সীমান্ত উত্তেজনার জেরে ভারতে চীনবিরোধী মনোভাব জোরালো হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশটিতে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে শাওমি, ভিভো, অপো ও রিয়েলমির মতো চীনভিত্তিক ক্রমবর্ধমান স্মার্টফোন ব্র্যান্ডগুলোর ওপর। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ভারতের স্মার্টফোন বাজারে চীনা ব্র্যান্ডগুলোর বাজার দখল কমে ৭১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ছিল ৮১ শতাংশ। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। খবর ইটি টেলিকম।
কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ভারতে স্মার্টফোন সরবরাহ ১ কোটি ৮০ লাখ ইউনিটে দাঁড়িয়েছে, যা গত বছরের একই প্রান্তিকের তুলনায় ৫১ শতাংশ কম। মূলত নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কভিড-১৯ মহামারী ঠেকাতে ভারতজুড়ে লকডাউনের কারণে স্মার্টফোন সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হ্রাস পায়। লকডাউনের কারণে গত এপ্রিলের পুরোটাই ভারতে স্মার্টফোন সরবরাহ শূন্যে নেমেছিল। দ্বিতীয় প্রান্তিকের মে ও জুনে লকডাউন কিছুটা শিথিল করা হলে পুনরায় ডিভাইস সরবরাহ শুরু হয়। তবে এতে বাড়তি মাত্রা যোগ করে ভারত-চীনের মধ্যে সৃষ্ট সীমান্ত উত্তেজনা। ভারতে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক উঠেছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে। চীনা ব্র্যান্ডগুলোর সরবরাহ এবং বাজার দখল কমার প্রধান কারণ ভারতীয়দের চীনবিরোধী মনোভাব।
কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের গবেষণা বিশ্লেষক শিল্পি জৈন বলেন, এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে ভারতে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রথমবারের মতো ৫০ কোটির মাইলফলক অতিক্রম করেছে। একই প্রান্তিকে দেশটিতে চীনা স্মার্টফোন ব্র্যান্ডগুলোর বাজার দখল কমেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ স্মার্টফোন বাজার এখন ভারত। বিপুল জনগোষ্ঠীর কারণে দেশটি চীনা স্মার্টফোন ব্র্যান্ডগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চীনা ব্র্যান্ডগুলো বাজার দখল বাড়াতে ভারতে এরই মধ্যে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। স্থানীয়ভাবে ডিভাইস উৎপাদন, গবেষণা এবং উন্নয়ন সেন্টার, ভ্যালু মানি অফার ও দৃঢ় অনলাইন বিক্রয় চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করেছে প্রায় সব চীনা ব্র্যান্ড। কিন্তু তার পরও বাজার দখল কমছে। এ পরিস্থিতিতে বাজারটিতে আধিপত্য ধরে রাখতে চীনা ব্র্যান্ডগুলোর হাতে তেমন আর কোনো সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।
ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনার জেরে সৃষ্ট পরিস্থিতি ভারতে ব্যবসা জোরদারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে স্যামসাংয়ের জন্য। তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের বৃহত্তম বাজার ভারতে চীনভিত্তিক ডিভাইস ব্র্যান্ডগুলোর কারণে টানা কয়েক বছর ধরে খারাপ সময় পার করছে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি।
শুধু চীনা ইলেকট্রনিকস ডিভাইসই নয়; চীনবিরোধী মনোভাবের জেরে ভারতে এরই মধ্যে ৫৯টি চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সোস্যাল মিডিয়ায় চীনা অ্যাপ আনইনস্টলের দাবি ক্রমান্বয়ে জোরালো হচ্ছে। নিষিদ্ধের তালিকায় টিকটক, ইউসি ব্রাউজার, শেয়ারইট, বিগো লাইভ ও হেলোর মতো জনপ্রিয় অ্যাপ রয়েছে। চীনা এসব অ্যাপকে দেশটির সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা, প্রতিরক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারত সরকারের দাবি, চীনা অ্যাপগুলো দেশ ও দেশের নাগরিকদের জন্য বিপজ্জনক। যে কারণে স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটসহ সব ধরনের গ্যাজেটে অ্যাপগুলোর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ভারতীয়দের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষাদান এবং দেশের সার্বিক নিরাপত্তার জন্যই অ্যাপগুলো নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নিষিদ্ধ হওয়া অ্যাপ তালিকায় ভারতে জনপ্রিয় অ্যাপ উইচ্যাটও রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতীয়দের চীনা পণ্য বর্জনের ঘোষণায় অনেক বহুজাতিক ব্র্যান্ডের জন্য দেশটিতে ব্যবসা জোরদারের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে চীনের বাইরের ডিভাইস ব্র্যান্ডগুলোর জন্য ভারত-চীনের সীমান্ত উত্তেজনা আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ তিন বছর আগেও ভারতের স্মার্টফোন বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল স্যামসাংয়ের। কিন্তু শাওমি, অপো ও ভিভোর মতো চীনা ব্র্যান্ডগুলোর দৌরাত্ম্যে বাজারটিতে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে স্যামসাং। প্রতিষ্ঠানটিকে হটিয়ে এরই মধ্যে ভারতের স্মার্টফোন বাজারে শীর্ষ অবস্থানে জায়গা করে নিয়েছে শাওমি। এছাড়া বাজারটিতে দ্বিতীয় অবস্থানও আরেকটি চীনা ডিভাইস ব্র্যান্ডের কাছে হারিয়েছে স্যামসাং। সীমান্ত উত্তেজনার জেরে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে স্মার্টফোন ডিভাইসের দ্বিতীয় বৃহৎ বাজারটিতে নিজেদের অবস্থান পুনরুদ্ধারের সুযোগ হিসেবে দেখছে প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে দেশটিতে উপস্থিতি বাড়াতে কাজ করছে।
কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ভারতের বাজারে শীর্ষ পাঁচ স্মার্টফোন ব্র্যান্ডের মধ্যে চারটিই ছিল চীনা। শীর্ষ পাঁচে নন-চীনা ব্র্যান্ড হিসেবে একমাত্র স্যামসাং জায়গা পেয়েছিল। জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ভারতের স্মার্টফোন বাজারের ৩০ শতাংশ দখলে নিয়ে শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছিল শাওমি। বাজারটির ১৭ শতাংশ দখলে নিয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ভিভো। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান বাজারটির ১৪ এবং ১২ শতাংশ দখলে নিয়ে যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে রিয়েলমি ও অপো। এক সময় শীর্ষে থাকা স্যামসাং জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ভারতের স্মার্টফোন বাজারের ১৬ শতাংশ দখলে নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে নেমেছে।