যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধ এবং হুয়াওয়ের মতো টেলিকম সরঞ্জাম নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ করায় বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থার অখণ্ড রূপ বিভক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশ্বের প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়তে কাজ করছে। অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থার কারণে জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে, এমন আশঙ্কা থেকে দেশগুলো ইন্টারনেটে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাস্তবে অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিভক্ত হয়ে দুই বা ততোধিক প্রতিযোগী নেটওয়ার্কে পরিণত হলে তা বৈশ্বিক কানেক্টেড কমিউনিটির জন্য ইতিবাচক হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। খবর ইয়াহু ফিন্যান্স।
সুইজারল্যান্ডের দাভোসে চলমান ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিস’-এর মহাপরিচালক এবং শীর্ষস্থানীয় ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞ জন চিপম্যান টেকনোলজি কোল্ড ওয়ারের বৈশ্বিক প্রভাব নিয়ে এক প্যানেল আলোচনায় সতর্ক করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য বিরোধ ও হুয়াওয়ের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা বিভক্ত হয়ে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক হয়ে ওঠলে চীনা সংস্করণ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বেশি আকর্ষণীয় হবে।
তিনি বলেন, অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা বিশ্বের সব দেশই দেখতে পারছে। কিন্তু তা বিভক্ত হয়ে গেলে সুযোগ-সুবিধাও বিভক্ত হওয়ার পাশাপাশি সীমাবদ্ধতার মধ্যে চলে আসবে। বৈশ্বিক অর্থনীতি বিষয়ে আগ্রহী চীন এখনো অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থার মধ্যে থাকলেও তারা বসে নেই। চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো মার্কিন যেকোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে টেক্কা দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এমনিতেও দেশটিতে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ইন্টারনেট ব্যবস্থার ওপর কঠোর নজরদারি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অর্থাৎ অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থাকে দ্বিখণ্ডিত বা ‘স্প্লিন্টারনেট’ করা হলে বিশ্বের ইন্টারনেট জনসংখ্যা দুই বা ততোধিক ইন্টারনেট সংস্করণ দেখতে পাবে।
দ্বিখণ্ডিত বা স্প্লিন্টারনেট ইন্টারনেট ব্যবস্থায় যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে হবে, তা হলো—কনটেন্ট সরবরাহ চেইন সম্পূর্ণ বদলে যাবে এবং কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্ট্যান্ডার্ডে। ফলে ইন্টারনেট প্রযুক্তি, সফটওয়্যার ও অন্যান্য ইন্টারনেট অবকাঠামো একসঙ্গে কাজ করতে পারবে না। অর্থাৎ ভিন্ন ইন্টারনেট স্ট্যান্ডার্ডের জন্য ভিন্ন ইন্টারনেট প্রযুক্তি, সফটওয়্যার ও ইন্টারনেট অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে।
বিশেষজ্ঞ জন চিপম্যানের দাবি, দ্বিখণ্ডিত ইন্টারনেট ব্যবস্থায় প্রত্যেক সেবাদাতা সিস্টেম ব্যবসায় দিক থেকে সফল হতে চাইবে। তবে চীনের ইন্টারনেট ব্যবস্থার এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা বেশি। চীনা ব্র্যান্ডগুলো সবচেয়ে সাশ্রয়ী তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য দিয়ে বিশ্বের উদীয়মান দেশগুলোয় আধিপত্য বিরাজ করেছে। কাজেই দেশগুলোয় নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থার সম্প্রসারণ দেশটির জন্য প্রতিযোগীদের চেয়ে সহজ হবে।
ইন্টারনেট ব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা বিশ্বে নতুন নয়। এখন পর্যন্ত চীন এ লক্ষ্যে অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকে চীনের নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা বেশ পুরনো, যা ‘দ্য গ্রেট ফায়ারওয়াল অব চায়না’ নামে পরিচিত। এটা একটা সেন্সরশিপ ব্যবস্থা। স্বাধীন মত প্রকাশে চীনের জনগণের ওপর এ সেন্সরশিপ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রকল্পটির অর্থনৈতিক প্রভাব বেশ গভীর। এ কৌশল অবলম্বন করে চীন ইন্টারনেটভিত্তিক শত কোটি ডলার মূল্যের একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়তে পেরেছে।
গত বছর ‘নিজস্ব ইন্টারনেট’ তৈরিতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছিল রাশিয়া। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গত বছরের এপ্রিলে এমন ব্যবস্থা তৈরির জন্য নতুন আইন পাস করিয়েছেন। একই পথে এগোচ্ছে ইরানও। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ইরান ঘোষণা দিয়েছিল, তারা ‘জাতীয় তথ্য নেটওয়ার্ক’ প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ করেছে। এ প্রকল্প দেশটির ‘নিজস্ব ইন্টারনেট’ ব্যবস্থা গড়ার অংশ।
বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে ‘স্প্লিন্টারনেট’ ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। গত সপ্তাহে তাইওয়ানভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি টিএসএমসিকে সামরিক বাহিনীর জন্য সরবরাহকৃত চিপ যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদনের নির্দেশ দিয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। কারণ টিএসএমসির তৈরি চিপ যুক্তরাষ্ট্রের এফ-৩৫ ফাইটার জেটে ব্যবহূত হয়। টিএসএমসি চীনভিত্তিক হুয়াওয়েরও চিপ সরবরাহকারী।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, চীনের পাশাপাশি যদি রাশিয়া ও ইরান নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সফল হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এমন এক ইন্টারনেট ব্যবস্থা তৈরি হবে, যেটার সঙ্গে এখনকার ইন্টারনেট ব্যবস্থার কোনো কিছুরই মিল থাকবে না। এ চেষ্টার পেছনে বিশাল প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ, অনেক অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত। তবে নিজস্ব ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব নয়।