যুক্তরাষ্ট্র-চীনের চলমান বাণিজ্য বিরোধের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে হুয়াওয়ে। নেটওয়ার্ক সরঞ্জামের নিরাপত্তা দুর্বলতা এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইরানে পণ্য সরবরাহের অভিযোগে হুয়াওয়ের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ফলে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে হুয়াওয়ের ব্যবসা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। হুয়াওয়ে ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের হুমকি-ধমকির পর আকস্মিক সুর বদল করল মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ। এখন তারা চীনভিত্তিক হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সংশোধন করবে বলে জানিয়েছে। ফলে পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ফাইভজি নিয়ে হুয়াওয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনায় কোনো বাধা থাকবে না। গত সোমবার মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের পক্ষ থেকে হুয়াওয়ে ইস্যুতে সুর বদলে এমন কথা বলা হয়েছে। খবর রয়টার্স।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন বাণিজ্য বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট অন্য এজেন্সিগুলো হুয়াওয়ের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সংশোধনের বিষয়ে একটি প্রস্তাবে সই করেছে, যা এখন ফেডারেল রেজিস্টারে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা সংশোধনের প্রস্তাব গত শুক্রবার ফেডারেল রেজিস্টারের কাছে পাঠানো হয়েছে, যা গতকালই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের কথা বলা হলেও এ প্রতিবেদন লেখা অবধি কোনো ঘোষণা আসেনি।
বিবৃতিতে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের সেক্রেটারি উইলবার রস হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা সংশোধনের উদ্যোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক উদ্ভাবনের নেতৃত্বকে প্রতিহত করবে না। তবে আমরা সব ধরনের পরিস্থিতিতে জাতীয় নিরাপত্তা এবং বৈদেশিক নীতি স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা মার্কিন প্রযুক্তিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার পক্ষে। যে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক চেষ্টায় উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং একটি মান নির্ধারণের পক্ষে কাজ করছি।
হুয়াওয়ে ফাইভজি নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি খাতে নেতৃত্ব দেয়ার লক্ষ নিয়ে কাজ করছে। বিশ্বজুড়ে ফাইভজি নেটওয়ার্ক নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সরবরাহের দিক থেকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি মিত্র দেশ নিরাপত্তা দুর্বলতার অজুহাত দেখিয়ে হুয়াওয়ের ফাইভজি নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি বর্জনে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে, যা সাম্প্রতিক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইভজি নেটওয়ার্ক চুক্তি হুয়াওয়ের হাতছাড়া হওয়ার পেছনে প্রভাব ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে হুয়াওয়ের নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম ব্যবসার ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে, তা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তবে হুয়াওয়ে ইস্যুতে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের সুর বদল এ আশঙ্কা অনেকটা দূর করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিষয়টি ঘিরে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি হুয়াওয়ে। বিশ্বের বৃহৎ টেলিকম নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম নির্মাতা এবং দ্বিতীয় বৃহৎ স্মার্টফোন নির্মাতা হুয়াওয়ে। কয়েক প্রান্তিক আগেও এর ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি ছিল নজরকাড়া। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে বাণিজ্য বিরোধ এবং মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠায় ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের রোষানলে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে নানা অযৌক্তিক অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছিল।
বর্তমানে হুয়াওয়ে টেকনোলজিসের ফাইভজি নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম ব্যবসা বিভাগকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ফাইভজি নেটওয়ার্ক সরঞ্জামবিষয়ক চুক্তিতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এসব চুক্তি হুয়াওয়ের সঙ্গে হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তুলনামূলক ক্ষুদ্র প্রতিদ্বন্দ্বী নকিয়া ও এরিকসন বাগিয়ে নেয়।
বিশ্বের বৃহৎ টেলিকম নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম নির্মাতা হুয়াওয়ে। নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম বাজারে এখন দ্বিতীয় ও তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে নকিয়া ও এরিকসন। যুক্তরাষ্ট্রের কারণে হুয়াওয়ে চাপে থাকায় ব্যবসায় সুবিধা নিচ্ছে নকিয়া ও এরিকসন।
বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, হুয়াওয়ে শুধু বিশ্বের বৃহৎ টেলিকম নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম এবং দ্বিতীয় বৃহৎ স্মার্টফোন নির্মাতাই নয়; পঞ্চম প্রজন্মের আল্ট্রা-হাই-স্পিড মোবাইল নেটওয়ার্ক ফাইভজি অবকাঠামো নির্মাণেও নেতৃত্ব দিচ্ছে। ফাইভজি অবকাঠামো নির্মাণ এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। হুয়াওয়ে কয়েকটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে এককভাবে পশ্চিম ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় ২৩০টি শহরে সার্ভিল্যান্স সরঞ্জাম সরবরাহ করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অভিযোগ, হুয়াওয়ের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক সরঞ্জামে সূক্ষ্ম ব্যাকডোর আছে। নিজেদের সরঞ্জামের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তির কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব তথ্য পরবর্তী সময়ে ব্যাকডোরের মাধ্যমে সরাসরি চীন সরকারের হাতে পৌঁছানো হয়। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ এবং নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইরানে পণ্য সরবরাহ করায় গত বছর হুয়াওয়ের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগ।