেউ অফিসে যাবেন না, মাস শেষে বেতন তুলবেন।
৪। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
৫। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো ধরনের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবেন না।
৬। সব সরকারি সভা, সেমিনার, আয়োজন বর্জন করবেন।
৭। বন্দরের কর্মীরা কাজে যোগ দেবেন না। কোনো ধরনের পণ্য খালাস করবেন না।
৮। দেশের কোনো কলকারখানা চলবে না, গার্মেন্টস কর্মী ভাইবোনেরা কাজে যাবেন না।
৯। গণপরিবহন বন্ধ থাকবে, শ্রমিকরা কেউ কাজে যাবেন না।
১০। জরুরি ব্যক্তিগত লেনদেনের জন্য প্রতি সপ্তাহের রোববার ব্যাংক খোলা থাকবে।
১১। পুলিশ সদস্যরা রুটিন ডিউটি ব্যতীত কোনো ধরনের প্রটোকল ডিউটি, রায়ট ডিউটি ও প্রটেস্ট ডিউটিতে যাবেন না। শুধু থানা পুলিশ নিয়মিত থানার রুটিন ওয়ার্ক করবে।
১২। দেশ থেকে যেন একটি টাকাও পাচার না হয়, সব অফশোর ট্রানজেকশন বন্ধ থাকবে।
১৩। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যতীত অন্যান্য বাহিনী ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ডিউটি পালন করবে না। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যারাক ও কোস্টাল এলাকায় থাকবে।
১৪। আমলারা সচিবালয়ে যাবেন না, ডিসি বা উপজেলা কর্মকর্তারা নিজ নিজ কার্যালয়ে যাবেন না।
১৫। বিলাস দ্রব্যের দোকান, শো-রুম, বিপণী-বিতান, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে। তবে হাসপাতাল, ফার্মেসি, জরুরি পরিবহন সেবা যেমন-ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবহণ, অ্যাম্বুলেন্স সেবা, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবহণ, জরুরি ইন্টারনেট সেবা, জরুরি ত্রাণ সহায়তা এবং এই খাতে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহন সেবা চালু থাকবে।
এছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানপাট বেলা ১১ থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত খোলা থাকবে বলে জানান আসিফ মাহমুদ।