করোনাভাইরাসের আতঙ্কে সারা বিশ্ব। শব্দ তরঙ্গকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়। খুব অল্প সময়ে ছড়িয়ে পড়ার কারণে এখনও গবেষণা করে দেখা হয়নি যে করোনাভাইরাসের উপর ঠিক কত কম্পাঙ্কের শব্দ প্রয়োগ করে তাকে নিষ্ক্রিয় করা যেতে পারে। তবে পুরনো গবেষণা বলছে, বেশ তীব্র কম্পাঙ্কের শব্দ প্রয়োজন যে কোনও ভাইরাস মোকাবিলা করতে।
২০০৮ সালে আমেরিকার আরিজ়োনা স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ অটো স্যাঙ্কি এবং তাঁর ছাত্র এরিক ডাইকম্যান একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যার ফলে ভাইরাসের প্রতিটি পরমাণুর কম্পাঙ্ক হিসেব করা যায়। তাদের পদ্ধতিটি ছিল উচ্চ মাত্রার শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে ভাইরাস মারার।
প্রতি সেকেন্ডে তরঙ্গের সংখ্যা যত বাড়ে, ততই বাড়ে তার শক্তি। রেজ়োন্যান্স ফ্রিকোয়েন্সি- শব্দের উৎস, অর্থাৎ কাঁসর, ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল ইত্যাদিতে বাহ্যিক শক্তি প্রয়োগ করলে তখনই আল্ট্রাসাউন্ড অর্থাৎ তীব্র কম্পাঙ্কের শব্দ তৈরি হবে, যখন বাহ্যিক শক্তিও তীব্র কম্পাঙ্কের হবে। মানুষের শরীরে সেই অতিমানবীয় শক্তি নেই, যা দিয়ে সে তীব্র কম্পাঙ্ক তৈরি করে কাঁসর, খোল-করতাল, শাঁখ কিংবা হাততালির মাধ্যমে আল্ট্রাসাউন্ড তৈরি করে করোনার মতো ভাইরাসকে নষ্ট করবে। করতাল, ঝাঁঝ, কাঁসর কিংবা ঘণ্টা ধাতু নির্মিত। আল্ট্রাসাউন্ড সেখান থেকে অবশ্যই তৈরি হতে পারে। যেমন, ধাতুতে লেজ়ার প্রয়োগ করে আল্ট্রাসাউন্ড তৈরি করা গিয়েছে। প্রসঙ্গত, লেজ়ারের কম্পাঙ্ক এক লক্ষ কোটির বেশি।
প্রতি সেকেন্ডে শব্দের সম্পূর্ণ একটি তরঙ্গ যত বার এগোতে পারে, তাকে সেই শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি বা কম্পাঙ্ক বলে। কম্পাঙ্ক যত বাড়ে শব্দের শক্তি তত বাড়ে।
আসলে প্রত্যেকটি বস্তুর কিছু নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক থাকে। এই কম্পাঙ্কের সঙ্গে বাহ্যিক বলের কম্পাঙ্ক সমান হলে ওই বস্তুর কম্পাঙ্ক সর্বাধিক হয়। যেমন, আপনি আপনার প্রিয় গিটারটা হাতে নিয়ে সেটির কোনও একটি কর্ডে আঙুল দিয়ে আঘাত করলেন, আর গিটারের তারটা কাঁপতে কাঁপতে শব্দতরঙ্গ তৈরি করল। একে বলে রেজ়োন্যান্ট ফ্রিকোয়েন্সি।
প্রতি সেকেন্ডে ৭০০,০০০ কম্পাঙ্কের শব্দতরঙ্গ প্রয়োগ করে টাইপ-এ ইনফ্লুয়েনজ়া ভাইরাসকে প্রায় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করায় সফল বিজ্ঞানীরা। এঁদের প্রত্যেকেরই প্রাথমিক কাজ এটাই দেখায় যে, ভাইরাসের নিষ্ক্রিয়করণ কেবল উচ্চ ক্ষমতার শব্দতরঙ্গ নয়, পার্শ্ববর্তী কোষ বা কলার সঙ্গে এর সংযোগের ধরনের উপর নির্ভর করে।
আরও এ রকম তথ্যে আসার আগে, আমাদের জানা উচিত ভাইরাসের গঠন ঠিক কী রকম। ভাইরাস কিন্তু স্থান, কাল এবং পাত্র অনুযায়ী জীব বা জড় পদার্থ হিসেবে কাজ করে। কিছু ভাইরাসের বাইরে একটি আবরণ বা এনভেলপ থাকে, কারও সেটা থাকে না। এনভেলপের তলায় থাকে ক্যাপসিড। এনভেলপ তৈরি হয় কোষপর্দা দিয়ে, এবং এতে থাকে ভাইরাস থেকে তৈরি গ্লাইকোপ্রোটিন। এই গ্লাইকোপ্রোটিনই ভাইরাসকে প্রাণী বা উদ্ভিদের কোষে ঢুকতে সাহায্য করে। কোনও ভাবে এই গ্লাইকোপ্রোটিনের গঠন নষ্ট করে ফেলতে পারলেই কেল্লা ফতে! ভাইরাসগুলি এক রকম নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে এর ফলে।
আবার অন্য দিকে, কিছু ভাইরাসের এনভেলপ থাকে না। এদের একদম বাইরের আবরণ যেটা থাকে, তাকে ক্যাপসিড বলে। ক্যাপসিডও প্রোটিন দিয়েই তৈরি হয়। এনভেলপের মতো ক্যাপসিডও ভাইরাসকে প্রাণী বা উদ্ভিদ কোষে প্রবেশ করতে সাহায্য করে।
আরও বিস্তারিত ভাবে বলা যায়, ক্যাপসিড বা এনভেলপে অবস্থিত প্রোটিন হল ভাইরাসের আইডেন্টিটি কার্ড। প্রাণী বা উদ্ভিদদের কোষে অসংখ্য রিসেপ্টর বা গ্রাহক প্রোটিন থাকে। রিসেপ্টর কারা? বাইরে থেকে আসা কোনও রাসায়নিক বস্তুকে কোষের ভিতর ঢুকতে দেবে কি দেবে না, তা নির্ধারণ করে। যে কোনও ভাইরাসের বাইরের আবরণ দিয়েই রিসেপ্টর ভাইরাসের রাসায়নিক গঠন বুঝতে পারে এবং ভাইরাসকে কোষের ভিতরে প্রবেশের পথ তৈরি করে দেয়। ভাইরাসের বাইরের আবরণের গঠনে একটু এ দিক-ও দিক হলেই রিসেপ্টর আর ভাইরাসের গঠন বুঝতে পারে না।
তা হলে কি রিসেপ্টর ক্ষতিকর? ভাইরাসকে ঢুকতে দেবে কেন কোষে? উত্তর হল, না। রিসেপ্টার ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থকে অন্য রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে আলাদা করে চিনতে পারে না। রিসেপ্টর কেবল রাসায়নিক গঠন চিনে ভাইরাসকে কোষে প্রবেশ করতে দেয়। সুতরাং, ভাইরাসের ওই বাইরের আবরণটি নষ্ট হওয়া, ভাইরাসের আইডেন্টিটি কার্ড বা পরিচয়পত্র হারিয়ে ফেলার মতোই।
২০০৮ সালে আমেরিকার আরিজ়োনা স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ অটো স্যাঙ্কি এবং তাঁর ছাত্র এরিক ডাইকম্যান একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যার ফলে ভাইরাসের প্রতিটি পরমাণুর কম্পাঙ্ক হিসেব করা যায়।
লেজ়ার আলো দিয়ে ভাইরাসের ভিতরকার অণু-পরমাণুতে তীব্র কম্পন তৈরি করা যায়। এর ফলে ভাইরাসগুলো কম্পনের ফলেই মারা যাবে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাস লেজার আলো দিয়ে নিষ্ক্রিয় করার পদ্ধতি খুব শিগগির চলে আসবে। এই পদ্ধতিতে শব্দ দিয়ে করোনাভাইরাসকে মারা সম্ভব হবে।