বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া এখনও পুরোপুরি লাগেনি এবং রোগ নির্ণয়ের জন্য যেসব যন্ত্রের দরকার হয় সেসবও দেশগুলোর নাগালের মধ্যে নেই। এ দেশগুলোর অনেক নাগরিকই যখন চিকিৎসা সেবার নাগালের বাইরে তখন যদি রোগ নির্ণয়ের সুবিধাটুকুও পাওয়া না যায় তবে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনই বা কীভাবে করবে? যেখানে ১৭টি লক্ষ্যের তিন নম্বরেই রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের কথা।
তাইতো এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে গেটস ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি এক মাইক্রোবায়োলজিস্ট জোর গলায় বলেছেন, এরইমধ্যে যেই প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে তার অভাবে অন্তত আমাদের শিশুদের ভোগা উচিত নয়।
বছরান্তে গেটস ফাউন্ডেশন গোলকিপারস নামক ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। চলতি বছর সেপ্টেম্বরে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের চাইল্ড হেলথ রিসার্স ফাউন্ডেশনের মাইক্রোবায়োলজিস্ট সেঁজুতি সাহা চিকিৎসা প্রযুক্তির অভাবে বাংলাদেশের শিশুরা কীভাবে স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হচ্ছেন তেমন উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন।
তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশের মধ্যে থেকেই অনেকেই কাজ করে যাচ্ছেন। এমনই এক ব্যক্তির কথা তুলে ধরে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ফোর্বস ম্যাগাজিনে। মহৎ যে উদ্ভাবকের কথা ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে তার নাম খন্দকার সিদ্দিক-ই রাব্বানী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা।
তিনি মনে করেন, দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য শুধু চিকিৎসা প্রযুক্তি আমদানি করাই যথেষ্ট নয়। শুধু অতিরিক্ত টাকার জন্যই যে এমন নির্ভরতা তিনি এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তেমনটি নয়। তিনি মনে করেন, চিকিৎসার যন্ত্রাংশগুলো ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট যে আর্দ্রতা, বিদ্যুৎ ছাড়া অন্যান্য যেসব শর্ত থাকে সেগুলো মেনে সব জায়গায় তা ব্যবহার করা নাও যেতে পারে। এছাড়া বিশেষায়িত যন্ত্রাংশগুলো মেরামতের জন্য স্থানীয় লোকবল ছাড়া এগুলো অনেকটাই আবর্জনার মতো।
তার এমন মতের মিল পাওয়া যায় ল্যানসেটের এক গবেষণা প্রতিবেদনেও। কারণ ওই জার্নালে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, গরিব দেশগুলোকে যেসব চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রাংশ সহায়তা হিসেবে দেয়া হয়েছে তার ৪০ শতাংশই অকেজো। যেমন গাম্বিয়ার একটি হাসপাতালকে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর সহায়তা হিসেবে দেয়া হলেও সেটি অকেজো হয়েই পড়ে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সহায়তা গ্রহণকারী দেশগুলোর কাছে এসব যন্ত্রাংশ ই-বর্জ্য ছাড়া কিছুই না।
এসব বিষয় চিন্তা করে রাব্বানী তার ৪০ বছরের ক্যারিয়ারে স্থানীয়ভাবে যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা যায় তেমন যন্ত্র উদ্ভাবনে কাজ করেছেন। এমন চিন্তা থেকেই নিচের যন্ত্রগুলো উদ্ভাবন করেছেন তিনি।
কম্পিউটার ভিত্তিক ইকেজি মেশিন : মূলত গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা বিবেচনা করে এ যন্ত্রটি উদ্ভাবন করেছে রাব্বানীর টিম। এটা ব্যবহার করে স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেরাই রোগীর অবস্থা বোঝা ছাড়াও ইন্টারনেট ব্যবহার করে অন্যস্থানে থাকা চিকিৎসকদের ওই তথ্য দেখাতে পারেন। এছাড়া পরবর্তীতে পাঠানোর জন্য ডাটা সেভ করেও রাখতে পারেন। এই যন্ত্রের ব্যবহার অনেক সহজ হলেও বেশিরভাগ হাসপাতালই বিদেশি যন্ত্র কিনতেই বেশি আগ্রহী বলে জানিয়েছেন রাব্বানী।
কৃত্রিম হাত : এটা দেখতে খুব অসাধারণ না হলেও এর পেছনে ব্যয় মাত্র ২৫ ডলার। এটা ব্যবহার করে লেখা ও টাইপ করা সম্ভব।
সৌরশক্তি চালিত পানি বিশুদ্ধ করার যন্ত্র : দেশের মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করার কথা চিন্তা করে রাব্বানী ও তার টিম মিলে সৌরশক্তিচালিত এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। তবে এই পদ্ধতি কিছুটা জটিল এবং বাজারের অন্যান্য পানি বিশুদ্ধিকরণ পদ্ধতিগুলোর তুলনায় অনেকটা বেশি সময় নেয়।
পানি বিশুদ্ধিকরণের জন্য শেওলার কাগজ : সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাব্বানীর টিম মিলে পানি বিশুদ্ধিকরণের জন্য এই প্রজেক্টে করছেন। এই পদ্ধতিতে শেওলার কাগজ ব্যবহার করছেন তারা। পানি বিশুদ্ধিকরণের অন্যান্য পদ্ধতিতেও যেসব জীবাণু থেকে যায় এই পদ্ধতি ব্যবহারে সেটুকু জীবাণুও আটকে যাবে। তবে এটা অনেক সময় সাপেক্ষ হওয়ায় তারা এটাকে সহজীকরণের কাজ করছেন।