অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন ব্যবহার করেনি এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া খুব কঠিন। যুগে যুগে মোবাইলের আকার, অপারেটিং সিস্টেম ও বিভিন্ন ফিচারের উন্নতি এবং অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও বর্তমান যুগ এখন অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম যুক্ত মোবাইলের। বর্তমান সময়ে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের জনপ্রিয়তার ওপর ২০১৯ সালে একটি জরিপ করা হয়, সেই জরিপে দেখা গিয়েছে পুর বিশ্বে ২.৩ বিলিয়ন লোক অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন ব্যবহার করে আর অ্যান্ড্রয়েডের মার্কেট শেয়ার ৭৪.১৩%। অন্য দিকে আইফোনের মার্কেট শেয়ার ৩৩.৩৩% যা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের থেকে অনেক কম। এই জরিপ থেকেই জানা যাচ্ছে অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন কতটা জনপ্রিয়।
কিছুদিন আগে একটি স্বনামধন্য ইউনিভার্সিটিতে প্লে-স্টোরের এমন কিছু অ্যাপের ওপর টেস্ট করার জন্য ৫০ জন অ্যান্ড্রয়েড ইউজার নিয়ে যে অ্যাপগুলো অহেতুক আপলোড করা আছে প্লে-স্টোরে। সেই টেস্টে ৫০ জন ইউজারকে দেয়া হয় র্যাম বৃদ্ধিকারক অ্যাপ, দ্রুত চার্জ করার অ্যাপ, মোবাইল মেমরি বৃদ্ধি কারক অ্যাপসহ এমন আরও কিছু অ্যাপ যেগুলার বৃদ্ধি ও হ্রাস শুধু হার্ডওয়্যার সম্পর্কিত।
তাদের মোবাইলের ওপর ২০ দিন নজর রাখা হচ্ছিল সেই ইউনিভার্সিটির রিসার্চারদের দ্বারা (অনুমতিক্রমে), সেখানে দেখা গিয়েছে যে ৫০ জনের মধ্যে ৩৯ জনের সব ডেটা যাচ্ছিল অচেনা কোন এক কোম্পানির সার্ভারে অ্যাপ দ্বারা। ৮ জনের ফন্ট ও ব্যাক ক্যামেরার মাধ্যমে তাদের ওপর সরাসরি নজর রাখা হচ্ছিল অ্যাপের মাধ্যমে। বাকি ৩ জনের শুধু গ্যালারি, কন্ট্রাক্ট ও এসএমএসের ডেটা যাচ্ছিল সার্ভারে (প্রত্যেকের ওপর একই ক্যাটাগরির ভিন্ন ভিন্ন অ্যাপ দ্বারা পরীক্ষাটি করা হয়েছিল)। আসুন যেনে নেই, এমন কিছু যদি আপনার সঙ্গে হয় তাহলে কী করণীয় ও হ্যাকাররা বা এসব অ্যাপ কীভাবে ডেটা নিচ্ছে ইউজারদের থেকে।
সাধারণত আমরা জানি যেসব জিনিস বেশি জনপ্রিয়, সেসব জিনিসের দিকে অসাধু ব্যক্তি বা দলের নজরও বেশি থাকে। তেমনি অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনেও রয়েছে তাদের নজর। বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পাতা থেকে শুরু করে হ্যাক করা বা ইউজারের ডেটা নেয়া কোন কিছুই বাদ রাখেনি তারা। তাদের ফাঁদ হিসাবে অনেক কিছু ব্যবহার করলেও যে কৌশলটি ব্যবহার করে তারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয় বা ইউজারদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে তা হচ্ছে “অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ বা অ্যাপ্লিকেশন”।
অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ব্যবহার সম্পর্কে নিরাপদ অনলাইন গড়ে তুলার লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত সহায়তাদানকারী প্রতিষ্ঠান ক্র্যাফ-এর আইটি অ্যানালিস্ট রাইয়ান মালিক বলেন, আমরা অনেক সময় প্লে-স্টোরেই এমন কিছু অ্যাপ দেখি যেসব অ্যাপ ভিত্তিহীন ও এগুলা ইউজার ডেটা নেয়ার এক ধরনের লোভনীয় ফাঁদ। যেমন আমরা দেখতে পাই র্যাম ও মোবাইল মেমোরি বৃদ্ধির জন্য অনেক অ্যাপ রয়েছে স্বয়ং প্লে-স্টোরে, কিন্তু র্যাম বা মেমোরি পুরোটাই হার্ডওয়্যারের ব্যাপার, কোন অ্যাপ দ্বারা এগুলা বৃদ্ধি করা সম্ভব না। এমন আরও অনেক অকেজো অ্যাপ প্লে-স্টোরে ঘুরছে আর ইউজাররা না বুঝেই ডাউনলোড করছে। অপ্রয়োজনীয় পারমিশনস দিচ্ছে ও ব্যবহার করছে।
তিনি আরও বলেন, একটি অ্যানালাইসিসে দেখা গিয়েছে এদের মধ্যে এমন অনেক অ্যাপ ইউজারদের প্রচুর ডেটা নিচ্ছে নিজেদের সার্ভারে এবং কিছু কোম্পানি বিক্রিও করছে তাদের ইউজার ডেটা। আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, মোবাইল বা কম্পিউটারের কিছু জিনিস যেগুলো কমানো বা বৃদ্ধি নির্ভর করে সম্পূর্ণ হার্ডওয়্যারের ওপর; কোনভাবেই এগুলো অ্যাপ দ্বারা বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়।
আমরা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে যে সব ফিচার ও সার্ভিস ব্যবহার করি তার প্রায় সবই অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপসের মাধ্যমে। আমরা বুঝতেই পারছি আন্ড্রয়েড অ্যাপসগুলোর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু হতে পারে। ঠিক সেটির সুযোগ নিচ্ছে কিছু অসাধু চক্র। তারা যে কাজটি করে ফাঁদ পেতে রাখে তা হলো তারা বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় অ্যাপ ডেভেলপ করে প্লে-স্টোরে দিয়ে রাখে। অনেক অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন ইউজার না বুঝেই সেটিকে ডাউনলোড করে ফেলে এবং ব্যবহার করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে যা হয় তা হচ্ছে অ্যাপ ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর কাছে ইউজারের বিভিন্ন ধরনের ডেটা ও তথ্য যেতে থাকে বা তারা নিতে থাকে। তাদের মধ্যে কিছু অ্যাপ অ্যানালাইসিস করে দেখা গিয়েছে তারা শুধু কাস্টমার বিহেভিয়ার না, তারা মোবাইলের যাবতীয় ডেটা নিয়ে যাচ্ছে ফোন নম্বর থেকে শুরু করে গ্যালারীর ছবি পর্যন্ত।
অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহারকারীদের সতর্কতার উদ্দেশ্যে ক্র্যাফ-এর সভাপতি জেনিফার আলম জানান, প্লে-স্টোরে এমন কিছু অ্যাপ রয়েছে যেগুলা অহেতুক ও সেই অ্যাপের ক্ষেত্রে প্রয়োজন নেই এমন পারমিশন নিচ্ছে ইউজারদের থেকে। এতে করে ইউজারদের ডেটা নিতে পারছে খুব সহজেই। অন্যদিকে ইউজার বিহেভিয়ারের দিকেও নজর রাখছে। এখানে সব থেকে বড় রিস্ক হচ্ছে ডেটাগুলো যাচ্ছে থার্ড পার্টিদের হাতেও। সুতরাং ইউজার ডেটার সঙ্গে তারা তাদের ইচ্ছেমত কাজ করতে পারবে এতে করে ইউজার প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে। আমরা এমন লোভনীয় অ্যাপগুলো ইন্সটল থেকে বিরত থাকার ট্রাই করবো।
তিনি আরও বলেন, আমরা অ্যাপ ইন্সটল করার সময় একটু লক্ষ্য রাখবো কোন অ্যাপসের সঙ্গে কোন পারমিশনটি যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যদি সন্দেহ হয় তাহলে আমরা ওই সকল অ্যাপ ব্যবহার থেকে বিরত থাকবো। যেমন একটি সাধারণ র্যাম ইনক্রিজার অ্যাপ কন্ট্রাক্ট বা গ্যালারীর পারমিশন চাচ্ছে বা একটি দ্রুত চার্জিং অ্যাপ মাইক্রোফোনের পারমিশন চাচ্ছে। এগুলো ইউজার ডেটা নেয়ার ফাঁদ। তাই অ্যাপ ইন্সটল ও পারমিশনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
আসুন জেনে নেয়া যাক কী ধরনের অ্যাপ গুগল প্লে-স্টোরে থাকলেও ব্যবহার করা যাবে না-
১। র্যাম ও মোবাইল মেমোরি বৃদ্ধিকারী অ্যাপ। এটি সাধারণত মেমোরিতে থাকা ক্যাশ ডিলিট করে আপনাকে বৃদ্ধিকৃত রেজাল্ট সো করে।
২। ক্লিনার অ্যাপ। অহেতুক থার্ড পার্টি অ্যাপ না ব্যবহার করাই ভালো। ক্লিনার এখন বাইডিফল্ট অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলোতে থাকে।
৩। ফাস্ট চার্জিং অ্যাপ। এটাও হার্ডওয়্যারের ওপর নির্ভর করে কিন্তু ফোনে এই সিস্টেম এখন বাইডিফল্ট থাকে। তাই এক্সট্রা প্রয়োজন নেই।
৪। ইউসি ব্রাউজার। এই ব্রাউজার ইউজারদের সব ডেটা চায়নাতে আলিবাবার সার্ভারে ইউজার ডেটা পাঠাচ্ছে ও বিভিন্ন ধরনের আজেবাজে অ্যাড শো করছে ইউজারদের ফোনে।
৫। এমন কিছু অ্যাপ যেগুলা অহেতুক ও অপ্রয়োজনীয় পারমিশন চায়, এসব অ্যাপ ইন্সটল ও ব্যবহার করা যাবে না।
এইসব সতর্কতা অবলম্বন করার পরেও যদি কোন ধরনের ডেটা লস বা ঝুঁকি অনুভব করেন, তবে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করবেন। যেকোন জরুরি পুলিশ প্রয়োজনে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে বিনামূল্যে কল করতে পারেন।